পূবালী হাওয়া
আগের বার বাহাসা ইন্দোনেশীয়ার সংগে আমাদের ভাষার মিল নিয়ে কলমের কয়েকটা আঁচড় দিয়েছিলাম। দুই ভাষার এত চমৎকার মিল দেখে শুনে আমি সত্যিই খুবই উত্তেজিত হয়েছিলাম, আর সেটাই আমাকে তুলে আছাড় দিল। খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছিল আমার - অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী আপ্তবাক্যটা সুবিধামতন ভুলে গিয়ে নিজের সবজান্তা চেহারাটা প্রকাশ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
আমার
‘বাহাসা ইন্দোনেশীয়া’ শিক্ষাটা খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে একটু একটু করে। সাহসে ভর করে ভাবলাম
কলকাতার মত বাজারটা নিজেই করা যাক না, বাড়ির সহকারীদের ওপরে চাপিয়ে না দিয়ে! আমার প্রাথমিক
শিক্ষককে ধরে পড়লাম - সর্বাগ্রে বাজার করার
অবশ্যব্যবহার্য কয়েকটি প্রচলিত বাক্যবাণ হেফাজতে আনার জন্যে। এগুলির গঠনপ্রকৃতি কিন্তু
অবিকল গড়িয়াহাটের ফুটপাথ সংস্কৃতির কার্বনকপি। মুখস্হ করে ফেললাম গোটাকতক বাক্য, এমন
কি গৃহিনী যখন রান্নাঘরে প্রচুর শব্দসমারোহে ডালে ফোড়ন দিয়ে উপর্রয্যুপরি হাঁচির মিছিল
পরিচালনা করছেন অথবা ফুটন্ত তেলে বেগুনের ভবিষ্যত নির্ধারণ ব্যস্ত এবং তাঁর দুই সহকারিনী
নিশ্চিতভাবেই আমার শব্দসীমার বাইরে, তখন বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ, জিভ আর
শারীরিক ভাষাটাও রপ্ত করার জন্যে মহড়া দিতে ভুলি নি। কোনদিকেই খুঁত রাখা চলবে না
-
কত দাম এটার?
না
না অনেক বেশী বলছো!
কমাবে
তো? অনেকটা নেব কিন্তু!
না
না, ঠিক করে বলো!
ওজন এখানে কিলোগ্রামেই, কাজেই অসুবিধে নেই, কোন সমস্যা হবে না নিশ্চয়ই। স্হানীয় বাজারে নামলাম গাড়ি থেকে, পকেট থেকে বের হলো আমার অস্ত্রশস্ত্র। ছাঁকা ছাঁকা প্রশ্নাবলীতে মনে মনে শান দিয়ে চললাম। ভারী গলায় প্রগাঢ় গাম্ভীর্য নিয়েই শুরু করলাম আলুকে নিয়ে -
“বেরাপা
ইতু?” (এটার দাম কত?)
মেয়েটি
উত্তর দিলো গড়গড়িয়ে ওদের ভাষাতেই। প্রথমটাই বাউন্সার, মাথার ওপর দিয়ে উডে গেলো।
তখন ওখানে এক মার্কিন ডলার দেশীয় ৮০০০ রুপিয়াহ্, কাজেই ওর সংখ্যাতত্বে যে কতগুলি শূন্য
সারি দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমার আয়ত্বের মধ্যে এলো না। প্রথমটায় আচমকা অরক্ষিত অবস্হায়
একটু থতমত খেলেও পরের প্রশ্নটা তখনই মাথার
মধ্য কিলবিলিয়ে উঠেছে।
“না
না অনেক বেশী বলছো!” ছুঁড়ে দিলাম মেয়েটির দিকে।
এখানকার বাজারে মহিলা বিক্রেতার সংখ্যাই বেশী। হাসলো মেয়েটা, সরল হাসি এদের মুখে সবসময়েই লেগে থাকে। দুটো নিটোল আলু হাতে নিয়ে কিছু একটা বললো এবং বলা বাহুল্য, সেটাও আমার সিলেবাসের বাইরে। কারণ সেই একই, সংখ্যাজ্ঞানটা আয়ত্বে আনার কথা তখন তো মনেই ছিল না। তাই দামটা আদৌ কমানো হলো কিনা না বুঝেই চোখ বুজে পরের শব্দভেদী বাণ চালালাম।
“কমাতে
পারবে না? ঠিক করে বলো দামটা”। আমি বুঝি বা না বুঝি, জামাকাপড়, ভিনদেশী হাবভাব বা
অক্ষম উচ্চারণের জন্যেই হোক, সে ততক্ষণে আমার এলেম বুঝেই গেছে। হাতের ক্যালকুলেটারটাতে
কিছু একটা সংখ্যা ছাপিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমাকে আরও ঘোর বিপদের মধ্যে ডুবিয়ে দিল
ঐ অতগুলো সংখ্যার ঘূর্ণীতে। সবজান্তা ভাব দেখানো ছাড়া অন্য রাস্তা নেই - পেটের মধ্যে
বোধহয় গুঁতো মেরে কেউ বলিয়ে দিলো ‘দুয়া কিলো’, মানে দু কিলো।
অনেক বীরত্ব দেখিয়ে এবারে মোবাইলে আমার কিন্চিৎ ইংরাজী জানা সারথিকে ডেকে নিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে দেখলাম মেয়েটিকে অনর্গল বকাবকি করে, দুটো পাঁচ হাজারের নোট ফেরত নিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিল। আমার পান্ডিত্যের খেসারত হিসেবে বোধহয় একটু বেশী দামই নিয়েছিলো সে।
মাছ, মাংস, সব্জী, আনাজপাতি জয় করে গেলাম মুদীখানায়। ঘরণী আমার বেশ গোছানো, ইন্দোনেশীয় ভাষায় কাগজে সব মশলাপাতির নাম আর ওজন পরিস্কার ছাঁদে লিখে দিয়েছেন - নিশ্চয়ই ওঁর সাহায্যকারীর হাত দিয়ে। কোন গোলমাল হলো না, ছোটখাটো কয়েকটা প্রশ্নবাণ আমি বা বেশীর ভাগই আমার চালক, ম্যানেজ করে দিতে পেরেছি। ওকে দিয়ে গাড়িতে বোঝাটা পাঠিয়ে ফিরবার জন্যে এক পা এগিয়েছি, ফোনে কম্পন শুরু হলো। বুঝলাম এটা বাড়ি থেকেই কোন বড়সড় বিপদসংকেত। ঠিক তাই, দোনামনা করতে করতে বোতামটা ঠুকেই দিলাম। গরমমশলা - এই অতি আবশ্যিক জিনিষটা বাদ পড়ে গেছে ফর্দ থেকে। সেনাপতি বিহীন, পরিত্যক্ত, অনিশ্চিত, বিপর্যস্ত আমি ফিরে গেলাম দোকানে। একটু নতুনত্ব দেবার জন্যে হিন্দী উচ্চারণে বললাম,“আডা
(আছে) গরমমশালা?” একটা প্যাকেট এগিয়ে জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে আছে - কেন জানি সন্দেহ হলো। খুলে দেখি নুন। ওর দিকে
তাকাতেই বলে উঠলো “গরম , গরম। আপা লাগি (আর কি লাগবে)?”
গরমমশলা যতবারই নানারকম ভাবে উচ্চারণ করছি, ওর বিষ্ময় আর অনিশ্চয়তা ততই বেড়ে চলেছে। মুস্কিল হলো জিনিষটার ইংরেজী প্রতিশব্দও জানি না। মুস্কিল আসান হয়ে দেখা দিলো আমার এক ভারতীয় সহকর্মী - অনেক দিন ধরেই এখানে আছেন, ভাষাটা জিভের ডগায়। অবস্হাটা বুঝে এবং দোকানীকে বুঝিয়ে আমাকে উদ্ধার করলেন আর গরম মশলার ধাঁধার ওপর আলোকসম্পাত করলেন। বাহাসাতে ‘গরম’ হচ্ছে ‘নুন’, আর ‘মশালা’ হচ্ছে ‘সমস্যা’। আসল গরম মশলাটা হাতে নিয়ে আমাকে দেবার সময় দোকানির মুখে যে হাসিটা চোখে পড়ল, সেটা কোনক্রমেই আমাকে ন্যূনতম ভাষাবিদ তকমা দেবার মত উৎসাহব্যন্জক নয়।
জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল - আরও দুটি নতুন শব্দের অধিকারী হলাম আমি বটে, কিন্তু পরের মাসদুয়েক বাহাসা ইন্দোনেশীয়াতে আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহসই হলো না আমার। আর আমার শিক্ষকের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিলাম। ভবিষ্যতে কিন্তু মিটিংএ, কার্যক্ষেত্রে, সাংবাদিক বা মন্ত্রীদের সঙ্গে অথবা রাস্ট্রীয় দূরদর্শনের সামনে আমাকে এই ভাষাতে অনর্গল কথা বলে যেতে হয়েছিল।
এখানে সাধারণ কর্মী থেকে উচ্চতম পদাধিকারী পর্যন্ত সবাই কালাজাদুতে খুব বিশ্বাসী। কালিমন্হন দ্বীপটির বেশীরভাগই অরণ্যসংকুল, বিশ্বের বৃহত্তম রেইন ফরেস্টের মধ্য পড়ে। কাজেই আমাদের সার কারখানা তৈরীর জন্যে বহু একর জমিকে বনানীমুক্ত করে এবং বেশ কিছুটা জমি সমুদ্রের তটরেখা বরাবর ভরাট করেও অনেকটা জমি পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল অনেক বছর ধরে। স্হানীয় লোকেদের দৃঢ বিশ্বাস অনুযায়ী যে সব ভৌতিক সত্ত্বারা জঙ্গলের গাছে গাছে বসবাস করেন তাঁদের বাস্তুহারা করার চেষ্টা করা ঘোর অকল্যাণ এবং ওঁদের অভিশাপ এসে পড়বেই মানুষের ওপরে। তাই বন জঙ্গল কেটে ওঁদের বাস্তুহারা করার আগে রীতিমত পূজো করে ওনাদের সন্মতি ও আশীর্বাদ নিয়েই কাটাকাটি শুরু করতে হবে।
দূর দ্বীপান্তর থেকে একজন ‘গুরু’কে নিয়ে আসা হলো - হ্যাঁ, এরাও গুরুই বলে, সেই শুদ্ধাচার করানোর জন্যে। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় সুজিগো আমাকে আর সহধর্মিনীকে নিয়ে চললেন ঐ গুরুর সাথে আলাপ করাতে - উনি নাকি আমার সব প্রশ্নের একশো ভাগ সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। খুব একটা উৎসাহ না থাকলেও ওকে হতাশ করতে ইচ্ছে করল না। ইচ্ছের ওপরে উদগ্র কৌতুহলটাই প্রাধান্য বিস্তার করল সম্ভাব্য ভন্ডামির মুখোশটা কতটা শক্তিশালী, সেটা ঠাহর করার জন্যেই বোধহয়। কিন্তু আশ্চর্য - বিদেশী আমরা জন্মকুন্ডলী, তিথিনক্ষত্র, ঠিকুজি বিন্দুমাত্র না জেনে কেবল জন্মতারিখ আর জন্মস্থান জানার পর আমাকে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের যে কয়েকটা কথা বলেছিলেন - অবিশ্বাস্যরকমের মিল ছিল তাতে। বলে দেওয়া দরকার, ঐ গ্রাম্য গুণীনের আমার জন্মস্হান জামশেদপুর তো দূরের কথা, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যে কতটা ধারণা ছিল, সেটাও সন্দেহের আওতায় পড়ে। যাক্ গে, সে সব অন্যসময়ের জন্যে তোলা থাক। আমরা আপাতত ফিরে যাই ঐ গুরুর কর্মকান্ডে।
পরের দিন, রাত নি:ঝুম। সশব্দে টোনির ফোর হুইল ড্রাইভটা গেটের সামনে দাঁড়ালো অন্ধকারের অহংকারকে তীব্র আলোর ছটায় নিশ্চিহ্ন করে। মুহূর্তে দরজায় খট খটাখট, আমাকে টেনে নিয়ে যাবে ওদের দরকষাকষির প্রাঙ্গণে, অশরীরি প্রেতাত্মাদের সঙ্গে সুলু পাহাড়ের ভূতুডে দেশে।
“চলো চলো, পূজো আরম্ভ হয়ে গেছে”। উত্তেজনায় ভুলেই গেছে আমি বিদেশী, ও সব ঝাড়ফুঁকে খুব একটা বিশ্বাসী নই। কিন্তু আমাকে দেখাতে হবে, বোঝাতে হবে, বিশ্বাস করাতেই হবে ওদের পালাপার্বণ, রীতিনীতি, ওদের অটল বিশ্বাস।
ওর পারিবারিক এবং কর্মজীবনের নানারকম ভৌতিক, আধিভৌতিক কাহিনী শুনতে শুনতে আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যেই এসে পড়লাম একটা মাঝারিগোছের টিলার নীচে - ছড়িয়ে ছিটিয়ে বি এম ডব্লিউ, জীপ, মিনি ভ্যান, ট্রাক, টয়োটা, হন্ডা সব অনাদরে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে আকাশমুখী গাছপালাগুলি পারিপার্শিক আবহাওয়াকে আরও গুমগুমে অন্ধকার করে তুলছে। সত্যিই রোমহর্ষক, রোমাঞ্চকর। এঁকেবেঁকে পাহাড়টার ওপরে উঠে দেখলাম বেশ কয়েকজন সহকর্মী এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে আছে উৎসুক দৃষ্টি মেলে, সবাইকে অন্ধকারে ভাল চেনাও যাচ্ছে না। একটা পরিস্কার করা জায়গায় আন্দাজ চারফুট উঁচু আর পাঁ-ছ’ফিট লম্বা আর চওড়া একটা চালার মত বানানো, ভেতরে নানারকম সরঞ্জামশ, পূজোর ব্যবস্হা বলেই মনে হলো। মশালজাতীয় একটা আলো ক্ষুদে দরজাটা দিয়ে পিছলে বেরিয়ে এসে সামনে রাখা ফুল, পাতা, ফলমূলের সম্ভারকে কেমন একটা অশরীরি ভীতির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ঐ ‘‘পাওয়ান’ (গুণীন) চালাঘরটার দিকে মুখ করে, কখনও বা ওটার চারধারে ঘুরতে ঘুরতে দুর্বোধ্য মন্ত্র আওড়াচ্ছে। ভাষাটা ঠিক এদের কথ্যভাষার পরিচিতির আওতায় আসে না। হাল্কা আলোর প্রতিফলনে সকলের পাথরের মত মুখে ঈষৎ ভয়, কৌতূহল আর আশঙ্কার ছায়া কাঁপছে। কি হয় কি হয়! বন পাহাড়ীর গভীর নৈ:শব্দ চিরে দুর্বার বেগে অবোধ্য মন্ত্রপাঠ চলছে। মশালের দোলায়িত আলোছায়ায় এক অপ্রাকৃত ঘনঘটা - আমরা সবাই একটা ছায়া ছায়া আলোর বৃত্তে বন্দী, চারপাশের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কারো ইশারার প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব। মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর, নিশ্চিহ্নে গ্রাস করে নেবে আমাদের। মাথায় দামামার দাপাদাপি - বুকের খাঁচায় বিস্ফোরণ আসন্ন।
এবার সহকর্মীদের মুখে হতাশার চিহ্ন পরতে পরতে জেগে উঠছে - তবে কি অপদেবতারা আমাদের নিবেদন গ্রহণ করতে রাজী নন্? একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, খেয়াল হলো বৃষ্টিপাতের শব্দে। গা ঝাড়া দিয়ে চারদিকে তাকাতে দেখলাম - অন্ধকার ফুঁড়ে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে আখরোটের মত শক্ত শক্ত ফল। এর মধ্যে কখন যেন গুণীনের মন্ত্রপাঠ থেমে গেছে, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, সহকর্মীদের অধৈর্য ফিসফিসানি সব, সব স্তব্ধ। গুণীণের আনন্দোজ্জ্বল চোখে এখন প্রত্যেকটি ফলের দিকে উৎসুক দৃষ্টি। মাঝে মাঝে ওপর দিকে তাকিয়ে দূর্বোধ্য ভাষার ফোয়ারা ছোটাচ্ছে। তার মধ্যেই মুখে হাসি আর হতাশার পর্দা ওঠানামা করছ। আমাদের দলে সবাই খুবই আগ্রহ নিয়ে ওর প্রতিটি চলন লক্ষ্য করে যাচ্ছে। আমার ভয় ঐ শক্ত ফলগুলোর দু একটা আমার মাথায় নেমে পড়লে জ্ঞান তো হারাবোই, তবে তার পরের বিপদ কতদূর গড়াতে পারে, তার হিসেব কি করে করবো? মাথাটা অনিবার্য ভাবেই আত্মরক্ষার জন্যে একটু হেঁট হয়ে গেল আর হাতদুটো নামে মাত্র একটা ছাতার আকৃতিতে ঘাড়ের ওপরের আমার একটি মাত্র মাথাকে রক্ষা করার কাজে ব্রতী হয়ে পড়ল। আমার বালখিল্যসুলভ আচরণে পাশের থেকে কে যেন বলে উঠলো - “ভয় পাবার কিছু নেই, ওগুলো কখনও কারুর মাথায় বা শরীরে পড়ে না। চুপ করে দেখে যাও”।
অধৈর্য হয়ে পাশের সুগিয়ান্তোকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হচ্ছে? এসবের মানে কি?” তার প্রখর দৃষ্টি ঐ গুণীনের কার্যকলাপের থেকে একচুল না নড়িয়ে, ঠোঁট চেপে বলল, “এখন দর কষাকষি চলছে, একটু ধৈর্য ধরো, এখনই সব বুঝতে পারবে”। সবার চাপা উত্তেজনা ওর চোখে মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে।
নাছোড়বান্দা
আমি - “তা কয়েকটা ফেটে যাচ্ছে, কয়েকটা আবার আস্ত ফল এদিক সেদিক গড়াচ্ছে যে?” ওদের
স্বভাববিরুদ্ধ অসহিষ্ণু স্বরে চাপা উত্তর এল, “গোটাগুলো হচ্ছে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব,
আর ফেটে ছড়িয়ে যাওয়া মানে ওনারা হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন পাওয়ানের বার্তা। ধৈর্য ধরো একটু”।
মন্ত্রপাঠ ছেড়ে ছেড়ে চলছে তখন।
কমতে
কমতে একসময় শিলাবৃষ্টি বন্ধ হলো,একটু পরে মন্ত্রপাঠও। অসহ্য নীরবতা - নি:শব্দ অন্ধকারটা অভ্রান্তগতিতে চারপাশ থেকে এগিয়ে আসছে,
একটা ভীতিকর, দমবন্ধ পরিবেশ। হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে গুণিন মাটি থেকে তরোয়ালটা তুলে একটানে
নিজের জিভটা চিরে ফেলল। দুহাতে ফুলপাতা নিয়ে ঐ রক্তে ভিজিয়ে কুঠরীটার চারদিকে উদ্ভ্রান্তের
মত পাক খেয়েই ছুটে নীচে নেমে গেল, সমান বেগে সঙ্গে দুজন অনুচর। ইন্জিন চালু রাখা একটা
গাড়ি তাদের নিয়ে উডে গেলো। আমরা যখন কাছাকাছি পৌঁছলাম, ততক্ষণে ওরা ঐ রক্তভেজা ফুলপাতা
কাজের চৌহদ্দির চারটে কোণায় ছড়িয়ে দিয়ে ফিরতি পথে।
সবাই হুড়মুড় করে যে যার গাড়ি থেকে নেমে জমায়েত হলাম মাঠের মাঝখানে। সবার মুখের ঔজ্জ্বল্য তখন সন্মিলিত তীব্র হেডলাইটের থেকেও শক্তিশালী। সবাই সবার সঙ্গে প্রাণভরে কোলাকুলি করছে আর দুহাত ওপরে তুলে, কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ওপরওয়ালাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে - উচ্চস্বরেই।
বুঝলাম, অপদেবতা (বা বনদেবতাদের) সম্মতি মিলেছে, ওনারা বনস্হল ছেড়ে ঐ চালাঘরেই থাকতে রাজী হয়েছেন এবং উপরি দান হিসেবে, আমাদের কর্মক্ষেত্রে কাজ চলাকালীন সব রকমের দুর্ঘটনা সামলে দেবার ভার নিয়েছেন।
২৫০ মিলিয়ন ডলারের কারখানাটা শেষ করে, উৎপাদন দেখিয়ে সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সৌভাগ্যবশতই বলব, কোন বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটেনি।
এটাকে
কী বলবেন? অলৌকিক, বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ? ভাগ্য?
না কাকতালীয়?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন