পরিবার ধর্ষণ ও বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত
তখন
প্রায় পৃথিবীর সব দেশে ও সব সমাজেই বিজ্ঞানের চাইতে দর্শনই জ্ঞানবিজ্ঞানের ও সামাজিক
ও বাস্তবিক ব্যক্তিজীবনের সর্বোচ্চ নিয়ন্তার ভূমিকা পালন করত। তখন দর্শনের ওপর ধর্মের
জাল বিস্তার এখনকার তুলনায় অনেক অনেক বেশিই ছিল, সন্দেহ নেই। তবু সেইরকম একটা সময়ে
বস্তুবাদী দর্শনের অস্তিত্ব ভারতের মত অন্যান্য দেশীয় সমাজেও অল্প বিস্তর কোথাও কোথাও মানুষের ভাবনা চিন্তার
আনাচে কানাচে কোথাও একটা ছিল বলে অনুমান করে নিলেও এটুকু স্পষ্টতই বুঝে নিতে কিছু অসুবিধে
হওয়ার কথা নয় যে সেটা ছিল মূলত গুটিকয় মানুষেরই চিন্তাভাবনার উপাদান। সমাজের বৃহৎ বৃহত্তর
অংশের চিন্তাপ্রকৃয়া পরিচালিত হোত ও আজও হয় ভাববাদী দর্শনের দেখানো পথেই। তাই তখনকার
দিনে, এমনকি এখনকার দিনেও পরজন্মের বেড়ি ব্যাপারটা খুবই সংক্রামক যে ছিল এবং আছে সে
ব্যাপারে সত্যিই কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক অনুশাসন ও নিয়মগুলো
যে ‘পরজন্ম’ নামক ধ্যানধারনাগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হোত এবং হয় এবং হয়ে চলবে নিকট ভবিষ্যতেও
তা নিয়ে কোথাও কোনও রকম সন্দেহের অবকাশ নেই বা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে এই ধরনের
নিয়ন্ত্রনের ফলে যারা যারা বা যে সমস্ত আমআদমি নারী পুরুষরা ভেবে নিচ্ছেন ‘বিবাহ জন্মজন্মান্তরের বন্ধন’ তারা বাস্তবিকই যে বাস্তবের মাটিতে পা রেখে
চলেন না এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই সমস্ত নারী পুরুষের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই যে
বেশি তার একটা বড় কারণ হল তাদের সামাজিকীকরণের পথটা পুরুষের তুলনায় একেবারেই আলাদা
শুধু নয়, তাদের স্বাধীন চিন্তা ভাবনার ক্ষমতাও পুরুষদের তুলনায় কম এবং সেটাও ওই সামাজিকীকরণের
কারণেই। ভাববাদী চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত হলেও সময় ও যুগের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ
ও পৃথিবীর নানা বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশির ভাগ পুরুষই এবং কিছু সংখ্যক নারীও
বিবাহ ব্যাপারটাকে আর আগেকার মত অমোঘ বন্ধন বা ঈশ্বরের বিধান হিসেবে দেখে না। এর ফলাফল
হিসেবে তারা বিবাহটাকে অপরিবর্তনীয় রেখে জীবনের ওই একই পরিসরের মধ্যেই অন্য নারী বা
পুরুষে গমণ করেন অবলীলায়। বলা বাহুল্য সেটা বাস্তব ও জান্তব শারীরী সুখ ভোগের জন্যেই
যে এতে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু
আমি এই বিষয়টাকে নিয়ে এখনই আমার কোনও বক্তব্য পেশ করছি না। আমার বলবার বিষয় হল যে বিবাহের মাহাত্মলীলায় অভিভূত হয়ে নারী ও পুরুষের এই যে বন্ধন,
সেই বন্ধন কতটা আত্মিক আর কতটা সামাজিক অনুশাসনবাহী সেটা একটু কাটাছেঁড়া করে দেখবার
প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়। কেননা এর ফলাফল থেকেই বেড়িয়ে আসতে পারবে অনেক সত্য তথ্য
যেগুলো মানুষের মূখোসের আড়ালে বিভিন্নভাবে লুকিয়ে থাকে।
সাধারণত
মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা অনেক বেশি বাস্তববাদী হয় এবং সেটা তাদের সামাজিক পার্থক্যের
কারণেই। সমাজের চোখ রাঙানির ভয়ে নারীদের স্বাধীন চিন্তা ও সেই অনুযায়ী স্বাধীন কর্মপদ্ধতি
ও তার অভিলাস অনেকটাই ব্যাহত হয়। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে সব ব্যাপারেই সামাজিক অনুশাসনগুলো
অনেকখানিই শিথিল। আর যেসব ক্ষেত্রে শিথিল নয়, হয়ত বা খানিকটা কড়াকড়িও, সেসব ক্ষেত্রে
পুরুষরা ওসব অনুশাসনগুলোকে খুব একটা পাত্তা দিয়ে চলে না। এটা তাদের বেপরোয়া স্বভাবের জন্যই এরকমটা হয়। যাই হোক, আসল
মোদ্দা কথাটা আমি যেটা বলতে চাইছি, সেটা হল ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটাকে ঘিরে যেসব
চিরাচরিত অনুশাসনগুলো আছে সেগুলোকে প্রায় বেশিরভাগ পুরুষই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে। মানসিকভাবে তাদের চিন্তাচেতনায় কোনও বেড়ি পরানো
সম্ভব কোনদিন কোনকালেই হয় নি এখনও পর্যন্ত সেটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কারণেই হোক বা
আদিম জীবনযাপনের সময়ই ঘটে যাওয়া শ্রমবিভাজনের কারণে উদ্ভূত বিবর্তনের ফলাফল হিসেবে
জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে হোক।
বৈবাহিক
সম্পর্ককে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক ভাবার জন্য যে সমস্ত কারণগুলো দায়ী তার মধ্যে প্রথমটি
হল প্রাকবৈবাহিক জীবনে বৈবাহিক জীবনের নিরন্তর শরীরী সুখভোগের অভাবের কারণে মানবশরীরের
পাঁচপাঁচটি সুখী হর্মোনের নিঃসরণ ব্যহত হয়, যার ফলে একজন নারী বা পুরুষকে যে সাংঘাতিক
চাপ ও উদ্বেগ উপশমের অভাবজনিত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, বিবাহ এই সমস্যা সমাধানের
গতিমুখ রাতারাতি একশ আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে দেয়। প্রযুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানশিক্ষিত, অবিজ্ঞানমনস্ক
এই সমাজের বেশির ভাগ নারী পুরুষই এই বাস্তব বৈজ্ঞানিক তথ্যটিকে তত আমল দিয়ে ভাবেন না।
যদি ভাবতেন তাহলে দেখতে পেতেন, আধুনিক সমাজে লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা যে কোনও নারীপুরুষ
বা জুটিই (সমকামী সম্পর্কের ক্ষেত্রে) প্রথম দিকে একেও অপরের প্রতি ওই একই রকম তদ্গত
প্রাণ হয়ে থাকেন এবং সেটা বলাবাহুল্য বিবাহের কারণে নয়। বরং জীবনের ওইরকম একটা বয়সে
সুখী হর্মোন নিঃসরণের প্রথম একটা নিশ্চিন্তিই এর জন্য বলা বাহুল্য দায়ী। কিন্তু আমাদের
একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে বিজ্ঞানমনস্কহীন এক একজন নারী বা পুরুষ অর্থাৎ যে কোনও ব্যক্তিমানুষই
সুখী হর্মোনের এমন প্রথম ও নিরন্তর নিঃসরণের ধাক্কায় এতটাই বিহবল ও অভিভূত হয়ে পড়েন
যে তাদের মনে হয় যে এ বুঝি বিবাহেরই মাহাত্ম এবং এ অবশ্যই জন্মজন্মান্তরের সম্পর্কের
মাহাত্মেই ঘটছে। এই ভুল ভাবনা চিন্তার পদ্ধতিটাই যে আসলে শ্রেণী শোষণ ও শোষন কৌশলকে
জিইয়ে রাখছে, এত ভাবনাচিন্তার মাথা ব্যাথা বলাবাহুল্য এদের প্রায় কারুরই নেই। তবে ধর্ষণ
বা পিতৃতন্ত্র অথবা মাতৃতন্ত্রজনীত যে কোনও সামাজিক শোষণই এই বিজ্ঞাননির্ভরতাহীন মানবসমাজে
বিজ্ঞাননির্ভরতাহীনতার কারণেই যে আসছে তা আমরা একটু চেষ্টা করলেই বুঝতে পারব। এ নিয়ে
বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ অবশ্যই আছে বলা বাহুল্য। তবে সেটা অবশ্যই এখানে নয়। অতএব পাঠক,
আপাতত এ আলোচনাটা মুলতুবি রাখা যাক।
যে
দুটো মানুষের বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে একটা বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তারা কি কোনওদিনও
একে অপরের আপনজন হয়ে উঠতে পারে? খুব ভালো করে বিভিন্ন সময়ের সাহিত্যিক ডকুমেন্টগুলো
খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনওদিনও হয় না। নারী পুরুষের
মানসিক মেলবন্ধন নব্বুই শতাংশ ক্ষেত্রেই থাকে একে অপরের থেকে যোজন যোজন দূরত্বে। তার
ওপরে যে নারীর জন্মই তার পরের ঘরে যাবার জন্য, নিজের বাবা মার ঘর কোনওদিনই তার নিজের
নয়, সেই নারীকে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও নিজের রক্তের সম্পর্কের সমস্ত কিছুকে ছেড়ে হঠাৎ
করে এই যে বিবাহ সূত্রে একটা অজানা, অচেনা পরিবারে গিয়ে উঠতে হয় এবং সেখানকার মানুষগুলোকেই
তার আপনজন ভেবে তাদের জন্য নিরন্তর জীবনপাত করে সেবা করে যেতে হয় এবং পান থেকে চুনটা
খসলেই তাকে যে নাকানিচোবানি খাওয়ানোর এই ব্যবস্থা, এর চাইতে অমানবিক কোনওকিছু মানবসভ্যতায়
আর বোধহয় কোথাও কোনওকিছু নেই। সে যেখানে জন্মেছে, বড় হয়েছে, তারা কেউ তার আপন নয়। আবার
বিয়ে করে সে যেখানে আসছে সেই পরের ঘরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার নিজের হয়ে ওঠে না তেমন
করে। শুধু সন্তান জন্ম দিলে সেই সন্তানের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কের কারণে শুধু তারাই
তার পরম আত্মীয় হয়ে ওঠে।
গোটা
একটা জীবন একজন মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার এমন অভূতপূর্ব চোরা কৌশল মানবসম্পদের
ভয়ংকর অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মানবতার চরম অবমাননাও বটে। প্রকৃতপক্ষে নারীর দেশ, গাঁ,
ভিটে মাটি বলে কিছু হয় না। নারী হচ্ছে জন্ম উদ্বাস্তু। তার কোনটা আপন আর কোনটা পর তা
সে নিজেই জানে না। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আর অনুশাসনের দোহাই দিয়ে নারীদের গোটা জীবনটাই
প্রকৃতপ্রস্তাবে তাদের কাছ থেকে যে ছিনতাই করে নেওয়া হয়, সেটা আজকের নারীরা আর মানতে
চাইছে না। এখনকার নারীরা তাই প্রশ্ন তুলছে, ’কেন অন্যের মা বাবাকে আমাকে মা, বাবা বলতে
হবে? কেন বলব? কেন আমি অন্যের বাড়িতে গিয়ে
থাকব?’ ইত্যাদি। আজকের নারীদের এইসব প্রশ্নে পূর্বনারীরা বিস্মিত, স্তম্ভিত হচ্ছে আর
বলছে, ’এ আবার কেমন কথা! এটাই তো চিরকালের নিয়ম!’ পূর্বনারীদের এ হেন বিস্ময় আসলে পিতৃতন্ত্রেরই
এক গোছানো কৌশল। কেননা তারা নারীর ওপরেই সন্তান প্রতিপালনের সমস্ত দায়দায়িত্বটা দিয়ে
নিশ্চিন্তে নিজেরা আয়েস করে থাকে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন