কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল

 


(৪০)     

যে ক-দিন কলকাতায় ছিল, বড্ড ব্যস্ততায় কেটেছে মামপির। পাড়ার লোকেদের অতিরিক্ত আসা-যাওয়াতার মা-র ঢাক পেটানোর অভ্যাসের জন্য। হাজারো কৌতূহল। সে এখন অনেক ম্যাচিওর, হাসিমুখে বিরক্তি চেপে রাখল। নিজের পুরোনো অফিস পাড়ায় গেল একদিন, যদি সে তল্লাটে দু-চারজন চেনা মানুষের সাথে দেখা হয়। হল না যে তা নয়, কিন্তু ছাড়া-ছাড়া, আগ্রহহীন, উদাসস্বরে ক্ষোভের সুর, “ও আচ্ছা! কী করে ম্যানেজ করলি রে চাকরিটা? জাস্ট ইন্টারভিউ? লাকি গাই!”

ভালো লাগেনি শ্রুতির। পালটে গেছে এরা? নাকি সে নিজে? অর্জুনের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ ছিল। ফোনে চেষ্টা করল। ‘নাম্বার ডাজনট একসিস্ট বলে যান্ত্রিক কণ্ঠ শুনতে হল। আশা করেছিল অর্জুন অন্তত তার আসার খবরে খুশী হবে। একদিন দেখা করবে, আলাপ করিয়ে দেবে তার বউ অথবা ফিয়ঁসের সঙ্গে। বিয়ে হয়ে গেছে কিনা শ্রুতি জানেনা। সে হায়দরাবাদে চাকরি পেয়েছে জেনে অর্জুন খুশী হয়নি। তা বলে এভাবে সম্পর্কই শেষ করে দেবে শ্রুতি ভাবেনি। বেস্ট ফ্রেণ্ড না, তেমন কেউ ছিলও না। কিন্তু ভালো বন্ধু ছিল তারা, স্বচ্ছ, নির্ভেজাল, লিঙ্গনির্বিশেষ একটা বন্ধুত্ব। শ্রুতির ফ্রাস্ট্রেশনস, ট্যানট্রামস্ অনেকবার অর্জুন সামলে দিয়েছে। তার চাকরি পাবার খবরে শ্রুতির ঈর্ষা হয়নি, দুঃখ হয়েছিল যদিও।

ফেরার পথে ক্যাবে বসে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল শ্রুতি। মানুষ কত পালটায়! সম্পর্কগুলোও পথের দৃশ্যের মতো আকাশের রঙের মতো অস্থির। হতাশ লাগে শ্রুতির, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে চাকরির জায়গায়।

দেবার্ঘ্য তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল শ্রুতিকে। রাস্তা থেকে অল্প ভেতরে স্ট্যাণ্ড-অ্যালোন বিল্ডিং-এর তিনতলায় দু-কামরার ফ্ল্যাট, একেবারে বাহুল্যহীন। শ্রুতি আনমনা হয়ে দেখছিল। লিভিংরুমের একপাশে ছোটো খাবার টেবিল, চারটে চেয়ার। দেওয়ালে টি-ভি, একফালি ডিভানের পাশে দু-খানা হালকা সিঙ্গল সিটারএইই অন্দরসাজ। লিভিংরুম ছোটো, কিন্তু জিনিসের অপ্রতুলতায় বড়ো ও খোলামেলা মনে হচ্ছে। দু-টি ঘরের নিরিবিলি ঘরটিতে দেবার্ঘ্য থাকে। সেটির দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখা যায় বড় পুকুর। টলটল করছে জল। সামান্য বড়ো ঘরটিতে অ্যাটাচড্ টয়লেট। ওঘরে দেবার্ঘ্যর মা থাকেন। একদিকে ছোটো সুন্দর শ্বেতপাথরের সিংহাসনে ঠাকুরের ফোটো। সমস্ত বাড়িময় নির্মল, পরিচ্ছন্নতার গন্ধ। চারদিকে ঘেঁষাঘেঁষি ফ্ল্যাট থাকা সত্বেও ঘরের মধ্যে দমবন্ধ লাগে না। শ্রুতি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে,

কিউট!”

পাশে দেবার্ঘ্য বসেছিল। হাসল,

কিউট শুধু! সুন্দর না? মা-র হল পরিষ্কারের বাতিক। সারাদিন এতেই বিজি। আমি বলি ও-সি-ডি। ঘরে-পরার চটি পর্যন্ত ধুয়ে-মুছে রাখে। একটা ফার্নিচার কিনতে দেয়না, জায়গাই নাকি নেই!”

দেবার্ঘ্যর মা হাসছিলেন। সাদা পোর্সেলিনের বাটিতে সাদা রঙের চিঁড়ের পোলাও এনেছেন, সাদা প্লেটে সন্দেশ। শ্রুতি ইতস্তত করে,

হাত ধোব!”

ঝকঝকে শুকনো বাথরুম। ফ্রেশনারের গন্ধ। শ্রুতি নিজেকে বলে, “কী ভাবছিস?”

দেবার্ঘ্য বলে,

মা-র চয়েস সাদা বা একেবারে হালকা রঙ। পর্দা, বেডকভারসব।

আর নোংরা হলে?”

নোংরা হতে দেয় নাকি? সারাদিন নাকি সময়ই পায়না! বুঝতেই পারছ সময়টা কী করে কাটে?”

ভদ্রমহিলা হাসেন,

তুমি ভয় পেয়োনা শ্রুতি, ও উলটোপালটা বকে। আমি শুনি না। ফ্ল্যাট পছন্দ হয়েছে তোমার? যে ঘরটা তোমার পছন্দ সেটাতে তোমরা থেকো

সে বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। একটু সময় নিয়ে ভদ্রমহিলা বলেন,

অবশ্য এই ফ্ল্যাটে তোমরা নিজেদের মনের মতো করে সাজিয়ে থাকতে পারো। ফ্ল্যাট কেনার অর্ধেকটা টাকা দেবু লোন নিয়েছিল। বাকিটা ওর বাবার পি-এফ”।  

দেবার্ঘ্য স্পষ্টতঃ বিরক্তি প্রকাশ করে, আড়চোখে শ্রুতির দিকে তাকায়। মুখ নীচু। কী শুনছে কী ভাবছে ধরা যায় না। তার মা নরম গলায় আবার বলেন,

ইচ্ছে হওয়া স্বাভাবিক। আমি তখন অন্য ফ্ল্যাটে উঠে যাবো। আমাদেরই ফ্ল্যাট ওটাও।

শ্রুতি ভাবে, সে জেনে কী করবে! অন্তর্গত শালীনতাবোধ আরও আড়ষ্ট করে তুলছিল। যতই এঁরা আপন করার চেষ্টা করুন, সে বাইরের লোকই। দেবার্ঘ হাসে আবার। বলে,

ডোন্ট গেট এমব্যারাসড্। মা-র বলার পেছনেও কারণ আছে।

কারণটাও শুনতে হয় শ্রুতিকে। দেবার্ঘ্যর ঠাকুরদার প্রপার্টির একটা অংশ তার বাবার নামে আছে। ওই অংশে সাড়ে-পাঁচশো স্কয়ারফিটের ওয়ান বি-এইচ ফ্ল্যাট। ওটি তার মা ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহে একবার করে হাজিরা দেন। না হলে নানা জটিল ঝামেলাতে পড়ার সম্ভাবনা।

কখনো কখনো মনে হয় প্রপার্টি থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। আত্মীয়-স্বজনের ব্যবহার দেখলে ভাবি ছেড়েছুড়ে দিই! আবার ভাবি, প্রাপ্য ছেড়ে দেওয়া বোকামো।

দেবার্ঘ্যর মা-র শান্ত স্বরে ক্লান্তি, আক্ষেপ। শ্রুতির গলা শুকিয়ে যায়, বুক কেঁপে ওঠে। তার মা যা করছে, একেবারে ঠিক নয়। সে দেবার্ঘ্যর মা-র দিকে তাকায়। দম আছে। সুন্দর নন, কর্মঠ, পোড়-খাওয়া চেহারা। অনেক লড়াই সত্বেও শান্ত মুখের ভাব স্বতন্ত্র। বৈধব্য তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। শ্রুতি অন্যমনস্ক হয়ে যায়, কত কী ঘোরাফেরা করে মাথার মধ্যে।

ফেরামাত্রই সেদিন দেবিকা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল,

কী কইল শাশুড়ি? কেমন লাগল অগরে?”

সে জবাব দেয়নি। মা-র সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে ইচ্ছে করেনি। মৌনং সম্মতিলক্ষণং ভেবে নিয়ে দেবিকা বলেছিল,

তাইলে বিয়ের ডেট ফাইনাল করি?”

অসহায় লাগছিল মামপির। যা কোনওদিন করেনি, তাই করেছিল। দেবিকাকে জড়িয়ে ধরে গাঢ় অস্ফুট গলায় বলেছিল,

আমি কি তোমাদের বোঝা হয়ে গেছি মা? এখন তো নিজের খরচটাও নিজেই চালাই। তবু তুমি!”

গলা ধরে এসেছিল মামপির। এতশত বোঝার ক্ষমতা নেই দেবিকার। হতভম্বভাবে বলেছিল,

কী হইছে মা? তরে ওরা কিছু বলেছে? দেবার্ঘ্যরে তর পছন্দ না? আমি যে ভাবলাম!”

আর একটাও কথাও মেয়ের মুখ থেকে বের করতে পারেনি দেবিকা। অনেকবার বলেছিল,

আমারে না বলতে চাস, অন্তত তর মাসীকে গিয়ে বল

পাতলা ধোঁয়াশামাখা মন নিয়ে হায়রাবাদে ফিরেছে শ্রুতি। কেন এত দোলাচল, এমন বিভ্রান্তি? একজনও নেই যার সঙ্গে উদ্বেগ ভাগ করে নেওয়া যায়। দেবার্ঘ্যর সঙ্গে রায়দিঘি বেড়াতে গিয়েছিল। দেবার্ঘ্য ঘনিষ্ঠতর হতে চেয়েছে একান্তে। তার শরীরের গন্ধ, উষ্ণতা, নরম সান্নিধ্য চেয়েছে। আপত্তি ছিল না, শরীর তারও সজীব। কিন্তু আড়ষ্ট ছিল মন, সাড়া দিতে পারেনি। কে জানে কোনদিকে চলবে জীবন! দেবার্ঘ্য অবশ্য জোর করেনি। শ্রুতি নিজের কাছে কৈফিয়ৎ দিয়েছে, যতদিন বন্ধুত্ব না হবে ততদিন আড়ষ্টতা কাটবে না।

মনে পড়লে থমথমে মুখে বসে থাকে। দেবার্ঘ্যর বিব্রত, কিঞ্চিৎ বিরক্ত মুখ মনে পড়ে। বুকে উঠে-আসা দেবার্ঘ্যর আদরের হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল সে। মনে পড়ে দেবার্ঘ্য বাড়িতে তার মা-র সাজিয়ে দেওয়া দুপুরের খাবার। আয়োজন বা পদের বাহুল্যও ছিল না। অথচ সুগন্ধে ভরে ছিল জায়গাটা। সোনালি বর্ডার দেওয়া পোর্সেলিনের আকাশী প্লেটে, বাটিতে খাবার বেড়ে দিয়েছিলেন।

জানো শ্রুতি, এই সেটটা আমার বিয়ের প্রথম বার্ষিকীতে দেবুর বাবা কিনে এনেছিলেন। অনেক সাবধানে অক্ষত রেখেছি”।

মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। বুকের মধ্যে কুলকুল করে উঠেছিল, এমন সংসারে যাবে! দেবার্ঘ্যর মা বলছিলেন,

তুমি রান্না করতে পারো তো শ্রুতি? না পারলে শিখে নেবে। কী বলো তো, কবে থেকে ভেবে রেখেছি, একজন পার্টনার পেলে জমিয়ে হোম-ডেলিভারির ব্যবসা স্টার্ট করব। ওই ফ্ল্যাটটা ওরকম ডিজাইনে বানিয়েছিওখানে কিচেন খুব বড়ো”।  

মুহূর্তে ভালো লাগা ছিঁড়ে গিয়েছিল শ্রুতির। হায়দরাবাদের চাকরি ছেড়ে এসে এখানে খাবারের ব্যবসা! এখানে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়তে আসছে সে! মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল, দেবার্ঘ্যর ওপরে ভয়ানক রাগ হচ্ছিল। এসব তাহলে প্রি-প্ল্যানড! হায়দরাবাদে দেখা করতে গিয়ে একবারও প্রকাশ করেনি। বলেছিল,

তুমি যা ঠিক ভাববে তাই হবে”।

জানে না শ্রুতি, ভাবতেও পারছে না। একটিও বন্ধু নেই যাকে সবটুকু নিশ্চিন্তে বলা যায়। তার সহকর্মীদের দু-একজন কাউন্সেলিং করায়। নিজের গোপন বাক্স-পেঁটরা মেলে ধরতে হয় কাউন্সেলারের কাছে। সেখান থেকে পোকা খোঁজা হয়, বাছা হয়, মেরে ফেলা হয়। তাতে নাকি অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে ওরা।

কিন্তু শ্রুতি কি সজ্ঞানে পারবে নিজের সমস্ত টেনে ছড়িয়ে হাজির করতে?

যাওয়ার আগে কয়েকটি কম্পানিতে বায়োডেটা পাঠিয়েছিল। এখন ইন্টারভিউ কল আসছে। ব্যাঙ্গালোর-বেসড্, পুনে-বেসড্ কম্পানিপে-প্যাকেটও বেশী। বর্তমান কম্পানি তাকে ছাঁটাই করেনি। সামান্য পার্সেন্ট স্যালারি বাড়িয়েছে। কলকাতায় অফিস পাড়ায় খোঁজ নিয়েছে, আশা দেয়নি কেউ। দু-একটা অফিসে অর্ধেক বা আরও কম অফার দিয়েছে। তাও বলেছে, মাসখানেক লাগবে ফাইন্যালি জানাতে।

পি-জি-মালিক আগামী মাস থেকে ভাড়া বাড়ানোর লিখিত নোটিস দিয়েছে। আপাতত সে সম্মত হয়েছে, না হলে অন্য পি-জি খুঁজতে হবে। এত চাপ আর নিতে পারছে না।

কেন সে চাকরি ছেড়ে কলকাতায় যাবে? কার জন্য! মুক্ত স্বাধীন এই জীবনকোনও বিশেষ দায় নেই, আপোষ নেই। একা থাকলে আজকাল দেবার্ঘ্যর কথা খুব মনে পড়ে। দেবার্ঘ্যর স্বর, তার শরীরের গন্ধ, মাথার চুল তাকে ছুঁয়ে থাকে। পাগল-পাগল লাগে। প্রায় তেত্রিশ বছর বয়স পেরিয়েছে। দেবার্ঘ্য নামের ছেলেটির পরশপাথরে তার শরীরের ঘুমন্ত চাহিদা ইদানিং সজাগ। বিয়ে-ফুলশয্যা-সন্তানঅবচেতনে সারসার স্বপ্নের মতো ভেসে ওঠে। নিজের অঙ্গ স্পর্শ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু দেবার্ঘ্যকে সে ভালোবেসেছে কি?

দেবার্ঘ্য তো একবারও নিজের অবস্থান থেকে সরার কথা উল্লেখ করেনা! তার নিশ্চিন্ত সরকারি চাকরি বলে? তাতে কী! সে-ও তো শ্রুতির কাছে আসার চেষ্টা করতে পারে। তারপর যৌথযাত্রা!

সে ভেবে পায় থই না। কার জন্য নিজের উঠতি কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে কলকাতা ফিরে যাবে? ওখানে গিয়ে ছোটখাট কোনও চাকরি, সঙ্গে দেবার্ঘ্যর মা-র সঙ্গে হোম ডেলিভারির ব্যবসা? নীট প্রাপ্তি এক নিটোল নিরুপদ্রব সংসার! এই ভবিষ্যৎ?

নিজের সঙ্গে তর্ক করে করে শ্রান্ত হয়ে পড়ে শ্রুতি। এমন অদ্ভুত জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়নি আগে। লিপিকাকে ফোন করার কথা ভাবে। মাসি তাকে চাকরি না ছাড়ার পরামর্শই দেবেন। তারপর মনে হয়, বাবুলকে ফোন করে দেখা যেতে পারে। বাবুলের প্রতি নরম জায়গা এখনও আছে। নিজের মনের মধ্যে চেয়ে দেখে সে, পরিষ্কার। বাবুল তার সমবয়সী তুতোভাই, শৈশবের খেলার সাথী, এর বেশী কিছু নয়। আগেকার রাগ, হিংসের জ্বলন, গোপন আকর্ষণ কবেই ধুয়ে-মুছে গেছে।

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন