বাঙালি গণেশ' ও রাজার ইচ্ছে
আমাদের বাল্যকালে দেখেছি মূলভূমি
বাংলায় গণপতি দেবতার একক পুজো ছিলো বিরল। মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর পুজোই বাংলার
লোকের কাছে ছিলো অধিক জনপ্রিয়। এমন কি প্রাচীনকালের কৌমসমাজের প্রজনন-তন্ত্রী সংস্কৃতির
প্রতীক 'কলা-বৌ' পুজোর সঙ্গেও গণেশকে যুক্ত করা হয়েছিলো। আমরা প্রবাসী বাঙালি হিসেবে
দেখতুম বিহার ও উত্তরপ্রদেশে ন্যূনতম আড়ম্বরের সঙ্গে গণেশপুজো পালিত হতো। বাঙালিদের
সরস্বতী পুজোর মতো। দক্ষিণ ভারতে থাকার সময় দেখতে পাই মহারাষ্ট্র ব্যতিরেকে অন্ধ্র,
তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকে গণপতি পুজোর ধুমধাম বেশ প্রকট। পূর্ব ভারতে যেটা দেখা যেতো না।
আমি কলকাতায় এসেছি ২০১৪ সালের পর। তখন থেকেই দেখছি পশ্চিমবঙ্গে এই দেবতার নামে বারোয়ারি
উৎসব, যাকে হিন্দিতে বলে 'দিন দুনি, রাত চৌগুনি' মাপে বেড়ে উঠেছে। দেবতা হিসেবে গণেশ
আগে ছিলেন গৃহদেবতা। তাঁকে কেন্দ্র করে জনতার উৎসব প্রথম প্রচলিত হয় মহারাষ্ট্রে। বালগঙ্গাধর
টিলক ১৮৯৩ সালে মুম্বাইয়ের কেশবজি নাইক চওলে গণপতি উৎসবের সূচনা করেন। এই আয়োজনের মূলে
ছিলো রাজনৈতিক রণকৌশল। মহারাষ্ট্রের তুমুল
বর্ণবাদী সমাজে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে লোকমান্য টিলক দেবতা গণপতিকে বেছে নেন। কারণ
সমাজের সর্বস্তরেই এই দেবতার স্বীকৃতি দেখা যেতো। ব্রাহ্মণ বা দলিত, উভয় সম্প্রদায়ের
মধ্যেই গণপতির অল্পবিস্তর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। টিলক প্রস্তাবিত এই দেবতার পুজো কালক্রমে
হিন্দু মহাসভার প্রযত্নে ‘জাতীয়তাবাদে’র আধার হয়ে দাঁড়ায়। আজ এক বন্ধুর মুখে শুনলুম
তিনি জনৈক বাঙালি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে শুধিয়ে ছিলেন, বাঙালিরা কেন দিন দিন এতো বেশি
সংখ্যা ও মাত্রায় গণেশপুজো করছেন? সেই ব্যক্তি
যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলেন 'কেন? গণেশ কি বাঙালি নন?' প্রশ্নকর্তা এহেন পাল্টা আক্রমণে
হকচকিয়ে সরে পড়েন। তিনি হয়তো জানতেন না, এদেশে দেবতাদের রূপ বা জাতিবদল রাজার ইচ্ছেতেই
হয়। আজ নয়, গত আড়াই হাজার বছর ধরে 'সেই ট্র্যাডিশন' একই ভাবে চলে আসছে।
প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে জ্ঞানচর্চার একটি শাখা আছে। যার গ্রিক নাম 'Theogony' । বাংলায় যাকে বলা যায় 'দেবতাতত্ত্ব'। তার পরিভাষা হিসেবে বলা হয়েছে,
‘The Theogony, which comes from the Greek word 'theogonia' meaning 'birth [or generations] of the gods' is aptly named since it is primarily concerned with describing how the universe came into being, and the genealogy of the titans, gods, monsters, nymphs, dryads, demigods and everything in-between.’
যাঁরা ভারততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করেন, 'দেবতাতত্ত্ব' তাঁদের জন্য একটি জরুরি আলোচ্য বিষয়। এ অধম দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি সন্ধান করে এসেছে। দেবতাকেন্দ্রিক 'দর্শন' চর্চার প্রধান স্তম্ভগুলি হলো ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতি। পূর্ব বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এদেশের আধ্যাত্মিক ও লোকাচারভিত্তিক 'ধর্ম' চর্চায় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থই প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। 'বাঙালি গণেশ'-এর প্রতি অনুরাগ বা 'ভক্তি' বিশেষ রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই নিকট অতীতে বেড়ে উঠছে এই বাংলায়।
'দেবতাতত্ত্ব'-এর নিরিখে আমাদের ইতিহাস সন্ধান করলে দেখা যাবে ঋগবেদে গণেশ দেবতার উল্লেখ নেই। পরবর্তীকালের অথর্ব বেদে নামটি ঈষৎ শোনা গেছে। গণেশ এক পৌরাণিক দেবতা। পুরাণ অনুযায়ী শিবের অনুচররা ছিলেন 'গণ'। মানে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। পরে যাঁরা 'গণ'তন্ত্রের গৌরবে 'জনগণ' হয়েছেন। 'গণ'-দের মধ্যে ছিলেন রক্ষ, যক্ষ, ভূত, পিশাচ ইত্যাদি এদেশের আদি আর্যেতর অধিবাসীরা। 'হস্তী' ছিলো তাঁদের প্রিয় টোটেম। পরবর্তীকালে আর্যেতর সমাজ, বহুল মাত্রায় সদ্ধর্মের শরণ নিলে 'হস্তী' ওই সংস্কৃতির পবিত্র প্রতীক হয়ে ওঠে। এই পশুর মহিমা ছিলো আকাশচুম্বী। জাতকের গল্প অনুযায়ী বুদ্ধ স্বয়ং পূর্বজন্মে হস্তী-জাতক ছিলেন। গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যখন মহাযানী সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে নেয়,
তখন বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে 'সম্মান' জানাবার জন্য 'হস্তী' প্রতীক এক প্রধান দেবতা হিসেবে ব্রাহ্মণ্য দেবজগতে স্থান করে নিয়েছিলেন। নতুন দেবতা সঙ্গত ভাবেই আর্যেতর শৈব ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ছিলেন। তাঁকে দেবাদিদেব শিবের 'যুবরাজ' হিসেবে পিতার অনুচর 'গণ'দের অধিপতি হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছিলো। সেজন্য তাঁর নাম হয় 'গণপতি' বা 'গণেশ'। তাঁর গুণ সিদ্ধিদান ও বিঘ্ননাশ করা। তিনি পৌরাণিক সব দেবতার মধ্যে প্রথম পূজ্য। সে জন্য তাঁর অন্য নাম 'বিনায়ক'। 'গণেশ পুরাণ'-এ তাঁর একটি অন্য নামও পাওয়া যায়, 'হেরম্ব'। যার অর্থ, দুর্বল ও সৎ মানুষের রক্ষাকর্তা। গণপতির শিরোদেশ, মুখমণ্ডল শুভ্র। যেহেতু বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে শ্বেত হস্তীকে পরম পবিত্র মনে করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর দেহ আর্যেতর মানুষদের মতো পাটল বর্ণ। পৌরাণিক ধ্যানমন্ত্রে তাঁর রূপ সম্বন্ধে বলা হয়েছে,
‘ওঁ খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরম্,
প্রস্যদন্মদগন্ধলুব্ধমধুপব্যালোলগণ্ড
স্থলম্।।
দস্তাঘাত বিদারিতারিরুধিরেঃ সিন্দূরশোভাকরং,
বন্দে শৈলসুতা সুতং গণপতিং সিদ্ধিপ্রদং
কামদম্’।। ইত্যাদি।
এই দেবতাকে নিয়েও কৌতুহল বোধ করেছি। তবু নানা কারণে মৎপ্রণীত 'হিন্দু দেবতা-এক অনির্বেদ অডিসি' গ্রন্থের পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়নি। এদেশে পুরাণযুগের গুপ্তপর্বে প্রাচীনতম যে সব মন্দির এখনও অক্ষত আছে তার থেকে আমার দেখা দুটি মন্দিরের গণেশ বিগ্রহের ছবি থাকলো এখানে। ভূগোল দেখতে গেলে মন্দির দুটি এদেশের দুই বিপরীত প্রান্তে, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থিত। বোঝা যায় গুপ্তযুগের দেবতা বিষয়ক অনুশাসন সারা দেশেই সমান রূপে প্রভাবী ছিলো। লক্ষণীয়, উভয় ক্ষেত্রেই গণপতি দ্বিভুজ মূর্তিতে বিরাজমান। পরবর্তী যুগে আমরা চতুর্ভুজ গণেশ মূর্তির অবির্ভাব দেখতে পাই। ব্যাসদেবের অনুলেখক হিসেবে প্রস্তাবিত গণেশ দেবতার অবয়ব চতুর্ভুজ রূপে কল্পিত হয়েছিলো। তাঁর একহাতে লেখনী শোভা পেতো। মহাভারত লিপিবদ্ধ হবার সময়কাল চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে বলেই অনুমান করা হয়। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে কল্পিত গণেশ মূর্তি যদি দ্বিভুজ হয়, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যেতে পারে গণেশের মহাভারত অনুলিখন কাহিনি, ব্যাসকূট ইত্যাদি তত্ত্ব, হয়তো পরবর্তীকালের পুরাণ সূত্রেই সংযোজিত হয়েছিলো।
ওড়িশার পরশুরামেশ্বর মন্দিরের শিবের রাজসভার যে ছবি কল্পনা করা হয়েছে, সেখানে গণেশ শিবের পদপ্রান্তে বিরাজমান। শৈব সংস্কৃতি অনুযায়ী সেখানে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু উভয়ে শিবকে অর্ঘ্য প্রদান করছেন। ডানদিকে ভৈরব ও পার্বতী ব্যতিরেকে শিবের অনুচরদের দেখা যাবে। যাঁদের আর্যসংস্কৃতি 'গণ' সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করতো। বাদামি গুহার সময় কাল ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ। পরশুরামেশ্বর ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ পুরাণযুগের শীর্ষকালে দেবতা 'গণপতি' এই রূপেই মানুষের পূজা গ্রহণ করতেন।
এদেশের রাষ্ট্রশক্তি যুগে যুগে দেবতার নামে মানুষের মনোগহনে নিহিত অন্ধকারের শক্তিকে প্ররোচিত করেছে। মানুষের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করে এসেছে তা'কে। বিঘ্ননাশী গণপতির কাছে প্রার্থনা থাকবে, এই নিচ কৌশল থেকে তাঁকে যেন অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি উন্মেষকাল থেকেই নিপীড়িত, দরিদ্র সমাজের দেবতা। বণিকের রাজনীতি হয়তো তাঁকে বহুলাংশে অপহরণ করে নিয়েছে। কিন্তু তিনি যেন 'দলবদল' না করেন।
জন-গণেশের জয় হোক….
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন