অর্বাচীনের রবিযাপন
(পর্ব ১)
শরৎকাল
পেরিয়ে গেল। বাতাসে হেমন্তের আমেজ। অবশ্য এবছর
করোনা-আতঙ্কের আবহে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ কাউকেই আর আলাদা করে অনুভব করা হয়ে ওঠেনি তেমন। ভাগ্য ভাল আপনার, বেঁচে গেলেন! না হলে প্রত্যেক বছর এই সময়টায় যা গালাগালি দিই আপনাকে!
বিরহ-প্রেম-পূজা-স্বদেশ-বিচিত্র
সবকিছুর জন্য একেবারে উজাড় করে দেওয়া গানের ভাঁড়ার, প্রকৃতি পর্যায়ে অন্য সব ঋতুর জন্য
এত এত গান, আর হেমন্ত কি বানের জলে ভেসে এসেছে? ওই তো সাকুল্যে ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী’,
‘হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী’, ‘হিমের রাতে’ আর ‘সেদিন আমায় বলেছিলে’ - অমন ভিক্ষে দেবার মত করে গোটাকয়েক মাত্র না লিখলেও চলত। জানেন তো, প্রতি বছর এই সময়
খুব অভিমান হয় আপনার ওপর।
অমল
ছেলেটাকেও বড্ড মনে পড়ে এ সময়। ও যেন হেমন্তের পাতা, ঝরে যাবার আগেও শিশিরের জন্য
অপেক্ষা। বিশেষ করে এ বছর প্রায়-বন্দিজীবনে আরও বেশি করে মনে পড়ছে ওকে। বন্দিত্বের তো
অনেক রকম নাম হয়। শিউলি-শৈশব বন্দি, ‘বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা’ বিনি মাইনের
গৃহসেবিকারা বন্দি, অনেক কিছু বলতে চেয়েও স্বর খুঁজে না পাওয়া অনেক অর্বাচীনের
প্রাণ বন্দি... সব বন্দিত্বের কিন্তু একটা জানালা লাগে বাঁচতে হলে, অথবা বাঁচার
স্বাদ পেরিয়ে যে বাঁচা, তার জন্যও। এই অমলের কথাই ধরি না কেন। ওকে কবিরাজ বারণ
করেছে বাইরে বেরোতে। এমনিতেই অসুখে ভোগে বেচারা। কুয়াশায়, হিমেল হাওয়ায় ঠাণ্ডা
লাগবে আরও। জানালা দিয়ে তাকিয়ে ও দেখে মেঘ আর রোদের খেলা। ওরই সমবয়সী ছেলেমেয়ের দল
খেলতে বেরিয়েছে, ও নিজের খেলনাগুলো দিয়ে দেয় তাদের, বলে, তোমরা খেলো,
আমি দেখব। সুধাকে বলে, ফুল তুললে ওকে যেন কিছু দিয়ে যায়। কি ফুল কে জানে,
শিউলি?
অমলের
চারপাশে একটা ছুটি-ছুটি ভাব। ও বেরোতে পারে না, কিন্তু মনে মনে বেড়িয়ে
আসে পাঁচমুড়ো পাহাড় আর শ্যামলী নদীর ধারে।... দাঁড়ান, দাঁড়ান, কোথাও একটা ভুল
হচ্ছে যেন! শিউলি, ছুটি, বেড়ানোর সাধ, মেঘ-রোদ্দুর - এগুলো তো
শরৎকালকেই বোঝায়। অমলের চারপাশে তাহলে শরৎ। হ্যাঁ, কবিরাজ তো বলেইছেন, শরতের রোদ
আর বাতাস এ ছেলের পক্ষে বিষবৎ! তাই তো জানালা বন্ধ রাখার নিদান। হেমন্ত কোথায় গেল
তবে? তাহলে ওই ঝরে যাওয়ার আগে হলুদ হয়ে আসা, যাই-যাই করেও না যাওয়া, তারার আলোয় পথ
চেয়ে বসে থাকা রাজার চিঠির জন্য...?
আপনি
তো আচ্ছা লোক মশাই! যখনই ভাবতে যাই, সব গুলিয়ে দেন। হলামই না হয় গরিব
মানুষ, মহাপঞ্চকের বিখ্যাত অচলায়তনে পড়িনি তো, অত তত্ত্বকথা বুঝি না! ওই মোড়লের
দল, পণ্ডিত আর কবিরাজের পুঁথির পাতাগুলো কেমন চোখ রাঙায় এসে, বলে, “কিছু জানে না
বোঝে না - অর্বাচীন! আবার মুখ খোলে!” সাধে কী আর অমল বলেছিল,
“আমি কক্ষনও পণ্ডিত হব না।” দরকার নেই বাবা ওসবে, গান শুনি বরং।
প্রথম
গানটা চালাই, “আমার রাত পোহাল শারদপ্রাতে”। এটা শরতেরই গান, তবে কোথায় যেন একটা
মিলিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়ার ভাব। কেমন নরম করে ভৈরবীতে গাওয়া, আলতো আদর করে
শব্দগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে – “বাঁশি, বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কার হাতে!” এ বাঁশির ভার
কে নেবে, কে তাতে সুর তুলবে? কাউকে তো চোখে পড়ছে না। এ বাঁশিও তো যে সে বাঁশি নয়! এর বুকে বিদায়গাথা, আগমনী
সব সুরই বাজে। এ কাল তো শুধু আগমনীর নয়, বিসর্জনেরও। কত কিছু বলার ছিল, বলা হল না... “যে কথা রয়
প্রাণের ভিতর অগোচরে/ গানে গানে নিয়েছিলে চুরি করে... অগোচরে।” এত ব্যাখ্যা, এত
ভারি ভারি কথা নিয়ে কেন যে ব্যস্ত সবাই! অমুকে অমুক বলেছেন, উনি এই আর তিনি সেই
বলেছেন... আহা, গানটা কী বলছে একটু শুনলে ক্ষতি হয়ে যাবে? যা বলার ছিল, সব তো
গানেই চুরি হয়ে গেল, অন্তত বোকা-বুদ্ধিতে তাই তো মনে হয়। সঞ্চারীতে এসে গেছে, চুরি
করে নিয়ে আবার চলেও যাবে, “সময় যে তার হল গত”। এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে শিউলি-ফোটার
কাল, শিউলিফুলের মরে যাওয়ারও। এই জন্যেই বোধহয় ‘ক্ষণিকের অতিথি’ নাম।
“হে
ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া”। এও ভৈরবীতে। আচ্ছা, শরৎকাল যেখানে মিশে
যায় হেমন্তের সাথে, সেই গানগুলোয় আপনি বেছে বেছে ভৈরবী লাগিয়েছেন কেন? না কি এমনি
হয়ে গেছে? কোন গুণী যেন বলেছিলেন, ভৈরবীতে
সিদ্ধ হলে সে সুরলোকের এক চরম সিদ্ধি। আপনার গানে নাকি ভৈরবীর একটা আলাদা চেহারা
আছে, পণ্ডিতেরা তার নাম দিয়েছেন ‘রবীন্দ্র-ভৈরব’। আবার আপনি বলেন, “গান প্রায়
কিচ্ছুই জানি নে বললেই চলে”। না জেনে যদি এই হয়, অর্বাচীনের পক্ষে মন্দ কী! ও হো
হো, ভৈরবীর মোচড়গুলো কীভাবে লেগেছে সুরে! ঋতুরঙ্গশালার নটরাজ, জীবন-মরণের দেবতা
নিজেই না পাগল হয়ে যান! তা না হলে কি আর বলেন অমন করে, “শিশির শুকিয়ে যায়, শিউলি
ঝরে পড়ে, আশ্বিনের সাদা মেঘ আলোয় যায় মিলিয়ে। ক্ষণিকের অতিথি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আসেন।
কাঁদিয়ে দিয়ে চলে যান। এই যাওয়া আসায় স্বর্গমর্ত্যের মিলনপথ বিরহের ভিতর দিয়ে খুলে
যায়।” অজস্র মীড় আর স্পর্শস্বর, ধরা দিয়েও হারিয়ে যাওয়া আর মিলনছলে বিরহ আনার মায়া
বুঝি এমন করেই তুলে আনতে হয় গলায়? “চলেছ পথিক আলোকযানে/ আঁধারপানে/মন ভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া” - তারসপ্তকে
কোমল গা আর কোমল রে ছুঁয়ে আলোর ভেলায় চড়ে আঁধারের দিকে যাওয়া। সেই যাওয়ার সঙ্গী
যদি হয় গান, তাতে ভয় নেই কিছু। এ আঁধার নিজেকে হারিয়ে ফেলার নয়, নিজেকে খুঁজে
পাবার।
এ গান
সম্বন্ধে সাহানা দেবীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন আপনি, “হে ক্ষণিকের অতিথি” মণ্টু
(দিলীপকুমার রায়) সেদিন গেয়েছিল... তার মধ্যে ও যে ধাক্কা লাগিয়েছিল সেটাতে গানের ভাবের চেয়ে ভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছিল।
দেখলুম শ্রোতাদের ভালো লাগল। গানের প্রকাশ সম্বন্ধে গায়কের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
অবশ্য মানতেই হবে। অর্থাৎ গানের দ্বারা গায়ক নিজের অনুমোদিত একটা বিশেষ ভাবের
ব্যাখ্যা করে - সে ব্যাখ্যা রচয়িতার অন্তরের সঙ্গে না মিলতেও পারে। গায়ক
তো গ্রামোফোন নয়।” গায়ক যদি গ্রামোফোন না হন, শ্রোতারও নেহাত ‘সাউণ্ড ক্যাচার’
হবার দায় নেই। অনুভবের স্বাধীনতা তারও আছে। কোন এক অর্বাচীন যদি মনেও করে গানটা তার প্রাণে লাগল কিনা সেটাই বড় কথা,
খুব একটা দোষ হয় কি তাতে?
এই
গানটা শুনলে একটা ছবির কথাও মনে পড়ে। তপন সিংহের ‘ক্ষণিকের অতিথি’। আপনার গল্প
নিয়ে ছবি হলে তাতে আপনার গান ঢুকিয়ে দেয়
সবাই, সে তো চেনা ছক। কিন্তু অন্য গল্পেও যে এমন করে সবটুকু জুড়ে থাকতে পারেন
আপনি, থাকতে পারেন মানুষের জীবনবোধের সঙ্গে একাকার হয়ে - এরকম
এক-একটা খুব সাধারণ মানুষেরও ভাল লাগার মত ছবি তা বুঝিয়ে দেয় হঠাৎ করে, তার জন্য
বিরাট কিছু আয়োজন, প্রতীক, ইঙ্গিতময়তা লাগে না। একটা নিটোল জীবনের গল্প, তাতে
ওঠাপড়া আছে, হাসিকান্না, ব্যাধি-শোক আছে - কিন্তু সবটাই খুব
বাস্তবঘেঁষা। অথচ একটানা দেখলে একটা কবিতার আমেজ আসে। শুনেছি, ছবির রাফ প্রজেকশন
দেখার পর সংগীত পরিচালক বলেছিলেন পরিচালককে, “এ তো কাব্য। আবহে আমি রবীন্দ্রসংগীতই ব্যবহার করব।” তা-ই
করেছেন, ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’র সুরকে ভেঙে, গলিয়ে, খেলিয়ে কত রকম ভাবেই যে ছড়িয়ে
দিয়েছেন পুরো ছবি জুড়ে।
আর একটা গানও খুব টানে, “আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কি জানি পরাণ কি যে চায়।” আজ শুধু নয়, শুধু এই সকালটায় নয়, অনাদি অনন্তকাল ধরে এটাই তো বুঝে ওঠা দায় - কী জানি পরাণ কী যে চায়। সব আছে, তবু কী যেন নেই, কে যেন নেই! এতখানি অজানা ব্যথার মীড়ে, সোনালি রোদ আর সবুজ ঘাসের পরিপূর্ণতার মাঝেও আবছায়ার মত এক শূন্যতাকে ধরে ধরে চেনায় যে ঋতু, সে কি শুধুই শরৎ, না কি শরতের আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকা হেমন্তও? স্বরবিতান বলেছে, এ গানের সুর বিভাস-বাউলে বাঁধা। ‘জীবনস্মৃতি’তে আপনি আবার নিজে বলেছেন, যোগিয়া। সুরান্তর, পাঠান্তর এসব তো আছে। কিন্তু ভাবে যে এই মন-কেমন করা, তার চেয়ে বেশি কিছু কি সত্যি লাগে গানটায় প্রাণ ফোটাতে? “সদা ভয় হয় মনে পাছে অযতনে মনে মনে কেহ ব্যথা পায়!” সাহস করে ভেবেই ফেলি, এই ‘কেহ’ কি কোন এক অর্বাচীন? সে যদি ব্যথা পায়, তাতেও এত চিন্তা আপনার? অর্বাচীনের জন্য এত দরদ - ভাবা যায় না! আর অভিমান না-ই বা করলাম! হেমন্তকে এমনি এমনি সরিয়ে তো রাখেননি আপনি, যার স্বভাবের মধ্যেই ‘আপনাকে এই... গোপন করে রাখা’, তার প্রকাশ কি এত সোজাসুজি হবে?
অনেক কাজ আছে, গান শোনা থামাতে হয় এবার। এতক্ষণ বলতেই ভুলে গেছি, গানগুলো যাঁর গলায় শুনছিলাম, তিনিও তো হেমন্ত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনের প্রথাগত প্রশিক্ষণের ছাপ না থাকলেও যিনি রবীন্দ্রসংগীতের অন্যান্য মহাশিল্পীদের সঙ্গে একাসনে বসতে পারেন অনায়াসে, যাঁকে দেবব্রত বিশ্বাস বলেন ‘রবীন্দ্রসংগীতের সেকেণ্ড হিরো’। বড় আপসোস হয়, হেমন্তকালের ওই চারটে গান কেন যে রেকর্ড করে গেলেন না তিনি! নাকি শিল্পী হিসেবে স্রষ্টাকে আত্মস্থ করে - যা গাওয়ার, যা বলার, যা দেওয়ার - তা ঢেলে দিয়ে গেছেন তিনি এই শরতের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হেমন্ত-গানের মধ্যেই? কে জানে, হয়ত এও এক ধরনের শৈল্পিক অভিমান! অর্বাচীন কি আর অত বোঝে?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন