দুর্গাপুজোর ভোগ
বাঙালি আর খাওয়াদাওয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাঙালিদের পরম আপনার উৎসব দুর্গাপুজো। দুর্গাপুজো মানেই ভোগের সমাহার। এক একটি জমিদার পরিবার দীর্ঘ দিন ধরে দুর্গাপুজো করে আসছে। আর এই পুজোর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ভোগরান্না।
পুরাতন বনেদি বাড়ির ভোগ ইতিহাস
বিচারে ভোগের বেশ কয়েকটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। নিরামিষ শস্যপ্রধান ভোগ, আমিষ ভোগ,
শীতল, মিষ্টান্ন ও পান্তাপ্রসাদ। বিভিন্ন
পরিবার বিভিন্ন পারিবারিক ঐতিহ্য বহন করে এই ভোগ প্রসাদ দিয়ে থাকেন মাকে।
ভোগ ধারণা যেমন মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ব্যাখা
করা যায়, তেমনই ভোগের প্রকার ভেদেও এই সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ছবি পরিলক্ষিত হয়। উমা
যেন সব বাঙালির ঘরের মেয়ে। তার বৎসরান্তে একবার ফেরা পিতৃগহ তথা বাংলায় আনন্দের আবেশ
এনে দেয়। দুর্গাপুজোর ভোগেও পড়ে তার ছায়া। নানারকম নিরামিষ পদ, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের
নদী-পুকুরে পাওয়া যায় এমন মাছ সহ নানারকম আমিষ ভোগ, দেবীর গুরুপাক খাবার খাওয়ার পর
শীতলের ব্যবস্থা যেমন, ক্ষীর ডাব পান বা আমলকি, তারই সঙ্গে দশমীর দিন পান্তাপ্রসাদ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই আমিষ ভোগ অনেকে উপজাতি প্রধান বঙ্গদেশের উপজাতি প্রভাবের ফল
বলেও মনে করেন। উপজাতিদের মধ্যে যে দেবী চণ্ডীর উল্লেখ আছে তারই প্রভাবে অষ্টমী নবমী
তিথির সন্ধিক্ষণের পুজোয় কিছু পরিবারে পরিবারে দুর্গাপুজোয় মাছপোড়া দেবার রীতি আছে।
ফলত এই আমিষ ভোগের প্রচলনের সম্পূর্ণ ব্যাখা করা কঠিন। যাইহোক, বিবিধতা সত্ত্বেও বাঙালি
ভোগে অভিনবত্ব রেখে নানান নতুন উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রমাণ রেখেছে। বাঙালির সব থেকে আকর্ষণীয়
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখা করা যায় দশমীর এই পান্তাপ্রসাদে।
আমিষ ভোগের মধ্যে বিভিন্ন রকমের মাছ দেওয়া হয় ঠাকুরকে। বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় মোট দশটি থালার মধ্যে আটটিতে থাকে আমিষ ভোগ আর দুটি থালায় থাকে নিরামিষ ভোগ নারায়ণ ও শিবের জন্য। অন্তত পাঁচ রকমের মাছ প্রতিদিন দেওয়া হয় মা'কে। আর এই পাঁচ রকমের মাছের মধ্যে থাকে ইলিশ, চিংড়ি, রুই, ভেটকি, সরপুঁটি।
সাবর্ণ
রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোয় দুর্গাপুজোয় মাকে অন্নভোগ দেওয়ার রীতি না থাকলেও
সাবর্ণদের পুজোয় হরেক স্টাইলের অন্নভোগ দেওয়াই রীতি। ঘি-ভাত, কাজু-কিসমিস সুসজ্জিত
বাসন্তী পোলাও, মনমাতানো খিচুড়ি, হরেক রকম ভাজা, ঘরে তৈরি বড়ি, পায়েস, বাড়িতে ভিয়েন
বসিয়ে তৈরি মিষ্টি। এসবের সাথে আমিষ ভোগ হিসেবে থাকে নানা রকমের মাছ। দশমীর ভোগ পরিবেশনের
সময় জগজ্জননী মা এখানে শ্বশুরঘর থেকে বাপ মায়ের কাছে ঘুরতে আসা বাড়ির মেয়ে। তখন
তাকে দেওয়া হয় পান্তাভাত, খেসারীর ডাল, কচুশাক, কই মাছের ঝাল, চালতার টক। ৪১০ বছরে
সাবর্ণদের বিরাট পরিবারে ভাঙন ধরেছে। ভাগ হয়েছে পুজোর আয়োজনও। বড়িশাতেই ৬টি বাড়িতে
দুর্গাপুজো হয়। এছাড়াও আছে নিমতা এবং বিরাটির দুর্গাবাড়ি। পুজোর নিয়ম সব জায়গায়
সম্পূর্ণ এক নয়। যেমন সব বাড়িতে আমিষ ভোগ দেওয়া হলেও নিমতার পুজোর ভোগ সম্পূর্ণ
নিরামিষ। সন্ধিপুজোয় দেওয়া হয় ল্যাটা মাছ পোড়া। নৈবেদ্যর সঙ্গে দেওয়া হয় ১০৮টি দীপ
ও নীলপদ্ম। বোধন, চণ্ডীপাঠ এবং হোমের সঙ্গে কুমারী পুজো হয়।
শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর সূচনা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধ জয়ের পর থেকে। পুজোর মূল আমন্ত্রিত ছিলেন সাহেব, মেমরা। মদ মাংসের ফোয়ারা ছুটিয়ে বাঈজি নাচের আসর বসত। এসবের সামনে স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ির মেয়ে বউরা পর্দার আড়াল ঠেলে সামনে আসতেন না। পুজোর ভোগ প্রসাদ সবই তাই তৈরি হতো মাইনে করা ব্রাহ্মণদের হাতে। এই রীতি আজও অব্যহত। রাজবাড়ির এই পুজোয় অন্নভোগ দেওয়া হয় না। বংশানুক্রমিক ভাবে ব্রাহ্মণ রাঁধুনিরা তৈরি করেন বিশালাকার সব মিষ্টি। পাঁচ সাতটা লাড্ডু একসাথে মেশালে যেমন হবে তেমন সাইজের মন্ডা, থালার সাইজের জিলিপি, বিরাট বিরাট মিঠেগজা, চৌকাগজা, ধবধবে সাদা মোতিচুর – নানারকম দুর্লভ মিষ্টি ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় ঐতিহ্যমন্ডিত এই রাজবাড়ির পুজোয়। রাধাবল্লভীর সাইজও নজরকাড়া। বাড়ির মেয়ে ঘরে আসছে বছর ঘুরে।
দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির মেয়েরা ভোগের জন্য তৈরি করে রাখেন কুলের আচার। আমের সময় কাঁচা আম রোদে জাড়িয়ে তৈরি হয় আমের আচার। বাজারে পালং শাক উঠলে সেই শাক কুঁচিয়ে ডাল বাটার সাথে মিশিয়ে বড়ি তৈরি করা হয়। পুজোর ভোগে থাকে পোস্তর বড়ি, ধনেপাতার বড়ি, বাদামের বড়ি, আলুবখরার আচার, তেতুলের আচার।
পাথুরীয়াঘাটা ঘোষ বাড়িতে খাঁটি চন্দন কাঠের গুঁড়ো দিয়ে বানানো চন্দন ক্ষীর মাকে নিবেদন করা হয়। এমনটা আর কোথাও হয় না। অষ্টমীতে মা সিঙারা, নিমকি দিয়ে ভোজ দেওয়া হয়।
ঠনঠনিয়ার লাহা বাড়ির ১৭৫ বছরের পুরনো পুজো। মাকে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় ছ’ রকমের নাড়ু। সুজির নাড়ু, তিলের নাড়ু, ছোলার নাড়ু, চাল নারকোলের নাড়ু, আরও নানা রকম। এছাড়া নানারকম মোয়া, গজা, লুচি, কচুরির সাথে রীতিমতো ফুলুরি, বেগুনীও ভোগে দেওয়া হয়। মা দুর্গার তেলেভাজাপ্রীতি অবশ্য রীতিমতো সার্বজনীন। সিঙারা, কচুরি, নিমকি তো একাধিক বাড়ির পুজোর কমন ভোগ। মা যে এর পাশাপাশি ফুলুরি, বেগুনীতেও আসক্ত, তা লাহাবাড়িতে না এলে বোঝা দুষ্কর। এখানে মাকে ঘরের মেয়ে রূপে দেখান হয়।
চোরবাগানের চ্যাটুজ্জে বাড়ির দুর্গাপুজোর সপ্তমীতে লাউচিংড়ি, আর রুইমাছ দেওয়া রীতি। নবমীতে পার্শেমাছ, ভেটকিমাছ, আর চিংড়িমাছের সুস্বাদু ঘন্ট। আর দশমীতে জিভে জল আনা বাসী ইলিশের টক।
অনেক সময়ই দুর্গাপুজোর সঙ্গে বারো ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের নাম উঠে আসে। বোধনের দিন থেকে অষ্টমী পর্যন্ত দেবীকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। খিচুড়ি, তরকারির নানা পদ, নানা রকমের মিষ্টি। নবমী-দশমীতে দেওয়া হয় আমিষ ভোগ। নবমীতে থাকে বোয়ালমাছ আর দশমীতে ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুশাক।
বালুরঘাটে ৩০০ বছরের বেশী পুরনো পুজোয় মাকে নবমী ও দশমীতে আত্রেয়ীর প্রধান মাছ রাইখোর ও বোয়াল দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। দশমীর দিন ভোগের অন্যতম আকর্ষণ হল পান্তাভাত ও রাইখোর মাছভাজা।
সভ্যতার আদিম যুগ থেকে কৃষি যেমন মানুষের জীবনে প্রধান স্থান অর্জন করে, তেমনই মৃত্তিকা বা মাতৃকা পুজোও বহুল প্রচলিত ও পুরনো ধারণা। সমস্ত প্রাচিন জাতির কাছে শস্য ও সন্তান ছিল প্রার্থনা ও কামনার বিষয়বস্তু। আদিম মাতৃকা উপাসনা ও বৈভব কামনার মিশ্রণেই দুর্গার পৌরাণিক রূপের উদ্ভব। এখানে এক একটি পরিবার নিজস্ব আদব, কায়দায় মাকে ভোগ নিবেদন করে থাকে। আর এই ভোগে শাক-সবজি, মাছ সবই দেওয়া হত ভৌগলিক সীমারেখার নিরিখে। যেখানে যা শস্য, মাছ, সবজি ভালো পাওয়া যায়, তাই মাকে নিবেদন করা হয়।
দেবী
দুর্গা শস্যদেবী, তাই ধারণা, কাহিনী বিবর্তন সত্ত্বেও আজও তাঁর ভোগে থাকে সমকালীন
শস্য, শাকসবজি। বাঙালির পাঁচদিনের পুজো উপাচারের সঙ্গে সমান তালে এই
পুজোগুলিতে যে ভোগ বৈচিত্র্য লক্ষিত হয়, তার মূল ভিত হল সমকালীন সবজি ও ফসল।
ঐতিহাসিক ব্যাখায় শরৎ ও বসন্ত দুই ঋতুতে দেবী শাকম্ভরী ও মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো
ছিল বিধিবদ্ধ। ফলতঃ একে অনেকেই বাঙালির নবান্ন বা নতুন ফসলের উৎসব মনে করেন। এই
কারণেই ভোগ দুর্গাপুজোয় এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন