কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

অম্লান বোস

যাদুসম্রাট… একেবারে খাঁটি




তখন আমি স্কুলে পড়ি, ৭-৮ বছর বয়স হবে। ইস্পাতনগরী জামশেদপুরের  দূষণহীন আবহাওয়া, সারি সারি ছবির মতো কোয়ার্টারের রঙীন অঙ্গন আর ঝকঝকে রাস্তার দুপাশে শ্রেণীবদ্ধ সবুজের সমারোহ। সঙ্গে মা মাসীদের মাত্রা ছাড়া স্নেহ আর আদরের বন্যা।

গরমকালে প্রচন্ড গরমের অত্যাচার আর স্বয়ং স্যার জামশেদজী নসরভানজী টাটার অভিনব অভাবনীয় প্রগতিশীল চিন্তাধারার রৌদ্রছায়ায় বড় হচ্ছি। নানা কারণে, হয়তো পড়াশোনা, খেলাধূলা, গানবাজনা, নাটক, সামাজিক কার্যকলাপ - এসবের উৎকর্ষতার জন্যেই আমাদের ‘বসুভবন’ তখনকার জামশেদপুর মহলে যথেষ্ট আলোচিত ও সন্মানিত ছিল। এসব আপাত অবান্তর কথায় চিঁডে  ভেজানোর একমাত্র উদ্দেশ্য কিন্তু এটাই জানানো যে, আমাদের বাড়িতেই কেন এতসব গুণীজনের সমাবেশ হত। জামশেদপুরের আদি দূর্গাপূজোতে, যেটা পরে বিবেকানন্দ সোসাইটি থেকে উঠে এসে আমাদের বাড়ির ৫০০ মিটারের মধ্যেই এসে গিয়েছিল, আমাদের পরিবার এতটাই জড়িত ছিল যে মানুষেরা ভালবেসেই বলতেন - এই পূজোটা তো বসুভবনের পূজো! ভাল তো লাগতোই, খুব লজ্জাও করতো এইসব নি:স্বার্থ প্রশংসায়। এই উক্তিতে কিন্তু কণামাত্র হিংসা বা সমালোচনার ছায়া পর্যন্ত থাকতো না। নানারকম কারণেই, মানুষজনের নি:স্বার্থ উপকার করা, দুর্দ্দশায় সবচেয়ে আগে ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়ান, স্নেহ আর পক্ষপাতিত্বহীন শাসনের মিশ্র উপাদানে নেতাজীর আশীষধন্য মহিলাসমিতির সভাপতি, আর রন্ধনবিশারদ হিসেবে আমার মহিয়সী মা ছিলেন অসামান্যা বরেণ্য নারী। সার্বজনীন নীহার মাসীমা আর নীহারদি।

জামশেদপুরের বিষ্টুপুর এলাকাতে মিলনী ক্লাব তখন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সন্মেলনের কেন্দ্র ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগীতশিল্পী, লেখক, ক্রীড়া জগতের মানুষ, বক্তারা আমন্ত্রিত হতেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই বসুভবনে  রাত্রিযাপনও করে গেছেন। আমরা সৌভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়িতেই পেয়েছিলাম সর্বশ্রী পি সি সরকার, লেখক মণিশংকর, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেন, সুচিত্রা মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন চৌধুরী, আলপনা ও প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর (খুব ছোটবেলায়), বসন্ত চৌধুরী (ইনি অবশ্য আমাদের জাকার্তার বাড়িতেই) দের সান্নিধ্যধন্য হয়েছিলাম। বরেণ্য  শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন আমার স্ত্রী রীতার মামা। এছাড়া বলতে গিয়ে  আনন্দে চোখে জল চলে আসে - স্বর্গের আশীর্বাদ নিয়ে স্বয়ং আনন্দময়ী মা বসুভবনকে ধন্য করেছিলেন। প্রসঙ্গত একবার ট্রেনে আমাদের কুপেতে ‘মা’র  এক বর্ষীয়ান ভক্ত, উনি আমাদের বাসস্থানে পদধূলি দিয়েছেন শুনেই, প্রায় আমার পায়ে পড়তে বাকি রেখেছিলেন। আমরা নাকি স্বয়ং ভগবানের দর্শন এবং সঙ্গলাভ করেছি! এছাড়া জীবনে চলার পথে দেখা এবং অন্তরঙ্গ ভাবেই বাক্যবিনিময় হয়েছে মাননীয় সত্যজিৎ রায়, কিশোরকুমার, শশী কাপুর, শৈলেন মান্না, রুণু গুহঠাকুরতা, বুদ্ধদেব গুহ, শ্যামল মিত্র, সৈকত মিত্র এবং আমার এই ক্লান্তিকর ঢাক পেটানো তালিকা শেষ করার আগে - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

প্রসঙ্গত আমার স্মৃতিচারণায় বিশ্ববরেণ্য যাদুসম্রাট পি সি সরকারের কিছু কথা বলা যাক।   

আমাদের বাড়িতে সাধারণ শার্ট প্যান্ট পরেই এসেছিলেন তিনি। এমনিতে পাগডী  আর চকচকে চোগা চাপকান ছাড়া দেখলে চট করে চেনা মুস্কিল। আধা ওপার-বাংলার কথার টানে বিশুদ্ধ বাঙালি। যাইহোক সাধারণ সৌজন্য বিনিময় আর কথাবার্তার পরে উনি চায়ের টেবিলে এলেন। সেই ঘরে আমাদের স্কুলে প্রাইজ পাওয়া বইয়ের লাইব্রেরি আর খেলাধুলোর স্মারক ট্রফি আর মেডালগুলো (তখন বেশীরভাগ রূপোরই থাকতো) দেখে খুবই বিস্ময় এবং আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। আমার কৌতূহলী চোখদুটো কিন্তু তখন ওঁর হাতদুটোর ওপর - এই হাতের কারুকার্যেই তো ইনি বিশ্বজগৎকে মায়াচ্ছন্ন, স্তম্ভিত করে রাখেন!

মা তো ডালে ঠাসা মশলায় মশগুল ডালপুরী, চমচমে আলুর দম, মাংসের চপ্, মাছভাজা, ছানার জিলিপী আর পাটিসাপ্টা বানিয়েছেন। ভাবছিলেন বোধহয়, যাদুবলেই এসব সামগ্রী নিমেষে (উদরগহ্বরে) অদৃশ্য হয়ে যাবে। তখনকার দিনে কনভেন্ট শিক্ষিতা, ভাষাবিদ এবং সংগীতজ্ঞা, স্বর্গীয় দিলীপকুমার রায়ের স্নেহধন্যা ছাত্রী আমার বড়বৌদি এবারে সম্মিলিত খাদ্যসম্ভার নিয়ে দুহাতের, পায়ের এবং শরীরের ভারসাম্য সামলে স্তূপ নামালেন টেবিলে, অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে। লক্ষ্য ছিল, শ্বশ্রূমাতার উপস্হিতিতে যেন তাঁর স্বল্পায়তনের ঘোমটা স্হানচ্যূত না হয় এবং সেটা সিদ্ধ করার জন্যে কাঁধ এবং হেলানো মাথার যোগাসন ছন্দটা ছিল অসামান্য। যাদুসম্রাট তো সকলকেই অবাক করে সন্মোহিত করে রাখেন তাঁর মায়াজালে। এখন কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হল, তিনি নিজেও হতবাক হতে পারেন। আমরা পরিবারের সবাই টেবিলের আশেপাশে জায়গা করে নিয়েছি। ছিলেন না বড়দাদা এবং ছোটভাই পঞ্চম।

চায়না বোনের (তখন খুবই বিরল ছিল। পরে একটা পেয়ালাতে কাজের কাকু  একটা চিড ধরাতেই বৌদির কিঞ্চিৎ উষ্মা বর্ষণ মারফত এই সত্যটা জানতে পেরেছিলাম) টি -পট থেকে তরল সুগন্ধি সোনার ঢল সরু ধারায় ঢালছে আমার  দিদি, কতটা দুধ আর কতটা চিনি জিজ্ঞাসার কোন সদুত্তর না পেয়েই। ততক্ষণে  যাদুসম্রাট আভ্যন্তরীন ভারে জর্জরিত একটা স্বাস্হ্যবান মোটামুটি ঘ-সিক্ত গোটা ডালপুরী তুলে নিয়ে বললেন, “এই যে, এটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম তো!”  মুখে উঠেছে কি ওঠে নি, একেবারে অকস্মাত আমার মেজদাদা শক্তপোক্ত একটা কালো কাপড় দিয়ে যাদুসম্রাটের চোখদুটো আচ্ছা করে বেঁধে দিলেন পেছন থেকে। হঠাৎ চায়ের টেবিলে বিপর্যয়। প্রসঙ্গত, আমার মেজদাদাও যাদুবিদ্যা শিখতে শুরু করেছিলেন তখন। মেজবৌদি বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, এবারে আপনি চা আর পছন্দমত খাবার নিয়ে শুরু করুন মি: সরকার। আপনার তো কোন সমস্যাই নেই! সেদিনই তো লন্ডনের রাস্তায় চোখ বেঁধে সাইকেল চালালেন  দেখলাম”। আমাদের চোখেমুখে তখন উৎসুক কৌতূহলের অপেক্ষমান চাউনি। স্টেজ নেই, পোশাক আশাক, আলো আঁধারীর খেলা নেই - দেখি না মানুষটা কী করেন!

গভীর দু:খে হতাশ হয়ে বাঁধা চোখে চারদিকে তাকাতে তাকাতে নিজস্ব উচ্চারণে বলে উঠলেন, “আপনি কোথায় মাসিমা? দেখুন তো, বাড়িতে ডেকে এনে দুম করে চোখ বেঁধে দিলো, এ কিন্তু ঘোর অন্যায়!” মা জননীর সশঙ্ক স্নেহাতুর দৃষ্টি  সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ততক্ষণে রাঙাদা যথাসম্ভব দ্রুতহাতে, নি:শব্দে কাপডিশ দুটো এক দেড় ফুট দূরে সরিয়ে কাপের হাতলটা নব্বই ডিগ্রী ঘুরিয়ে গরম টি-পটটাকে কাপের জায়গায় বসিয়েছে। “আপনার তো এক্স-রে আই, চোখে দেখার কী দরকার? মেজবৌদির গলায় একটা হাল্কা চ্যালেঞ্জের আভাসন।

মাত্র চার-পাঁচ সেকেন্ড। ডানহাতের আস্তিনটা গোটাতে যতক্ষণ লাগে, হতাশ গলায় একবার ‘মাসীমা’ বলেই অত্যন্ত স্বাভাবিক ঢঙে সামনে রাখা টি-পটটা ডিঙিয়ে হাত বাড়িয়ে চা-ভর্তি কাপটা সুবিধে মতন ঘুরিয়ে নিলেন, দুধের পট নিয়ে একটু ঢাললেন চায়ে, চামচের স্ট্যান্ড থেকে চামচ নিয়ে সাধারণ ভাবেই নাড়িয়ে কাপটা হাতে নিয়ে, ঠিক মা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেইদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “মাসীমা, ছেলেকে বলুন টি-পটটা সরিয়ে দিতে, কাপটা রাখবো”। আমরা দৌড়ে পালাব না হাততালি দেব বুঝতে পারার আগেই আমার ছোড়দি ছোট্ট একটা ডায়েরী আর পেন নিয়ে যাদুকরের পাশে দাঁডিয়ে পড়েছে।

“একটা সাইন করে দিন না কাকু!”

‘কাকু’ চোখের বাঁধনটা খোলার অভিনয় থেকে বিরত হলেন, হাতটা যে কোন অন্ধ ব্যক্তির মতই একদম উল্টোদিকে বাড়িয়ে নাড়াতে নাড়াতে বললেন, “দাও, দাও - না করলে তো আমার এগুলো টেস্টই করা হবে না!”

টেবিলের ওপর ছোট ডায়েরীটা নিয়ে অবলীলাক্রমে একটা সুন্দর গোলাপ ফুলের ঝকঝকে ছবি, ডাঁটায় ছোট ছোট কাঁটা, ছোট বড় পাতা, কোনটা সোজা কোনটা আবার নিম্নমুখী বা একটু বেঁকে ওপর দিকে মুখ তুলে। তার পরে আঙ্গুলের বেস্টনীতে ধরা পেনটা নীচে নেমে এল, পাতার নীচের দিকে একটানে লেখা হয়ে গেল পি সোরকার - অবশ্যই ইংরেজী হরফে। ‘পি লিখে একটা টান দিয়ে সরকারের ‘এস’, তারপর ‘সরকার’ লেখা শেষ করে ঐ টানা দাগটার নীচে ফিরে এসে একটু ছোট অক্ষরে ‘সি’। এক থেকে দেড় মিনিট, পেনটা একমূহূর্তের জন্যে থামলো না, আঙ্গুলের বাঁধন ছাড়িয়ে নিমেষের জন্যে বিপথগামী হল না। জলজ্যান্ত ম্যাজিকই দেখলাম চোখের সামনে দু’তিন ফুটের মধ্য দাঁড়িয়ে।

“থাক, অনেক হয়েছে” বলে চোখটা এবার মা এসে খোলার চেষ্টা করছেন, তখন মেজদাদাই এগিয়ে এসে ওটা খুলে দিলেন। এরপরে অবশ্য ডালপুরী আলুর দমের যাত্রাপথে আর কোন বিঘ্ন ঘটে নি এবং তারপরে বেশ কয়েকটা অসাধারণ ম্যাজিক আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, উনি রাঙাদাকে মনোনীত করে গেলেন পরের দিন ‘মিলনী’তে ওকে সম্মোহিত অবস্হায় তিনটে  ধারালো খাড়া তরোয়ালের ওপরে শুইয়ে একটা একটা করে তরোয়ালগুলি সরিয়ে নেবেন। অবশ্যই, সামান্য শিক্ষানবিশীর পরেই। ‘মিলনী’র আলো আঁধার প্রেক্ষাগৃহে করলেনও তাই, তবে দুটোকে সরিয়ে দিয়ে মাথার নীচের তৃতীয়টা  ইচ্ছে করেই সরালেন না। দর্শকদের বললেন, “এ আমার দলের ছেলে নয় তো, তাই এটা আর সরালাম না। সবসময়েই আমি কিন্তু সবকটি তরোয়াল সরিয়ে দেহটাকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখি”।

তারপরেই মঞ্চের কোণায় গিয়ে স্বভাবসিদ্ধ হাসি ছড়িয়ে ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’। ছোট্ট কমন্ডলুর মত ঝকঝকে জাগটা থেকে নবম-বার প্রায় হাফ লিটার মত জল  আবার ঢেলে নিলেন এবং শো-এর শেষপর্যন্ত বারবার ঐ একই কাজ করে গেলেন।

বহু বছর পরে রাঙাদার মেয়ে নীলাঞ্জনারা ওনাকে প্ল্যানচেটে ডেকেছিল আমাদের  ঐ বাড়ির নিচের মহলে। জানতো না, উনি এসেছিলেন বসুভবনে। শ্রীসরকার কিন্তু ওদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর বসুভবনে আসার কথা। 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন