কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৩ |
বেলাশেষে
বিকেল প্রায় শেষ, সন্ধ্যে নেমে আসার প্রাক্কালে তিনতলার ব্যালকনিতে বসে শুভব্রত দেখল, তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির গেটে একটা উবের এসে দাঁড়ালো। নেমে এলো এক মহিলা। তারপর গেটের সিকিউরিটিকে জানিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল। দৃশ্যটা চোখে পড়ল ঠিকই, কোনো ভাবনার ব্যাপার ছিল না। কত কত মানুষই তো আসা-যাওয়া করে! কিন্তু একটু পরে ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠতেই শুভব্রত সচেতন হলো। এই সন্ধ্যের মুখে কে এলো! সে একা মানুষ। স্ত্রী রীতা বছর কয়েক আগে প্রয়াত হবার পর সত্যি সত্যিই একা হয়ে গেছে। দুই ছেলেমেয়ে সেই কবে চাকরিসূত্রে প্রবাসী। বিয়ের পর পাকাপাকিভাবে সেখানেই সংসার পেতেছে। যখন নিজে একটি মালটি-ন্যাশানাল কোম্পানির উচ্চপদে কর্মরত ছিল, তখন তাও একরকম ছিল, কিন্তু অবসর নেবার পর একাকীত্বের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে পড়েছে।
শুভব্রত ফ্ল্যাটের দরজা খুলে অবাক হলো, সেই আগন্তুক মহিলা তার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কে আপনি? কাকে চাইছেন? তার আগেই কেমন যেন একটা খটকা লাগলো মনে, মহিলা কি তার পূর্বপরিচিত! হারিয়ে যাওয়া কোনো মুখের আদলের ছায়া যেন এই মহিলার মুখে লেগে আছে! হঠাৎ তার মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো, তুমি? শুভমিতা?
মহিলা হাসল। বলল, যাক, ভুলে যাওনি
তাহলে!
শুভমিতা ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমের সোফায় বসল। চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, বাঃ বেশ গুছিয়ে রেখেছো তো! রীতা চলে যাবার পর কীভাবে ঘরদোর সামলাচ্ছ?
শুভব্রত ম্লান মুখে বলল, সামলানোর
আর কী আছে, দুজন কাজের মাসী আছে। চলে যাচ্ছে।
রান্নার মাসী একটা প্লেটে কয়েকটা
মিষ্টি নিয়ে এলো। শুভমিতা হেসে বলল, একেবারেই নয়। সাংঘাতিক সুগার। তুমি বরং বিনা চিনির
লিকার-চা করে দাও।
শুভব্রত বলল, শুধু সুগার, নাকি
আরও কিছু আছে?
-আছে তো! হাইপ্রেসার, থাইরয়েড,
দু’হাঁটুতে অস্টিও-আর্থারাইটিস।
-ভালো। এই বয়সে এসব না থাকলে ঠিক
যেন মানায় না! তা তোমার হাজব্যান্ড কেমন আছে? তারও তো বয়স হলো!
-তুমি সুকুমারের কথা বলছ! ও তো
নেই। এই তো গতবছর আমরা ছোটমেয়ের কাছে কালিফোর্নিয়ায় গেছিলাম। প্রতি বছরই যাই। ওখান
থেকে ফেরার পথে লন্ডনে বড়মেয়ের কাছে যাবার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া হলো না। সুকুমার ক্যালিফোর্নিয়াতেই
হার্ট অ্যাটাকে চলে গেল।
শুভব্রত গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল শুভমিতার মুখের দিকে। সময়ের কী অদ্ভুত পরিহাস! সেই প্রথম যৌবনে যে মুখের লাবণ্য ও সৌন্দর্য শুভব্রতকে উন্মাদ করে তুলেছিল, সদ্যযৌবনা লাউডগার মতো লকলকিয়ে বেড়ে ওঠা শুভমিতার অদম্য আকর্ষণের কাছে তার জীবনের আর সব আকর্ষণ ফিকে হয়েগেছিল, আজ শুভমিতার মুখে ও শরীরে তার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। বয়সের দখলদারিতে আজ যেন শুভমিতা বয়ে বেড়াচ্ছে একদা তার অপরূপ রূপের ধ্বংসাবশেষ। সেই অসামান্য রূপ ও সৌন্দর্যের সামনে নতজানু হয়ে সেদিন শুভব্রত প্রণয় নিবেদন করেছিল শুভমিতার কাছে। শুভমিতা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল উপেক্ষায়।
আচমকাই শুভব্রত বলল, তুমি কেন আজ আমার কাছে এসেছ, জানি না। জানতেও চাই না। শুধু মনে হচ্ছে, তুমি না এলেই ভালো হতো শুভমিতা!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন