ধারাবাহিক
উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(৯)
দিগন্তসেনার
নতুন রাষ্ট্রীয় ভবন উন্মোচন উপলক্ষে পৃথিবীর তাবড় তাবড় রাষ্ট্রপ্রধান আর সাংবাদিকদের
মাঝে দাঁড়িয়ে শ্যামাঙ্গীর মনে পড়ে যায় তার মা ও বাবার দ্বিতীয় শৈশবের নিত্য নৈমিত্তিক
নানা ঘটনার মধ্যে কয়েকটা দিনের কথা। অনঙ্গ আর মানময়ী দুজনেই শ্যামাঙ্গীর নতুন রাষ্ট
দেখার জন্য একদিন সুদামের সঙ্গে দিগন্তসেনায় এল। আর এসে সব দেখে শুনে আনন্দে আর বিস্ময়ে
একবারে বিহ্বল হয়ে যায়। এতসব কান্ড তদের মেয়ে করেছে ভেবে বার বার শ্যামাঙ্গীকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। সব কিছু নিজের চোখে চাক্ষুস দেখার
লোভে শিশুর মত দুজনে ভোরবেলা ঊঠে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে আর ফেরে সেই
গভীর রাতে যখন গভীর ঘুমে সবাই মগ্ন। শ্যামাঙ্গী একদিন মাঝরাতে এসে অবশ্য ওদের দেখতে
পায়, তবে সেটা ঘুমন্ত অবস্থায়, অচৈতন্যবৎ। হাত পা মাথা দুজনেরই কোন দিকবিদিক পরোয়া
না করে চারদিকে ছড়ানো। ফলে শ্যামাঙ্গী সেদিন একটু নিশ্চিন্ত হয় যে যেখানেই যাক, রাতে
ওরা বাড়ি ফেরে এবং রাতের ঘুমটা ওরা এ বাড়িতেই সারে। পরের দিনগুলোতে শ্যামাঙ্গী ওই সময়ের
এক ঘন্টা আগে ওদের দেখতে আসে আর দেখতে পায় ওরা প্রথম দিনের মত হাত পা চারদিকে না ছড়িয়ে
অত্যন্ত সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে যে যার জায়গায় ঘুমোচ্ছে। বিরক্ত না করে সে বেচারা চলে
যায় আর এদিকে ওরা চোখ পিটপিট করে যেমনি দেখে
শ্যামাঙ্গী চলে গেছে, তেমনি ওরা আবার তাকায়,
ভাবে সেদিনের মত ওরা ওর বকাঝকার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেল। এইভাবে ওদের দিগন্তসেনা ভ্রমণ
ও নানারকম জিনিস আবিষ্কার চলতেই থাকে যাকে বলে
একেবারে চুটিয়ে। পরিস্থিতি এমনই হয় যে কয়েকমাসের মধ্যে ওরা দুপক্ষ মুখোমুখি
হতে পারে না সজ্ঞানে। একদিন রাত তিনটে থেকে মশার কামড় খেতে খেতে সদরদরজায় হত্যে দিয়ে
পড়ে থাকে শ্যামাঙ্গী ওদের ধরার জন্য আর ওরা যখন বেরাতে গিয়ে ওদের দেখে ফেলে, তখন পেছনের
দিকের ঝোপঝাড় পেরিয়ে পাঁচিল টপকে ওরা নিজেদের স্বাধীনতা ও মুক্তি বিষয়ে পরস্পর পরস্পরের
কাছে এক এক করে দুজনে দুদফা লেকচার দেয় আর তারপরই শুরু হয় ওদের যাত্রা। এরপর শ্যামাঙ্গী
তার যাবতীয় কাজকর্ম লাটে তুলে দিয়ে সারা দিন
ধরে ঘুমোতে থাকে আর রাত এগারটা থেকে জেগে বসে লক্ষ রাখতে থাকে কখন ওরা ফিরবে সেই জন্যে।
কিছুক্ষণ বাদে ওরা ফেরে এবং আবিষ্কার করে কোন এক অজানা কারণবশত শ্যামাঙ্গী এখনও জেগে
সারা বাড়ি টহল দিচ্ছে। ওরা পাঁচিলের বাইরেই
থাকে। অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে গিয়ে শ্যামাঙ্গী নিজের ঘরে চলে গেলে ওরা দিব্যি ঢূকে খেয়ে
দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে এবং শ্যামাঙ্গী ফিরে এসে ওদের আবিষ্কার করে মাথায় হাত দিয়ে নিজের ঘরে
গিয়ে বসে পড়ে। পরের দিন ও আর সরাসরি জেগে না
থেকে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে আর ওরা বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে যেমনি শুতে যাবে, শ্যামাঙ্গী
এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। এবার ওদের চোখ ছানাবড়া। কিছু বলার আগেই অনঙ্গ জানায় যে শ্যামাঙ্গী
ওদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। ও জানতে চায় কীভাবে, তাতে ওরা উত্তর দেয় এই যে এখন
ও এসেছে নিশ্চয় ওদের কিছু বলার জন্য, তখন শ্যামাঙ্গী জানতে চায় কী ব্যাপারে, তখন অনঙ্গ বলে ওদের ঘোরার ব্যাপারে।
শ্যামাঙ্গী অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে জানায় যে সেটা একেবারেই একটা ভুল ধারণা। বরং ও ওদের
এই কথাই জানাতে চায় যে ওরা যতক্ষণ যেখানে যেতে চায় সেখানেই ঘুরে বেড়াতে যাতে পারে,
তার জন্য ও একটা গাড়ি আর প্রচুর পরিমানে টাকার ব্যবস্থা করেছে। কথাটা বলেই ও চলে যায়।
কারণ ওর মনে হচ্ছিল যে কোন সময় ও হেসে ফেলবে।
পরের দিন থেকে ওরা নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে। ফলে ওদের বেড়ানো আর কেনাকাটা
আনন্দেই চলতে থাকে। এদিকে ড্রাইভারের মুখ থেকে ওদের খবরাখবর পাওয়ার ফলে শ্যামাঙ্গী
কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজকর্মে মন দিতে পারে।
এদিকে
মূল ভূখন্ডে গত কয়েক বছরে ধর্ষণজনিত খুন এবং তার সাজা স্বরূপ আরও পাঁচ সাত গুণ রাষ্ট্রীয়
ও সামাজিক মদতে যে খুন হয়েছে, তাতে করে ব্যাপক পরিমান জনসংখ্যা কমে গেছে। গ্রাম ও শহরগুলো
প্রায় খালি হয়ে গেছে বললেই চলে। তবু এখনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। এখন খুব পরিষ্কার করে ধরা পড়ে যাচ্ছে
নেতা, মন্ত্রীরাও এর সঙ্গে যুক্তই শুধু নয়। নেতা হবার সুবাদে তারা সাজার হাত থেকে দিব্যি
ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে এখনকার পরিস্থিতি আগের চেয়েও আরও ভয়াবহ হয়ে গেছে। অলঙ্কৃতা রাজনৈতিক
সংশ্রব বাতিল করে দিয়ে চাঁদের ঢেউ অঞ্চলে একটা নতুন স্কুল করেছে আর সেখানে বিনা পারিশ্রমিকে সবাইকে পড়াতে শুরু করেছে। ওর স্কুলে
মুলত ইন্ডিয়ানরাই পড়তে আসে। তীর্থসরোবর অঞ্চলে সঙ্গীত সম্মেলন শিকেয় ঊঠে গিয়ে সেখানে
মন্ত্রীদের বক্তৃতার কারখানা হয়েছে। সকলেই এসে নিজের জন্য অনেকগুলো করে বক্তৃতার ফরমায়েস
করতে শুরু করেছে আর কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য উচ্চমার্গের দর্শনের সঙ্গে সামাজিক
নানা বিষয়ে স্বতন্ত্র নৈপুণ্যের একটা করে ঘ্যাট
তৈরী করে দিতে থাকে যার কোনটাই অন্য কোনটার সঙ্গে কোনভাবেই সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। কেননা
ততদিনে একথা ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল কোনরকম পড়াশোনা জানা ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা মন্ত্রী হবার
যোগ্য নয়। আর সেই জন্যেই নির্বাচনে দাঁড়াবার জন্যে ওই ধরনের বিন্দুমাত্র যোগ্যতা থাকাও
নির্বাচনের পক্ষে অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। নির্বাচনকে আরও বেশী সার্বজনীন স্তরে
নিয়ে আসার জন্য মোটামুটি কথা বলতে জানা ষণ্ডাগণ্ডা লোকজনেরাই সবচেয়ে বেশি বেশি যোগ্য
বলে বিবেচ্য। এই জন্যেই আশেপাশের সব অঞ্চলেই
একটা করে এই রকম কারখানা গড়ে উঠেছে। শ্যামাঙ্গীকে বিভিন্ন অঞ্চলেই অনুষ্ষ্ঠানে ডাকা
হয় উদবোধন বা প্রধান অতিথি হিসেবে আর সেই সুযোগে শ্যামাঙ্গীও জানায় মেয়েদের ছেলে হবার বা ছেলেদের মেয়ে হবার অথবা দুধরনের
লিঙ্গের মধ্যে প্রতিয্যোগিতা উস্কে দেবার কোন প্রয়োজন নেই। সকলেই যেন এ ব্যাপার থেকে
নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর অনেক ছেলেরাই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে
বলে যে গোটা দেশে যে হারে ধর্ষণ হচ্ছে, তাতে করে তারা নিজেরাই ছেলে হয়ে জন্মেছে বলে
খুব লজ্জিত বোধ করে। শ্যামাঙ্গী তাদের প্রত্যেককেই ভালো ভাবে নজর করে আর বলে যে এর
জন্য ওর রাষ্ট্রে একটা বিশেষ শিক্ষাশিবির খোলা হয়েছে, চাইলে তারা সেখানে আসতে পারে।
কিন্তু দেশের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু বলে যাচ্ছেন যে ছেলেরা মেয়েদের দমিয়ে রাখার
অস্ত্র হিসেবেই এই কান্ডগুলো ঘটাচ্ছে এবং এর জন্য এই সিস্টেমটাই দায়ী তাই সংবাদ মাধ্যমগুলো
এ ব্যাপারে তার মতামত জানতে এগিয়ে আসে। শ্যামাঙ্গী তাদের স্পষ্ট জানায় যে ছেলেরা এ
ব্যাপারে একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা এবং মেয়েরাই সবাই এর জন্য দায়ী শুধু নয়, তাদের এভাবে
বাইরে বেরিয়ে ছেলেদের একাধিপত্যে ভাগ না বসিয়ে গর্তে ঢুকে বসে থাকাটাই শুধু উচিত নয়,
সরকারের উচিত গোটা দেশ ব্যাপী নানা জায়গায় পর্বতশ্রেণী গড়ে তুলে সেগুলোর মধ্যে মেয়েদের
বসবাসের জন্যে একাধিক সুড়ঙ্গ বা গুহা নির্মাণ
করে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা যখন বলে যে শ্যামাঙ্গীর কথা এবং কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে
পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সে বলে কথা এবং কাজের মধ্যে সংগতিহীনতাই সবচেয়ে বড় ও উঁচুমানের
সঙ্গতিপূর্ণতা।
গথিক
আর্যদের পাড়ায় ঠিক এই রকমই একটা সময় বেড়াচাপা পল্লীর উদ্ভব হয় যেখানে বাহান্ন জন রমণীয়
রমণী থাকে এবং দিন আর রাত মোট চব্বিশ ঘণ্টা
জুড়েই প্রচুর পরিমানে পুরুষ শুধু আসাযাওয়াই যে করে তাই নয়, সবসময়েই বাড়িটার অসংখ্য
জানলায় একটি দুটি করে সেইসব মেয়েদের বেশিরভাগ
বসে থাকে আর খদ্দেরদের ডাকতে থাকে রাস্তা দিয়ে যাওয়া কিশোর থেকে বুড়ো সমস্ত পুরুষকেই।
এদের মধ্যে অবশ্য কিশোররাই সবার আগে গিয়ে জমা হয় আর একবার টাকা দিয়ে চার পাঁচবার করে
যেতে থাকে। ঠিক সেই সময়ই সমাজতত্ত্ববিদ শ্রাবণ বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং ঘটনাটা
জানতে পেরে দূর থেকে নজরদারির একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে ফেলে অনঙ্গর বাড়ির ছাদের
ওপর টাওয়ার বসিয়ে আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ও এই বিষয়ের কিছু সুদক্ষ
লোকজনদের নিয়োগ করে। আর তার ভিত্তিতেই সে একটা সময়সারণিও তৈরী করে ফেলে যাতে জানা যায়
বার তের বছরের ছেলেরাই সবচেয়ে বেশি ঐ অঞ্চলে
যাতায়াত করে সাধারণত শিক্ষালয়ে যাবার কিম্বা ফেরার পথে। অবশ্য কেউ কেউ শিক্ষায়তনে না
গিয়ে সে সময়টা ওখানেই কাটিয়ে দেয় কেননা পরে বেশি ভীড় হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায়। ব্যবস্থাটা
এভাবে চলতেই থাকে এবং মাত্র ক’বছরের মধ্যেই
ওদের এই ব্যবস্থাটা থেকে এতটাই মুনাফা ওঠে যে ওই অঞ্চলে বড়সড় একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলে
যেটাতে সতেরশ আশিটা ঘর ও লাগোয়া বাথরুম থাকে এক একটা তলে আর গোটা বাড়িতে সর্ব মোট এগারটা
তলা থাকে। ফলে আরও অনেক অনেক নতুন মেয়েদের আমদানি হয় যারা মান ও নৈপুণ্যের দিক থেকে
প্রখর মনোরঞ্জক। বাড়িটা সারাদিনই রকমারী লোকজনে ঠাসা আর হৈহট্টগোলে ভরপুর থাকে। স্বাধীনতা
দিবসের কমাস আগেই ওদের তরফ থেকে এক প্রতিনিধি দল মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরে গিয়ে জানায়
যে তারা বাড়িটাতে সরকারি শীলমোহর লাগাতে চায়। সব কিছু জেনে, শুনে, বুঝে ওখান থেকে ওদের
প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হলে ওরা সেখানে গিয়েও ওই একই কথা জানায়। কিন্তু
সেখান থেকে ওদের জানানো হয় এখন পর্যন্ত এই ধরনের কোন বাড়িতে সরকারি শীলমোহর দাগা হয়নি। কেননা সেটা সমাজ ও সভ্যতার প্রথা
ও আইন বিরোধীই শুধু নয়, দেশের সংবিধানেরও বিরোধী। কথাটা শুনে ওরা তখনকার মত চলে গেলেও
শেষ অব্দি কিন্তু এটা নিয়ে বেশ জলঘোলা হল। বাড়িটার সব মেয়েগুলো মিলে একটা প্রতিবাদ
সভা ও তারপরে একটা মিছিল করে গোটা অঞ্চল ঘুরে বেড়া্য। গণমাধ্যমে এসব নিয়ে বিস্তর চর্চা
যে হল তাইই নয়, কেউ কেউ এমন প্রস্তাব করল যে ওদের সরকারি শীলমোহর দেওয়াটা দেশের সরকারের
কর্তব্য ছিল। সমাজতত্ত্ববিদ হিসেবে শ্রাবণ সেটাতে আংশিক সম্মতি জানিয়ে যে প্রতিবেদন
প্রথমে সংক্ষিপ্ত আকারে ও পরে বৃহত্তর ভাবে প্রকাশ করে তাতে দেখা গেল সমাজের গঠন ও
চাহিদার মধ্যে বিস্তর চাহিদা যে রয়েছে সেটা রীতিমত তথ্য প্রমাণ দিয়েই সে প্রমাণ করে
ছেড়েছে।
বিষয়টা
শ্যামাঙ্গীর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ বলেই মনে হল। এদিকে শ্রাবণ তার সময়কার অন্যান্য
সমাজতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য বিদগ্ধজনেদের নিয়ে এর সপক্ষে একটা সচেতনতা শিবিরের
আয়োজন করল। সকলের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হল আগামী দু সপ্তাহ পর উন্মাদনাপ্রবালগাথার কোন এক অডিটোরিয়ামে সেটা হবে। ইতিমধ্যে সে আবার
ফিরে গেল মানময়ী অনঙ্গের বাড়ির ছাদে তার গবেষণা ও নিরীক্ষণশালায়। সম্রাটের মেয়ে চৈতি
আর ছেলে ফাগুন খানিকটা যেন বাবার বংশের ধাত পেয়েছে বলেই সবার মনে হল। শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে তাদের এত ভাব
জমে গেল যে বলার না। তারা তাদের মামারবাড়ির গুষ্টিকে এত ঘৃণা ও পদে পদে এত হেনস্থা
করে যে তা দেখে বুঁচি তার বাপের বাড়ির সংস্রব একবারে ত্যাগ করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে।
অসম্ভব প্রাণশক্তিতে ভরপুর দুজনে চটপট যে কোন কিছু শিখে নেয়। ওদের চেয়ে বছর খানেকের
ছোট যে ভাইটা ওদের আছে, ওরা তাকেও একদিন নিয়ে এল। ওর নাম ঊল্কা। সবাই যে যার মত বাড়ি
চলে গেলেও সে শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে এঁটুলির মত এঁটে রইল। ও ওর এক ডজন বন্ধু নিয়ে এসে বলল
যে ওরা শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে দিগন্তসেনা যেতে চায় আর ওখানেই ওরা ওদের পড়াশোনাটা শেষ করতে
চায়। শ্যামাঙ্গী বলল ওদের যে বাচ্চারা যে কেউ ইচ্ছে করলেই ওখানে যেতে পারে না। তখন
ওরা ওদের বাবা-মাদের নিয়ে এসে বলল যে ওরা ওদের
বাবা-মাদের অনুমতি নিয়েই ওখানে যেতে চাইছে। সত্যি সত্যিই ওরা সকলে ওদের বাচ্চাদের ওখানে যেতে দিতে চাইছে দেখে
শ্যামাঙ্গী বলল যে বছরটা শেষ হোক, তারপর ও ওদের ওখানে নিয়ে যাবে। তাতে ওরা খুশি হল।
এখানকার জনঘনত্ব বিপুল পরিমানে কমে গেছে বলে সুদামের অফিসের বড় কর্তা এখানে জনঘনত্ব
বাড়ানোর ব্যাপারে মন্ত্রীদের তদারকি ও ব্যবস্থা করতে বলল। এই সুযোগে শ্যামাঙ্গী তার
রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আতাহুপু পুলকাকে বলল অবিলম্বে ইন্ডিয়ানদের আনবার
ব্যবস্থা করতে। আর বলা মাত্রই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাতটা বড় বড় জাহাজ বন্দরে এসে নোঙর
ফেলল। ইন্ডিয়ানরা ক্ষত বিক্ষত ভাঙা চোরা শরীর ও স্বত্বা নিয়ে এখানে প্রবেশ করল। আর
সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাদের মনে হল যে তারা স্বর্গে প্রবেশের ও বসবাসের সুযোগ পেয়ে ধন্য
হয়ে গেল। যে সমস্ত পরিত্যক্ত বাড়িগুলো ছিল সেখানেই তাদের থাকার ব্যাবস্থা করা হল প্রথমে।
যখন সেগুলো পূর্ণ হয়ে গেল তখন সুদাম অব্যাবহৃত জমিগুলোতে ওদের থাকার ব্যবস্থা করল।
আর এই সমস্ত পর্বটা যখন চুকে গেল, তখন দেখা গেল আরও লোকজনকে ধারণ করবার জন্য এখানকার
মাটি অপেক্ষারত। তখন দ্বিতীয়বার আবার ব্যবস্থা করা হল। আর সেটার শেষেই দেখা গেল জনবসতি
একেবারে ঠিক হয়েছে। ইতিমধ্যে শ্রাবণ তার প্রস্তাবিত সচেতনতা শিবির আয়োজন করেছে। যথাদিনে
যথাস্থানে অনুষ্ঠান শুরু হতেই দেখা গেল বড় স্ক্রিনে প্রায় সমস্ত নেতা মন্ত্রীই হাসতে
হাসতে মাঠের মধ্যে কুটোপাটি খেতে খেতে সুড়ুত করে ওই মেয়েগুলোর বাড়িটায় মোটামুটি তিনটে
শিফটে যাতায়াত করছে আর এর জন্যে অনেকে বোরখাও ব্যবহার করছে। কেউ কেউ এতে অবাক হলেও
বেশির ভাগ মানুষই তা হল না। কিন্তু হাজার বলার
পরেও শত সহস্র আবেদনেও শীলমোহর দাগা হল না। শ্রাবণ তার বক্তব্যে দ্বর্থহীন ভাষায় ব্যাক্ত
করল ওর মতামত যে তথ্য প্রমাণ থেকে এ কথা পরিষ্কার, একবারে শিশুরা ছাড়া সমাজের প্রায়
সব বয়সের লোকেরই এখানে যাতায়াত আছে। অর্থাৎ
এ জিনিসটার প্রয়োজন আছে এ কথা প্রমাণিত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশী সংখ্যক যে বয়সের মানুষ ওখানে
যাতায়াত করছে, তারা মূলত কিশোর এবং যুবক। যদি এখানে এই সু্যোগটা না থাকত তা হলে তারা
কি করত বা কোথায় যেত! বলা বাহুল্য, তারা একটা বিকৃতির শিকার হত। তাই সোজা ব্যাপারটাকে
সোজাসুজি শীলমোহর দেগে দেওয়াটাই বিচক্ষণতার কাজ যেটা মন্ত্রীরা করলেন না। তাহলে নিশ্চয়
কোন সমস্যা আছে এর পেছনে যেটা আমরা এখন জানি না।
কিন্তু
পরিস্থিতিটা আর এক থাকে না। এখানকার প্রায় প্রথম বাড়ি করা বাসিন্দা হিসেবে ওরা নিহিতপাতালপুরী
জায়গাটাকে যেমন দেখেছিল বা যেদিন ঘোড়ায় করে শ্যামাঙ্গী বাড়ি ফিরেছিল বা যেদিন উল্কা
শ্যামাঙ্গীর গলা ধরে ঝুলে পড়ে আবদার জানিয়েছিল শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে দিগন্তসেনা যেতে চায়
সব বন্ধুদের নিয়ে, সেইসব দিনগুলো খুব দ্রুত সরে গিয়ে তার মধ্যে ঢূকে পড়ে অগুনতি, অদ্ভূত,
একেবারে বেজায় বেখাপ্পা বেশ কতগুলো সংখ্যক দিন। আর সেইসব দিনগুলোতেই ওই মেয়েদের বড়
বাড়িটাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে নানা জাতের, নানা স্বভাবের লোকজনের নিত্য
নৈমিত্তিক একটা চলাচল শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় এমনকি আদিম বাসিন্দা যারা ছিল তাদের ঘরদোরগুলোতে
আর তাদের দেখা যায় না। বরং তার বদলে এইসব নতুন আসা বা ঢুকে পড়া মানুষজনই বসবাস করতে
শুরু করে দেয়। কলার খোসা আর লেবুর চামড়া দিয়ে বুঁচি একটা সুস্বাদু খাবার বানিয়ে তার
দোকান দিয়েছে। খাবারটা এই সব লোকজনের কাছে বেজায় লোভনীয় হয়ে ওঠে আর দিনের মধ্যে এতবার
করে সেটা খেতে এত লোক সেখানে আসে যে মাত্র ক’মাসের মধ্যেই
বুঁচি খুব বড়লোক হয়ে যায় আর তারপরই ওই ব্যবসাটাকে
সামলাবার জন্য বেশ কয়েকজন লোক নিয়োগ করে। এই একটা খাবারই ফরাসি থেকে রোমান, তূর্কী
থেকে আরব, এমনকি আফ্রিকার আদিম মানুষ থেকে চীনের, রাশিয়ার, বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের
অধিবাসীদেরও এতটাই পছন্দ হয়ে যায় আর চাহিদাও এত গুণাত্বক হারে বাড়তে থাকে যে তাতে করে
সম্রাটের একটু সন্দেহ হয়। একদিন সে খাবার ছলে সেটা নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করাতেই ধরা পড়ে
যে তার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আফিম মেশান আছে। ও সেটা জেনে ফেলেছে বলে ওর খুব ভয় হতে
থাকে এই ভেবে যে অর্থলোলুপ বুঁচি আর তার লোকজন ওকে হয়ত মেরে ফেলতে পারে। তাই কাউকে
কিছুই না জানিয়ে সম্রাট বেপাত্তা হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের আর ব্যবসাপত্তর নিয়ে বুঁচি পড়ে
অথৈ জলে আর তারপরই একদিন এসে দাঁড়ায় শ্বশুরবাড়ির দরজায়। উপমা আর অলঙ্কৃতা দুজনেই ওকে
ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বের করে দেয়। লগ্নলতা আর সুলক্ষী এতদিনে নিষ্কৃতি পেয়ে
একটা জুতসই ছেলের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আমেরিকাবাসী হলেও ওদের সঙ্গেই একদিন দেখা হয়ে যায় সম্রাটের আর সেই
সুত্রেই জানা যায় যে সে আপাতত আছে মেক্সিকো আর গুয়াদেলুপের যুগ্ম অংশীদারি এক ব্যবসার
সুপারভাইজার হিসেবে এক কোম্পানিতে। অনঙ্গ কিন্তু এটা মেনে নিতে পারে না একেবারেই যে
তার বংশের রক্তধারায় সিঞ্চিত শিশু তিনটি ওই রকম একটা পরিবেশে বড় হবে। তাই সে সোজা বুঁচির
কাছ থেকে ছেলেমেয়ে তিনটেকে নিয়ে রাখে নিজের
কাছে। শিশু তিনটিও এই ব্যবস্থায় খুব খুশি। অনঙ্গ, মানময়ী ওদের প্রাথমিক দেখভালটা করলেও শেষ পর্যন্ত ওদের হাল ধরে অলঙ্কৃতা আর ওদের পাঠিয়ে দেয় আর নিজের
ছেলেমেয়েরা যেখানে পড়ত সেই আবাসিক বিদ্যালয়ে যাতে ওরা ঠিক মত তৈরী হয়ে উঠতে পারে এই
ভেবে।
দিগন্তসেনা
এতদিনে সকলের কাছে একটা পরিচিত নামই শুধু নয়, খুব আকর্ষণীয় রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর
সকলের নজর কেড়ে নিয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা তাদের শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণ
করেছে। যে আদিম প্রবৃত্তির দাসত্বের শৃঙ্খল
ভাঙার কারণে এর জন্ম সেটাই ওদের এই রাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে বাধ্য করেছে।
ইতিমধ্যে একশ চল্লিশজন শিশুকে নিয়ে এক আবাসিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি করা হল
আর তার উদ্বোধনের জন্য ডাকা হল একজন বিজ্ঞানীকে যার জন্ম ইরাকে, বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে,
পড়াশোনা আমেরিকায় , কিন্তু বংশ সূত্রে তিনি গ্রেকোরোমান সভ্যতার সঙ্গে জড়িত। তার নাম
গোদার মাসাদুনিয়া। গোদার মাসাদুনিয়া এই মুহূর্তে পৃথিবীতে একটা বহু চর্চিত নাম। কেননা
তার গবেষণার বিষয় যে সমস্ত মানুষ বয়েসজনীত কারণে
আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে অক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং তারপর একসময়
মৃত্যু এসে ওদের গ্রাস করে, তারা চাইলে কিভাবে আরও বেশি দিন বেঁচে থেকে তাদের পছন্দের
কাজগুলো করে যেতে পারেন। দিগন্তসেনায় তিনটে নদী কেটে রাষ্ট্রের বাইরের অন্য নদীর সঙ্গে
সেগুলোকে যুক্ত করা হল। আর রেলপথ, আকাশপথ ও
সড়কপথে চলাফেরার ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাষ্ট্রের
সঙ্গে সংযোগের কাজও সম্পুর্ণ করা হল। কিন্তু এসব স্বত্ত্বেও বিপদ কিছু এড়ানো যাবে বলে
শ্যামাঙ্গী মনে করে না। নিজেদের কাজে কিম্বা প্রয়োজনে অন্য কোথাও গেলে সেখানেও ধর্ষণের
ঘটনা ঘটতে পারে বলে শ্যামাঙ্গীর মনে হল। তাই সেক্ষেত্রে শ্যামাঙ্গী জানিয়েই দিয়েছে,
যখন যে রাষ্ট্রে এই ঘটনা ঘটবে, সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীকে ধরে তার হাতে ছেড়ে দিতে তারা বাধ্য
থাকবে সেই রাষ্ট্র। এই ধরনের অপরাধের অবসম্ভাবী সাজা হিসেবে তাকে খোজা করে দেওয়া হবে।
কোন কারণে উক্ত রাষ্ট্র ওর সঙ্গে সহযোগিতা না করলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
শ্যামাঙ্গীর এই সিদ্ধান্তকে মোটামুটি পৃথিবীর সব রাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছে অল্প কটা
রাষ্ট্র বাদে। কিন্তু বাদ সাধল শ্যামাঙ্গীরই বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক, চিন্তাবিদদের
কমিটি। তারা সোজা হাত জোড় করে এসে শ্যামাঙ্গীর সামনে দাঁড়াল। তাদের বক্তব্য, একজন শিশু
মায়ের পেট থেকে পড়েই ধর্ষক হয় না, বরং তাকে ধর্ষক করে তোলা হয়। আর সেই কাজটা অত্যন্ত
সুচতুরভাবে করে এই সমাজ। তাই যা করার তা এই সমাজের বিরুদ্ধেই করতে হবে। শ্যামাঙ্গী
চুপ করে শুনল, কিছু ভাবল কিনা কে জানে, তবে মুখে কিছু বলল না।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন