ভালোবাসার কথা বলতে এলাম
: প্রাণের মানুষ ১২
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো। তখনও আলো ফোটেনি। ঘুমোতে যাবার সময় চোখ বন্ধ করে খুব মন দিয়ে একটা ঘড়ি ভাবছিলাম। যার কাঁটাতে সকাল ৫টা বেজেছে। কলকাতায় আমার পড়ার টেবিলে একটা গোল ঘড়ি বসানো থাকতো, যার মিনিটের কাঁটা, সেকেন্ডের কাঁটা, সব ছিল। সাদা গোল টেবিল ঘড়ির ওপরে কালো কাঁটা আর একটা পিলে চমকানো এলার্ম। সেই এলার্ম আবার সময়ে সময়ে বাজতো না! ঠিক পাঁচটায় ঘুম ভাঙতেই চটপট হাত মুখ ধুয়ে নীলরংয়ের মগ ফ্লাস্কে চা আর কয়েকটা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যেখানে সূর্যাস্ত অমন সুন্দর সেখানে সূর্যোদয় না জানি কেমন হবে।
গতকাল ঘুটঘুটে অন্ধকার হবার আগেই মোটেলগিন্নির উপদেশ মত মোটেলে ফিরে এসেছিলাম। ফেরবার পথে বেহায়া আদেখলার মতো আবার গেটের কাছে প্রেয়ারি ডগ কলোনিতে গাড়ি থেকে নেমে উঁকি ঝুঁকি মারছিলাম। হঠাৎ ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক বিশাল কেঁদো বাইসন ঘাস খেতে খেতে আমার দিকে আসছে। সে আমার ম্যাটাডোরের রুমাল মার্কা ওয়ার্ম কালারের কুর্তা দেখে একবার ঘোলাটে চোখে তাকাতেই আমি চটপট বাজের সঙ্গে দে হাওয়া! গাড়ি চালাতে চালাতেই ঠিক করেছিলাম যে এখানে চা খেতে খেতে ভোরের আলো ফোটা দেখতে আসব।
SD-240 E. পথে দক্ষিণদিকে মাইল সাতেক গেলেই ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্কের গেট। আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে শিশিরের গন্ধ, বাতাসের গন্ধ, ভোরের গন্ধ মেখে নিচ্ছি অন্তরে। একটা মেঘলা দিন আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠছে। বুঝলাম আজ সূর্যোদয় ঘটবে এক বাদলা পর্দার অন্তরালে। তার প্রকাশ হবে রহস্যময়, তার স্পর্শ হবে সিক্ত। কিন্তু আমার যে সেই ভালো সেই ভালো...
'গোপনে
দেখেছি তোমার ব্যাকুল নয়নে ভাবের খেলা।
উতল
আঁচল,
এলোথেলো
চুল,
দেখেছি
ঝড়ের বেলা।
তোমাতে
আমাতে হয়নি যে কথা
মর্মে
আমার আছে সে বারতা—
না
বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা আমার বাঁশিটি বাজানো
সেই
ভালো সেই ভালো,
আমারে
না হয় না জানো।
সেই
ভালো সেই ভালো'
একটা টিলার পাশে গাড়ি থেকে নেমে পাথরের ওপরে বসে চা বিস্কুট খেতে খেতে দেখলাম প্রথম আলো, পাহাড়ের নীচের উপত্যকা থেকে ধীরে ধীরে মেঘের অবগুণ্ঠনমোচন, বিগহর্ন গিন্নিদের মর্নিং ওয়াক, শুনলাম লার্কের (Western meadowlark) মিষ্টি গান... আমার প্রতিটি ইন্দ্রিয় যেন পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত। মোটেলে ফিরে ভালো করে স্নান সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে লবিতে এলাম। আজকে কাউন্টারে রয়েছেন একজন বৃদ্ধা মহিলা। মনে হলো এই মোটেলটির দেখাশোনার দায়িত্ত্বে রয়েছে একটি পরিবার। গতকাল যিনি ছিলেন তার মা আজ রয়েছেন সকালবেলার তদারকিতে। তাকে চাবি ফেরত দিয়ে ধন্যবাদ জানালাম।
'I
had a wonderful stay in Wall. Thank you.’
‘You are most welcome. Please pick up your breakfast box from the fridge. Due to the pandemic we are not serving breakfast any more in the dining room.’
কাউন্টারের লাগোয়া ফ্রিজ। আমি ফ্রিজ খুলে একটা বাক্স নিয়ে, লটবহর সমেত গাড়িতে। দেখলাম বাক্সে রয়েছে ফল, দই, মাফিন,প্রোটিন বার ইত্যাদি। আমি মাফিন, দই আর জল খেয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। চল পানসী বেলঘরিয়া...
আজ অপেক্ষাকৃত কম দূরে যেতে হবে। ওয়াল থেকে কাস্টারের (Custer) দূরত্ব একশো মাইলেরও কম। ঘন্টা দেড়েকের ভেতরেই পৌঁছে যাওয়া উচিত। অর্ধেক পথ ইন্টারস্টেট ৯০ ধরে আর বাকি অর্ধেক US-16 W আর US-385 S দিয়ে যেতে হবে। তবে শেষের দিকটায় পাহাড়ি রাস্তা - তাই সময় খানিক বেশি লাগতে পারে। মেঘলা দিনে নরম আলোয় দ্রুতগতিতে বাজে বাহাদুর। পথে পড়ল চেয়েন নদী (Cheyenne River)। চেয়েন নেটিভ আমেরিকান উপজাতির নামে এই নদীর নামকরণ। লাকোটারা এর নাম দিয়েছিলো Wakpá Wašté বা ভালো নদী। এই নদী ছিল তাদের জীবনধারণের ধমনী। এটি প্রায় তিনশো মাইল উত্তর-পূব পানে গিয়ে মিসৌরি নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়।
নদীর কথায় মনে পড়ল, আমি চেম্বারলেনে সেই বিশাল ডিগনিটি মূর্তির পাশে একটা প্রস্তরফলকে লুইস আর ক্লার্কের অভিযানের কথা পড়েছিলাম। ইন্টারস্টেট ৯০ ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিলাম যে আমি যেই পথটা দিয়ে যাচ্ছি, প্রায় দুশো বছর আগে নদীপথে সেইভাবেই যাত্রা করেছিলেন ক্যাপ্টেন মেরিওয়েদার লুইস (Captain Meriwether Lewis) এবং সেকেন্ড লিউটেনান্ট উইলিয়াম ক্লার্ক (Second Lieutenant William Clark)। প্রেসিডেন্ট জেফারসন ১৮০৩ সনে ফরাসিদের কাছ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে লুইসিয়ানা রাজ্য কিনে নেন। তখন তার পরিধি ছিল ৮২৮০০০ বর্গ মাইল এবং এর অধিকাংশ এলাকাই ছিল নেটিভ আমেরিকানদের বাসস্থান। বর্তমানে এই অঞ্চল ১৫টি মার্কিন রাজ্যে বিভক্ত। তা জেফারসন তো বর্গ মাইল পিছু ১৮ ডলার দিয়ে রফা করলেন। কিন্তু এই বিস্তির্ণ অঞ্চলে স্যাপ ব্যাঙ কি আছে না আছে তা তো দেখতে হবে। তা সেটা দেখার ভার পড়লো কিছু সৈনিক আর সিভিক ভলান্টিয়ারদের ওপরে। ১৮০৩ সালের আগস্ট মাসে শুরু হলো আবিষ্কার অভিযান (Corps of Discovery Expedition)। একটি গোটা বছর ধরে নদীপথে ক্যাপ্টেন মেরিওয়েদার লুইস আর সেকেন্ড লিউটেনান্ট উইলিয়াম ক্লার্কের নেতৃত্ত্বে চলল সেই পশ্চিমমুখী যাত্রা। তাদের সঙ্গে ছিল বিশ্বস্ত কুকুর সিম্যান (Seaman) যাকে কিনা একবার নেটিভ আমেরিকানরা চুরি করে পরে ফেরত দিয়ে যায়। সিম্যানের ভাবগতিক বোধ হয় খানিকটা আমার মতোই ছিল! তারা প্রথমে মিসিসিপি এবং মিসৌরি নদীর সংযোগস্থল ক্যাম্প উড থেকে যাত্রা শুরু করে মিসৌরি নদী বেয়ে, স্নেক নদী, কলম্বিয়া নদী ধরে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে ফোর্ট ক্ল্যাটসপ-এ পৌঁছোতে পৌঁছোতে ১৮০৫ সালের নভেম্বর মাস গড়িয়ে যায়। এই আবিষ্কার অভিযানেই ফলস্বরূপ এই এলাকার ম্যাপ, প্রাকৃতিক সম্পদের হদিশ, নেটিভ আমেরিকানদের যাপন ইত্যাদি বহির্বিশ্বের কাছে প্রথমবার পৌঁছয়।
বাজ বাহাদুরের সঙ্গে পথ চলতে চলতে ভাবছিলাম, আমি ইন্টারস্টেট ৯০ ধরে যে নদীগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছি বা চলব, দুশো বছর আগে এই নদীপথেই এসেছিল নাগরিক সভ্যতার ট্রোজান ঘোড়া। ধ্বংস হয়েছিল অশ্বারোহী মানুষদের অস্তিত্ব।
'ঝরাতে
ঝরাতে যাব সারা রাস্তা মাঠের শিশির,
বড়
বড় ঢেউ তুলে যতই দেখাক ভয়
পাড়-ভাঙ্গা
নদী
ফিরে
পেতে চাই সেই বাল্যের বিস্ময়,
যে
রোমাঞ্চ অন্ধকারে যেতে হাতে-ঝোলানো লণ্ঠনে।
ফেলে
রেখে আমাকে বন্ধনে
ছেলে
গেছে বনে।'
অদ্ভুত সুন্দর এক পাহাড়ি রাস্তা ধরে কাস্টার পৌঁছলাম দুপুর নাগাদ। ১৮৭৪ সালের ব্ল্যাক হিল অভিযান চালিয়েছিলেন জর্জ কাস্টার (Lt. Colonel George Armstrong Custer). সেই অভিযানেই এই অঞ্চলে সোনার খনির হদিশ মেলে আর শুরু হয় গোল্ড রাশ। জুলাই মাসে এখনো এই শহরে 'সোনা আবিষ্কারের দিন' খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। সকালের সেই মাফিন আর দই অনেকক্ষণ হজম হয়ে গ্যাছে। শহরের মুখে একটা সাবওয়ে স্যান্ডউইচের দোকান থেকে একটা হানি মাস্টার্ড দেওয়া টুনা স্যান্ডউইচ কিনে ভাবছি কোথায় বসে খাওয়া যায়। ঘুর ঘুর করতে করতে একটা ভিসিটর সেন্টার চোখে পড়ল। ভিসিটর সেন্টারের লাগোয়া একটা ঘাসজমিতে তিন চারটে বসবার বেঞ্চ। সামনে একটা ছোট ঝর্ণা নেমেছে কালো পাহাড়ের পাথর বেয়ে। ঘাসজমি সরেজমিনে তদন্ত করছে দুটো রবিন। ভাবলাম হানি মাস্টার্ড দেওয়া টুনা স্যান্ডউইচ খাবার এইটেই প্রশস্ত স্থান। খেয়ে দেয়ে পেট ঠান্ডা, মন প্রশান্ত। এইবার ভিসিটর সেন্টারের ভেতরে যাওয়া যেতে পারে।
ভিসিটর সেন্টারে কাউন্টারের পেছনে এক বৃদ্ধা মহিলা আমাকে হাসিমুখে
বললেন
'‘Good
afternoon. How can I help you?’
‘Good
afternoon. I am visiting Custer for a day. Can you please guide me so that I
can make the most of this visit.’
‘Of course. You are in one of the most beautiful parts of this country. Here, let me show you in this map.’
ভদ্রমহিলা অনেকটা সময় নিয়ে সেই ম্যাপে আমাকে চিনিয়ে দিলেন কাস্টের ন্যাশনাল পার্ক, পিটার নরবেক সিনিক হাইওয়ে, মাউন্ট রাশমোর ইত্যাদি। ধৈর্য্য ধরে জানালেন আমার কোথায় আগে যাওয়া উচিত, কোন সময়ে কোন দিক দিয়ে মাউন্ট রাশমোর দেখা উচিত। যে সব জায়গার কথা কেবল বইয়ে পড়েছি সেই সব নিজের চোখে দেখবো বলে খুব খুব ভালো লাগছিল। অমায়িক হাস্যোচ্ছল মানুষটিকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে ফিরলাম।
একটা আশ্চর্য পথের সন্ধান পেয়েছি... পিটার নরবেক সিনিক হাইওয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে অনেকগুলি পাহাড়ি রাস্তা। ..U.S. Route 16A, South Dakota Highway 244 (SD 244), SD 87... এই পথগুলি আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে, অপেক্ষায় আছে কাস্টের ন্যাশনাল পার্কের বাইসনের দল। বাজ বাহাদুরকে পেট্রল পাম্পে ভরপেট খাইয়ে দিয়ে দুজনে রওনা দিলাম।
'পথ
বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা
দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন
নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে
ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না
ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার
নৃত্য,
হঠাৎ
আলোর ঝল্কানি লেগে
ঝলমল
করে চিত্ত।
নাই
আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায়
কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ
কখন্ সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা
ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায়
হেলাভরে করে
অরুণকিরণে
তুচ্ছ
উদ্ধত
যত শাখার শিখরে
রডোডেন্ড্রন্
গুচ্ছ।
নাই
আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,
নাই
রে ঘরের লালনললিত যত্ন।
পথপাশে
পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন
তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া
মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে
দুজনে তৃপ্ত।
আমরা
চকিত অভাবনীয়ের
ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।'
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন