সিনেমার পৃথিবী – ৩২
প্রথিবীর প্রায় বেশির ভাগ জায়গার ছবি আমরা এ পর্যন্ত আমাদের আলোচনায় এনেছি। আজ আর মাত্র দুটো দেশ নিয়ে আমাদের কাটাছেঁড়া। প্রথম দেশ, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত ইজরায়েল। যার প্রতিবেশী দেশগুলো হল লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন ও প্যালেস্টাইন। সত্যি বলছি, আমার এই দেশটাকে একদম পছন্দ নয়। ভীষন যুদ্ধবাজ, ইহুদিদের জায়গা এবং জেরুজালেম এখানে অবস্থিত বলে এদের নাক খুব উঁচু। বাকিদের মানুষ বলে মনে করে না। কিন্তু সিনেমার জগতে ইজরায়েলের অবদান বেশ খানিকটা। সেটা অস্বীকার করলে ইতিহাস অস্বীকার করা হয়। তাই আজ ইজরায়েলকে নিয়ে আলোচনা। এবং আরেক দেশ হল কানাডা। আমেরিকার উত্তরে। ভারতবর্ষের ছেলেমেয়েদের পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপে যাবার খুব পছন্দসই জায়গা।
১৯৪৮ সালে ইজরায়েলের সিনেমা শুরু হবার পর থেকে হিব্রু ভাষায় (এবং আরবি বা ইংরাজি ভাষাতেও) একে একে ভাল সিনেমা তৈরি হতে থাকে। বিশেষ করে ষাটের দশকের তিন বিখ্যাত পরিচালক, এফ্রাইম কিশন, মেনাহেম গোলান ও উরি জোহার, ইজরায়েলের সিনেমাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। এবং এই দেশ এখনো অব্ধি মধ্য-প্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর তুলনায় সবথেকে বেশিবার অস্কার নমিনেশন পেয়েছে। ২০১১ সালে ছোট ডকু ফিল্ম ‘স্ট্রেঞ্জারস নো মোর’ বাইরে থেকে ইজরায়েলে পড়তে আসা বাচ্চাদের কঠিন লড়াই তুলে ধরে অস্কার পেয়েছে। আমার হিসেবে, এখানকার কিছু পূর্ণদৈর্ঘ্য উল্লেখযোগ্য ছবি হল - সালেহ্ (১৯৬৪), দ্য পুলিসম্যান (১৯৭০), আই লাভ ইউ রোজা (১৯৭২), এশার (১৯৮৬), আন্ডার দ্য ডোমিম ট্রি (১৯৯৫), ক্যাম্পফায়ার (২০০৪), নুডল্ (২০০৭), ওয়ালজ উইথ বশির (২০০৮), আজামি (২০০৯), লেবানন (২০০৯), গেটঃ দ্য ট্রায়াল অব ভিভিয়ান অ্যামসালেম (২০১৪), দ্য কেকমেকার (২০১৭)।
আজ আলোচনা করব এফ্রাইম কিশনের ‘সালেহ্’ বা সালেহ্ সাবাতি নিয়ে। অনবদ্য স্যাটায়ার। হিব্রু উদ্বাস্তুদের সমস্যা ইজরায়েলে এক সময় ঠিক কি রকম ছিল, এই সিনেমা তার দলিল। এবং কিশনের প্রতি আমার আকর্ষণ আরো এক কারণে। উনি প্রাথমিকভাবে একজন লেখক। লেখালেখি করে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। এমনকি পুরস্কার পেয়েছেন সাংবাদিকতার জন্যও।
সালেহ্ সাবাতি নামক এক হিব্রু ইয়েমেন থেকে তার সাতবাচ্চা ও গর্ভবতী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ইজরায়েলে উদ্বাস্তু হিসেবে আসে এবং তাদের স্থান হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। সেখানে তাদের ভাগ্যে জোটে এক স্যাঁতস্যাঁতে এক-কামরার ভাঙা ঘর। সালেহ্ আশা করে কিছুদিনের ভেতরেই তারা সরকারী উদ্বাস্তু হাউজিং-এর পাকা ঘরে চলে যেতে পারবে, কিন্তু সেখানে যাবার জন্য কিছু টাকা লাগবে এবং সেই টাকা জোগাড় করার জন্য সালেহ্ বিভিন্ন প্লট ভাঁজতে সুরু করে যা সেই সময়ের ইজরায়েলের রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাঙ্গচিত্র তুলে ধরে। কিছুদিন পর সে বোঝে, সেই উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে হাউজিং-এ যাওয়া খুব কঠিন। কেউ কেউ উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ছ’বছর কাটিয়ে ফেলেছে কিন্তু তাদের জীবনে কিছুই ঘটেনি। সে বুদ্ধি ভাঁজে এবং সরকারি হাউজিং অফিসের সামনে অনেককে সঙ্গে নিয়ে হোর্ডিং সহ স্লোগান দিতে থাকেঃ আমাদের উন্নয়ন চাই না, আমরা উদ্বাস্তু ক্যাম্পেই থাকতে চাই। এর ফল হয় মারাত্মক। সরকার ও পুলিশ সক্রিয় হয়ে একে একে উদ্বাস্তু পরিবারদের রিফিউজি ক্যাম্প থেকে তাড়িয়ে জোর করে সেই হাউজিং-এ ঢুকিয়ে দেয়।এই ছবি কিশনকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ইজরায়েলকে এনে দিয়েছিল প্রথম অস্কার নমিনেটেড সিনেমা। বিদ্রুপ যে এরকম চাবুক হতে পারে, সেটা কিশন প্রথম দেখিয়েছিলেন। এমনকি নামেও। সালেহ্ সাবাতি-র হিব্রু ভাষায় আক্ষরিক অর্থ হল ‘ক্ষমা করবেন, আমি এসেছি’। সালেহ্র ভূমিকায় টোপোলের অভিনয় যথাযথ। ভাল লাগে গিলা আলমাগোরের ডেবিউ অভিনয় (পরবর্তীকালে উনি ইজরায়েলি ছবির প্রধান নায়িকা হয়ে উঠেছিলেন)। তবে হ্যাঁ, ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের এই সিনেমায় ক্যামেরার কাজ মোটেও আহামরি নয়। কিছু লং শট ছাড়া। বরং এই ছবির প্রধান শক্তি হল এর সংলাপ।
আরেক ছবির কথা উল্লেখ না করলে সেই ছবির সঙ্গে বেইমানি হবে। এবং কেন আমি ইজরায়েলি ছবির প্রতি আকৃষ্ট হলাম, সেটাও অজানা থেকে যাবে। আরি ফোলম্যানের অ্যানিমেশন ডকু সিনেমা ‘ওয়ালজ উইথ বশির’। ১৯৮২ সালে ইজরায়েল লেবাননের যুদ্ধ কিভাবে সাধারন মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছিল, সেটা জানতে হলে দেড় ঘন্টার এই ছবি দেখতে হবে। এক ইনফ্যান্ট্রি সৈনিক, যে সেই যুদ্ধের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে, তার বন্ধুদের থেকে জানছে ঠিক কি হয়েছিল সেই যুদ্ধে। অদ্ভুত স্টাইল, অনবদ্য ন্যারেশন। এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৮। আমি সে বছরই গুয়াহাটি বসে এই ছবি দেখেছিলাম। এই ছবি দেখার পর কেউ যদি ‘লেবানন’ (২০০৯) দেখেন, আপনারা প্রাসঙ্গিকতা আরো ভাল বুঝতে পারবেন।বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা প্রথমে ছিল বৃটিশ শাসিত উত্তর আমেরিকার অন্তর্গত। পরে ১৮৬৭ সালে এটি স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। এবং ১৯৮২ সালে দেশের সংবিধান তৈরি হবার পর এটি পূর্ণ গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রধান ভাষা ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ। এটা ঠিক যে বছরের প্রায় ৮ মাস কানাডা তুষারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে, জলবায়ুর জন্য এই দেশ প্রায় রাশিয়ার মতই। কিন্তু এখানে পার ক্যাপিটা ইনকাম এত বেশি যে শিক্ষিত বেকার প্রায় নেই বললেই চলে। তাই আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও চাকরির জন্য এক লোভনীয় গন্তব্য হল কানাডা। এবং এখানকার প্রধান তিন শহর টরান্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভ্যাঙ্কুবার খুবই উন্নত এবং প্রায় সমস্ত সুবিধাযুক্ত হবার জন্য এই তিন শহরে পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নতশীল দেশের লোকেরা পাড়ি জমায়। যাইহোক, কানাডার ছবির ইতিহাস সেই ১৮৯৬ থেকে শুরু। হলিউড সেই সময় থেকেই কানাডাকে ব্যবহার করত বিভিন্ন ছবির শুটিং স্পট হিসেবে। অন্য এক কারনও ছিল। কানাডাকে ব্যবহার করলে ব্রিটিশ ছবির আইনকানুন এড়িয়ে যাওয়া যেত। চল্লিশের দশকে ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অব কানাডা তৈরি হবার পর কানাডায় নিজস্ব ছবি তৈরির, বিশেষ করে এক্সপেরিমেন্টাল ছবি তৈরির সংখ্যা বেড়ে যায়। এবং ষাটের দশক থেকে কানাডার সিনেমা পৃথিবীর মূল ধারায় প্রবেশ করে।
কানাডার উল্লেখযোগ্য ছবির ভেতর আমি যেগুলো দেখেছি - গোয়িং ডাউন দ্য রোড (১৯৭০), মাই আঙ্কল অ্যান্টোইন (১৯৭১), অর্ডারস্ (১৯৭৪), জেসাস অব মন্ট্রিয়ল (১৯৮৯), লিওলো (১৯৯২), দ্য সুইট হেয়ার-আফটার (১৯৯৭), আটানার্জুয়াটঃ দ্য ফাস্ট রানার (২০০১), ইনসেন্ডিজ (২০১১), মমি (২০১৪)। এছাড়াও ডকু ফিল্মের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচার্ড ল্যান্ডস্কেপস্ (২০০৬) এবং এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা বললে ওয়েভলেন্থ (১৯৬৭), সেইলবোট (১৯৬৭) ও হার্ট অব লন্ডন (১৯৬৮)।
এখানে আমরা অ্যাটম ইগয়ানের ‘দ্য সুইট হেয়ার-আফটার’ নিয়ে আলোচনা করব। ১১২ মিনিটের সিনেমা। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এক ছোট্ট শহরে এক স্কুলবাস বরফে পিছলে গিয়ে এক লেকের মধ্যে পড়ে যায়। ১৪ জন বাচ্চা মারা যায়। সেই সময় শোকে পাগল সেই ১৪ বাচ্চার বাবা-মা এবং বাস ড্রাইভারের কাছে এক ধান্দাবাজ উকিল মাইকেল গিয়ে বোঝাতে শুরু করে যে শহর কর্তৃপক্ষ এবং বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে তৎক্ষনাত এক বড় অঙ্কের মামলা রুজু করা উচিৎ। কারন শহর কর্তৃপক্ষ যদি লেকের ধারে এক মজবুত লোহার রেলিং দিত, তাহলে হয়ত এই দুর্ঘটনা ঘটত না। সেই উকিল গিয়ে বোঝায় স্যাম নামক এক ব্যক্তিকে, যার ১৫ বছরের মেয়ে নিকোল এই দুর্ঘটনার একমাত্র সাক্ষী। এই ঘটনায় সে বেঁচে ফিরলেও কোমর থেকে পঙ্গু হয়ে গেছে। তার সঙ্গীতচর্চার আশা পুরোপুরি শেষ। স্যাম ও মাইকেল নিকোলকে চাপ দিয়ে চলে। কিন্তু নিকোল কোর্টে গিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়। বলে, ড্রাইভার তাড়াতাড়ি চালানোর জন্যই এই দুর্ঘটনা। সবাই বোঝে নিকোল মিথ্যে বলছে। কিন্তু সে যে ঘৃনার বদলা ঘৃনা চায় না, সে আবার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি চায়, সেটাও সবাই বুঝে যায়। শহর ধীরে ধীরে আবার ছন্দে ফিরে আসে।এই ছবির ট্যাগলাইন ছিল ‘sometimes courage comes from the most surprising places’। কিন্তু আমি এর ভেতর এক বহুমাত্রিক ছবি দেখতে পেয়েছি। একদিকে ক্ষতি, অন্যদিকে কিছু সিক্রেট এবং মিথ্যের আশ্রয়, আবার অন্যদিকে প্যাশনেট। এবং সবার ওপরে হিউম্যান সাইকোলজি। লক্ষ্যনীয় বিষয় যে এখানে পরিচালক কিন্তু কোন প্রশ্ন বা আভাষ রাখেন নি। এক ড্রামা সিনেমা, যা আমাদের আত্মাকে নাড়িয়ে দেয়। এ সেই ছবি। নিকোল ঘুমোতে যাবার আগে তার ছোটবেলায় আবৃত্তি হয়ে চলা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা এই ছবির রূপককে আরো সজীব করে তুলেছে। ছবির মত ক্যাথারসিস। এবং আউটডোর শুটিং - লং শট, ক্লোজ শট, ফ্রিজিং শট। বেশ ভাল সিনেমাটোগ্রাফি। ইগয়ানের ক্যামেরায় আমি কিন্তু একটাই মানসিক ঘটনার ন্যারেশন নেভিগেশন দেখলাম। এবং সেটা সরাসরি নেভিগেশন নয়, ঘুরে ঘুরে, circumnavigation, বৃত্তাকারে, এসে যেন বারবার বলছে, শক্ত হও, জীবনে ফেরো। লালন ফকিরের গান মনে পড়ে গেল – ‘আয় চলে আয়/ দিন বয়ে যায়/ যাবি যদি নিত্য ভুবনে’।
কানাডার ছবি নিয়ে আমার কথা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অব কানাডা তৈরি হবার পর কানাডায় বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্টাল অ্যানিমেশন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আসল কাজ শুরু হয় ষাটের দশকে, যখন কয়েকজন চিত্রকর জ্যাক চেম্বার্স, মাইকেল স্নো ও জয়েস উইল্যান্ড ছবি বানাতে শুরু করেন এবং তাদের কাজের মধ্যে এক্সপেরিমেন্ট ঢোকাতে শুরু করেন। স্নো ও উইল্যান্ড তখন দম্পতি, তারা নিউ ইয়র্কে চিত্রকলা শিখছেন। আমি এই ধারাবাহিকের ১২ নং পর্বে মাইকেল স্নো-র ‘ওয়েভলেন্থ’ উল্লেখ করেছিলাম। স্ট্রাকচারাল ছবি হিসেবে। আজ এই সিনেমা একটু ছুঁয়ে যাব।
স্ট্রাকচারাল ফিল্ম বেশ সহজ একটা জিনিষ। এখানে সিনেমার ফর্মটাই আসল, কনটেন্ট নয়। এবং সহজ, আগে থেকে ঠিক করে রাখা ফর্ম নিয়েও কাজ করা চলে। ধরা যাক, ক্যামেরায় এক ফ্লিকার সাউন্ড বা ফ্লিকার ফ্রেম। অথবা লুপে ঘুরে চলা প্রিন্টিং। অথবা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রাখা ক্যামেরার অবস্থান। নির্দিষ্ট ফ্রেম। আর এই শেষ ব্যাপারটাই স্নো করে দেখিয়েছেন। তার ছবিতে কোন থিম নেই, প্লট নেই। কোন অ্যাকশন নেই। ক্যামেরা স্থির। শুধু চারটে চরিত্র ঘুরে বেরাচ্ছে। কেউ এসে বইয়ের তাক রেখে যাচ্ছে, কখনো মদ্যপান, একজনের মৃত্যু, আরেকজন এমারজেন্সি কল করছে। শেষে দূর থেকে পুলিসের সাইরেন। কিন্তু সাউন্ড প্রায় নেই বললেই চলে। মিনিমালিস্ট। তাহলে নাম ওয়েভলেন্থ কেন? কারন এর ব্যাস্তানুপাতিক হল ফ্রিকোয়েন্সি। অর্থাৎ টোন। সিনেমার শেষে সেই টোন যেভাবে খুশি পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। আর ক্যামেরা একটা স্থির জায়গা থেকে সেই ফ্ল্যাটের স্পেস আরো বিশ্লেষন করে চলেছে। মাত্র ৪৫ মিনিটের সিনেমা, কিন্তু সুযোগ পেলে দেখে নেবেন।
কিন্তু এই সফর এক্ষুনি শেষ করব না। আমাদের সফর শেষ করার আগে আরেক দেশ। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে এবং এশিয়া মহাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম দিকে এক আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্রের নাম ইজিপ্ট (মিশর)। ভুললে চলবে না, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এই দেশ প্রাচীন যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার পীঠস্থান ছিল। ইজিপ্ট নিয়ে অনেক অনেক ছবি তৈরি হয়েছে। যদিও আমার উদ্দেশ্য সেইসব ছবির কাটাছেঁড়া নয়। তাহলে তো প্রথমেই জুলিয়াস সিজার, ক্লিওপেট্রা এবং সেই চরিত্রে অনবদ্য লিজ টেলর, এদের নিয়ে বলতে হয়। কিন্তু আমি ইজিপ্টের নিজস্ব ছবি নিয়ে আলোচনায় উৎসাহিত। আমি দেখেছি, ইজিপ্টের এরকম কিছু ছবি হল - দ্য ফ্লার্টেশন অব গার্লস্ (১৯৪৯), কায়রো স্টেশন (১৯৫৮), দ্য নাইটিঙ্গেল’স প্রেয়ার (১৯৫৯), দ্য সিন (১৯৬৫), দ্য ল্যান্ড (১৯৬৯), নাইট অব কাউন্টিং দ্য ইয়ারস (১৯৬৯), দ্য বাস ড্রাইভার (১৯৮২), টেররিজম্ অ্যান্ড দ্য কাবাব (১৯৯২), দ্য য়াকোবিয়ান বিল্ডিং (২০০৬), এবং আসমা (২০১১)।
এর আগে আমরা কিছু পুরনো ছবি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেছি, সুতরাং এখন এক নতুন ছবি। অমর সালামা-র দেড় ঘন্টার ছবি ‘আসমা’। আসমা এক চরিত্র, এইডস আক্রান্ত। হয়ত এরকম চরিত্র আমাদের সমাজে অনেক লুকিয়ে আছে, আমাদের অজান্তে। এই সিনেমায় বছর চল্লিশের আসমা কায়রো এয়ারপোর্টে কাজ করে। স্বামী মারা যাবার পর একাই মেয়েকে বড় করে তুলছে। তার জেলফেরত স্বামী বেঁচে থাকাকালীন সে জানতে পারে স্বামীর এইডস হয়েছে। কিন্তু স্বামীর প্রতি ভালবাসায় এবং স্বামীর শেষ ইচ্ছেকে সন্মান জানাতে সে গর্ভবতী হয়। স্বামী মারা যায়, মেয়ে হয়। কিন্তু সে সমাজের কাছে, বন্ধু বান্ধবদের কাছে, নিজের মেয়ের কাছে এই রোগ জানাতে ভয় পায়। বেশ কিছু বছর। তার কষ্ট বেড়ে চলে। কিন্তু এবার তাকে একটা পথ বেছে নিতে হবে – সে এই রোগ সবার কাছে প্রকাশ করবে নাকি গোপনে ব্যাথা পেয়েই চলবে। কারণ এবার তাকে গলব্লাডার অপারেশন করাতে হবে। একদিকে সামাজিক, মনস্তাত্তিক সুইসাইড - অন্যদিকে ধীরে শারীরিক মৃত্যু। এই অবস্থায় তাকে এক টিভি শো-তে ডাকা হয়, তার শারীরিক সমস্যা জানানোর জন্য। কিভাবে তার এইডস হল, সেটা বলার জন্য। সে কি আদৌ যাবে?
আসমা চরিত্রে হেন্দ সাবরি অনবদ্য। সিনেমাটোগ্রাফিও বেশ ভাল। এবং জানলে অবাক হবেন, আসমা এক সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। এক মহিলা বিনা অপারেশনে গলব্লাডার ফেটে মারা যান কারন ডাক্তাররা তার এইডস ছিল বলে অপারেশন করেন নি। ভাবতে পারেন? তবে কি জানেন, আমার মনে হয়, আসমা ছবিটা শুধুমাত্র ইজিপ্টের জন্য নয়, ইজিপ্টের মহিলাদের জন্য নয়। আসমা সেইসব পেছিয়ে পড়া দেশের অভাগা মহিলাদের প্রতীক যারা রোজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক কিছু গোপন রাখতে বাধ্য হয়, নইলে প্রতিনিয়ত তাদের অনেক অসন্মানের মুখোমুখি হতে হয়। ফলে আমি আসমাকে নিছক এক সিনেমা হিসেবে দেখি না। আমার কাছে আসমার লড়াই যেন ‘love, courage, overcoming fear and fighting for personal rights’। এবং আসমা যেন আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমরা কবে একবিংশ শতাব্দীর কুসংস্কার মুক্ত মানুষ হব?
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন