সমকালীন ছোটগল্প |
রাত্রি এক অভিযানী
একটাও ছবি বিক্রি হল না মা আজকেও! বুঝতে পারছি না ইউনিক থিমের উপর সব ছবি তাও কেন কিনছে না কেউ বলো তো? ভিড় করে জাস্ট দেখেই যাচ্ছে, আর কত যে গালভরে প্রশংসা তুমি যদি সামনে থেকে একবার শুনতে!
মেয়ে এক্সিবিশান থেকে ফিরে পিঠ
থেকে ব্যাগটা খুলে জায়গামতো না রেখে খাটের উপরে একটু যেন ঝাঁঝের সঙ্গেই ছুঁড়ে রেখে
দিলো। খাটের উপরে ওর কয়েকটা জামাকাপড় মা কেচে ধুয়ে শুকিয়ে তুলে এনে রেখে দিয়েছিলেন।
পরে ধীরেসুস্থে ওগুলো ঝেড়ে ভাঁজ করে গুছিয়ে তুলে রাখবেন বলে। সেই ধোয়া জামাকাপড়ের
উপরেই সায়ন্তি ব্যাগটা ছুঁড়ে রাখলো। চা আনতে গিয়েছিলেন মা, রান্নাঘর থেকে আওয়াজ
শুনেও চেঁচিয়ে উঠলেন না বরং চা আর আগে থেকে ভেজে রাখা কিছু নিমকি সেসব নিয়ে ট্রে হাতে
ঘরে ঢুকে বললেন, যা তো শিগগির হাত পা ধুয়ে এসে বোস আমার কাছে। চা খেতে খেতে কথা বলি
আয়, জরুরী কথা আছে তোর সঙ্গে।
আমি কী কী এতক্ষণ বলে যাচ্ছি শোনোনি
বোধ হয় না মা? সায়ন্তির কথার উত্তর না দিয়ে মা দেবিকা মৈত্র শান্ত গলায় বললেন,
আরে তুই আগে তো এসে বোস আমার কাছে, তবে তো ভালো করে কথাগুলো শুনতে পারব, বুঝতেও পারবো
আর আমার কথাগুলোও বলতে পারবো। আচ্ছা আসছি, বলে সায়ন্তি ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য বাথরুমের
দিকে চলে গেলো।
ট্যাপ থেকে সরু মোটা মাঝারি ছরর্ ছর্ টুপ্টাপ্ এরকম বিভিন্ন পরিমাণে যতটা জল পড়ে সায়ন্তি তার মধ্যে থেকে বিভিন্ন অবয়ব দেখতে পায়। বাথরুমের শুকনো দেওয়ালে জল ছুঁয়ে জল ছুঁড়ে ছবিও আঁকে। ছোটবেলা থেকেই বাথরুমে ঢুকলে আর বেরোতে চায় না। দেবিকা চিৎকার করে ডেকে ডেকে মেয়েকে বাথরুম থেকে বার করান। সায়ন্তি বেরিয়ে হাসতে হাসতে বলে, জানো মা মোনালিসা ছবিটা আঁকতে ভিঞ্চি দাদুর কতদিন লেগেছিলো? কেউ বলে তিন বছর, কেউ বলে চার বছর। কিন্তু আসলে চোদ্দো বছর ধরে ভিঞ্চি দাদু মাঝে মাঝেই ছবিটাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। তাই তো আজও দুর্ভেদ্য তার রহস্যময় হাসির রহস্য। এইবার তুমি ভাবো সেই কুহকিনী মোনালিসা দিদুর যদি ছবি আঁকার অভ্যাস থাকতো তাহলে তিনি কত বছর ধরে এক একটা ছবি আঁকতেন সেটাও যেমন ধারণার বাইরে তেমনি আমার বাথরুম টাইমও মাপজোকের বাইরে। এইসব বলে মাকে রাগিয়ে দিয়ে খুব হাসতো ও। তবে আজকে যেন আনমনা হয়েই হাত পা ধুয়ে বাথরুম থেকে সোজা এসে ঘরে ঢুকে মার কাছে এসে বসলো।
সায়ন্তির মনের অবস্থাটা আন্দাজ করতে পেরে স্মিত হেসে ছোট টাওয়েলটা নিয়ে এসে মেয়ের মুখ হাত মা নিজেই মুছিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকলেন, মায়ের উপর করে নাও যত উৎপাত, বরের ঘরে গেলে তো আর পারবে না!
ইস্ আমার বয়েই গেছে! আর আমি ওসব
বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না কিন্তু মা। একদম এসব বলে আমাকে জ্বালিয়ে মারবে না। কথাগুলো
বলতে বলতে সায়ন্তি টুক টুক করে নিমকি খেতে খেতে চায়ে চুমুক দিতে লাগলো।
দেবিকা তারপর বললেন, এক্সিবিশনের
খবর কী বল। কি যেন বলছিলি সবাই কত প্রশংসা করেছেন, হ্যাঁ সেটাই তো স্বাভাবিক। কত সুন্দর
ছবি আঁকিস তুই, কেন তোর কি বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুই একজন দারুন পোটো… হা হা হা...
মা ভাবছেন কত তাড়াতাড়ি মেয়ের
মুখের উপর থেকে দুর্ভাবনার কালো মেঘটা সরিয়ে খুশির রোদের ঝিলিক খেলিয়ে দিতে পারেন।
কিন্তু মেয়েটা যেন বড় মুষড়ে পড়েছে।
সায়ন্তি বলে উঠলো, জানো মা তোমার
ঠাট্টাই বোধহয় সত্যি। আমি একেবারেই পোটো, এখনো বোধহয় শিল্পীর স্তরে পৌঁছতে পারিনি।
না হলে একটাও ছবি বিক্রি হচ্ছে না কেন মা? তুমি যে শাড়িতে ফেব্রিক করে রোজগার করো
বাবাই চলে যাওয়ার পর এটুকু না থাকলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম ভাবলেও ভয় করে।
কিন্তু মা আমি আমার মতো হতে চাই। আমার ছবি আমি চাই প্রকৃত শিল্প রসিকদের কাছে পৌঁছে
যাক। যার ড্রয়িংরুমে আমার ছবি থাকবে তিনি যেন অবসরমতো আমার আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে
স্নিগ্ধ এক সীমাহীন তৃপ্তির জগতে হারিয়ে যেতে পারেন কিছুক্ষণের জন্য, এই এত রংএর গাঢ়
মাঝারি হালকা শেড যেন তার স্নায়ুকে আরাম দেয়, প্রাণশক্তিতে পুষ্ট করে, ভাবায়। ভাবতে
ভাবতে আমার ছবির দর্শক যেন পৌঁছে যেতে পারেন অস্তিত্বের সমান্তরাল আভাসের সামনে। তেমন
ছবি আঁকতে পারলে ভগবান বলে মনে হয় নিজেকে তাই না মা?
চা পর্ব শেষ করে কাপ প্লেটগুলো সায়ন্তি গুছিয়ে তুলছে তখন দেবিকা বললেন, সুনন্দ এসেছিলো। সায়ন্তি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল আকস্মিকভাবে সুনন্দর প্রসঙ্গ এসে যাওয়ায়। তারপর বললো, অ। তো সুনন্দ দ্য মোস্ট ম্যানলি পেইন্টার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড তোমার কাছে কেন এসেছিলো? তুমি বারণ করে দিয়েছো তো জীবনে কখনো যেন আর না আসে আমার সামনে, বলে দিয়েছো তো?
ভাবলেশহীন মুখে দেবিকা বললেন, না
তো, বরং আমি ওর দেওয়া প্রস্তাব তোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবো বলেছি।
সায়ন্তি ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও
নিজেকে সামলে নিলো। জিজ্ঞেস করলো, কী প্রস্তাব দিলেন মহামান্য সুনন্দ চৌধুরী শুনি?
দেবিকা বললেন, সুনন্দ বলছিলো ও দ্বিতীয় একটা ফ্যাক্টরি শুরু করেছে তাতে শাড়ি, ড্রেসমেটেরিয়াল-এর
উপর পেইন্টিং করা হয়। ভালো ডিজাইনার কাম ম্যানেজার চাইছে। ও তো আমাকে খুব করে অনুরোধ করছে আর সঙ্গে তোর কথাও বলছে যাতে
রাগ অভিমান ভুলে তুই আমি দুজনেই ওর এই ভেঞ্চারে যোগ দিই।
সায়ন্তি রাগে কাঁপতে লাগলো, মা!
ও আবার আবার যেচে এসে গায়ে পড়ে অপমান করে গেলো মা, ওই সবচেয়ে বড় শিল্পী! সফল শিল্পী!
ওর ছবি লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, ওর ছবির ক্রেতা দেশ বিদেশের মন্ত্রীমহল থেকে তাবড়
ধনী মানুষ। ও শিল্পী আর বাকি সবাই পোটো! মা তুমি কি কিচ্ছু বোঝোনি ও কি করতে চাইছে?
দেবিকা হেসে বললেন, তুই পোটো না
হলে এতো রেগে যেতিস না। আচ্ছা আমি যে শাড়িতে ফেব্রিক করি আমার রং তুলিতে কি শিল্প
ফোটে না? এত রাগ করলে চলে? চল খেয়ে নিবি চল রাত হয়ে যাচ্ছে যে। খাওয়া দাওয়া সেরে
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো মা মেয়ে। দুজনেরই মনে হতে লাগলো অন্ধকারটা ফিকে হয়ে গেছে,
নাকি ওদের চোখগুলোই স্পাই ক্যাম হয়ে গেছে!
আটমাস কেটে গেছে সেদিনের পর। আগামী দিন কুড়ির মধ্যে দেবিকা মৈত্র নিজের চতুর্থ ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করবেন। প্রথম আর্ট গ্যালারি ও দ্বিতীয় হোম ডেকর ফ্যাক্টরির দায়িত্ব সামলাচ্ছে দেশের জনপ্রিয় উদীয়মানা শিল্পী প্রতিভা সায়ন্তি মৈত্র। তাদের তৃতীয় ফ্যাক্টরিতে রেজিন ফার্নিচার তৈরি হয়। ডিজাইনার সায়ন্তি, বাকিটা সামলান দেবিকা। চতুর্থ ফ্যাক্টরিতে কয়েকভাগে সুচিশিল্প, নানান রকমের প্রাকৃতিক জিনিসপত্র থেকে সুন্দর সুন্দর গহনা তৈরি হচ্ছে। দেবিকা মৈত্রের ফ্যাক্টরি থেকে কর্মী গিয়ে শিল্পরসিক মানুষজনের চাহিদামতো বাড়ির দরজায়, ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে দেবিকা মৈত্রের নিজের হাতে করা নকশা এঁকে দিয়ে আসছে।
মাস পাঁচেক আগে একটা আর্ট এন্ড
ক্রাফ্ট মেলাতে একধারে নিজের স্টলে বসে কয়েকটা হোম ডেকর আইটেমের উপর রং তুলি দিয়ে
কাজ করছিলো সায়ন্তি। মারোয়াড়ি এক ছবি ব্যবসায়ীর নজর টানে কাজগুলো। সেই থেকে ওদের
উত্থানের শুরুর এই বাস্তব অংশটুকু মা মেয়ের জীবনে স্বপ্নের মতো। যেন দীর্ঘ সময়ের
পর খুলে দেওয়া হয়েছে কোনো লকগেট আর জলাধারের কংক্রিটের দেওয়ালের গা বেয়ে ক্রমশ
বেগে আরও তীব্রতর বেগে জলধারা নেমে এসে ছুটে চলে যাচ্ছে সামনের দিকে।
সুনন্দর ফ্যাক্টরিতে একরকম জোর করেই দেবিকা মৈত্র সায়ন্তিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুজনে একসাথে কাজ করেছেন মেরেকেটে দু'মাস। সুনন্দর ছবি দেশে কিংবা বিদেশে আর বিক্রি হয় না আর সেরকম। কারণ দেশে রাজা বদলালে রাজপাটও বদলায়। ছবি বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় সুনন্দ বাধ্য হয়েই তার দ্বিতীয় ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়। সায়ন্তিরা অকৃতজ্ঞ নয় বলে সুনন্দকে ওদের রেজিন ফার্নিচার ফ্যাক্টরিতে ম্যানেজার হিসেবে বহাল করে দিয়েছে। সুনন্দ আবার একটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ শুরু করেছিলো যদিও, সায়ন্তি তাকে সাহায্যও করছিলো কিন্তু সুনন্দ সামলাতে পারেনি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন