বিজ্ঞাপন, নাকি সাম্প্রদায়িক বিভাজন?
বিজ্ঞাপনের শুরুতে দেখানো হচ্ছে যে, বাড়িতে উৎসবের আবহ। এক গর্ভবতী মহিলার সমস্ত বিধি মেনে ‘সাধ’ দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটি এই আয়োজন দেখে অবাক হয়ে তার শাশুড়ি-মা’কে জিজ্ঞাসা করল যে, আপনাদের মধ্যে তো এই রীতি পালিত হয় না তাহলে?
তার
উত্তরে শাশুড়ি মা হেসে উত্তর দেন, মেয়েকে খুশি
রাখার রীতি তো সব বাড়িতেই পালিত হয়।
এই বিজ্ঞাপন নিয়ে দুটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। কেউ বলেছেন, এতে সমস্যার কী আছে? একটি বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে যদি ধর্মীয় ঐক্য তুলে ধরা হয়, তাহলে এত ক্ষুব্ধ হওয়ার কী আছে? আবার অনেকে বলছেন, ফালতু বিতর্ক। বিজ্ঞাপন নিয়ে এত কেউ ভাবে না।
যারা এই বিজ্ঞাপনের বিরোধী, তাদের যুক্তি ভিন্ন। তাদের মতে এই বিজ্ঞাপন লাভ জিহাদ প্রচার করছে। এত ধর্মীয় সম্প্রীতি দেখানোর যদি প্রবল ইচ্ছা, তাহলে এটা দেখানো হচ্ছে না কেন যে একটি মুসলিম মেয়ে বিয়ে করে হিন্দু বাড়িতে এসেছে, আর হিন্দুদের কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করছে! ধর্ম সহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতার সব দায় কি একা হিন্দুদের? কেন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে?
বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে যখন টাটা সংস্থার পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, যদি তারা কারোর ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করে থাকেন, তাহলে তাঁরা দুঃখিত। তখন অনেকেই টাটার এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেন। তাঁদের মতে ভারতবর্ষে মুসলিম ছাড়াও আরও অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে। কই তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া নিয়ে তো বড় ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো এতটা চিন্তিত নয়! তাহলে এই বৈষম্য কেন?
এই নিয়ে নানান চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন তুলে ধরা হয় যা নিয়ে অনেকে বিতর্ক অতীতে বা সাম্প্রতিককালে হয়েছে। এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য সেই দীর্ঘায়িত ও বিতর্কিত আলোচনা নয়। এই বিজ্ঞাপনের ফলে জনগণের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তার দিকে তাকিয়ে টাটার মতো একটি বড়ো বাণিজ্যিক সংস্থা বিজ্ঞাপনটি তুলে নিল। অর্থাৎ এর থেকে ধরে নেওয়া যায়, বিজ্ঞাপন জনগণের মতামত প্রভাবিত করতে বেশ সক্ষম। ঠিক পথে চালনা করলে সামাজিক পরিবর্তনও আনতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন হল, এরকম একটা শক্তিশালী মাধ্যমের দ্বারা বহু বছর ধরে
ফর্সা রঙকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলাদের কেবল সাংসারিক সমস্ত কাজ করার যন্ত্র ভাবা, সামান্য সুগন্ধির দ্বারা নিজের বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করা - এরকম অজস্র বিষয় আছে যেগুলো শুধুমাত্র হাস্যকর নয়, নিন্দনীয়ও বটে।
কই এই ধরনের বিজ্ঞাপন নিয়ে তো প্রতিবাদ হয় না? যেখানে দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনগুলো বলছে, কর্মগত বা শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, উচ্চতায় পৌঁছতে গেলে লাগে কেবল গৌরবর্ণ। এই ধরনের বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে এইরকম জোরালো প্রতিবাদ হয় না কেন? যাতে বিজ্ঞাপনগুলো তুলে নেওয়া হয়!
তাহলে প্রশ্ন একটাই থেকে যায়, আমাদের আপত্তি বা মতামত তখনই প্রকাশিত হয় যখন আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বৃক্ষের মূলে আঘাত লাগে? বাকি সময় এত উদাসীন কেন? ধর্মের উসকানি দিলে যে রাগ, ক্ষোভ, প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, অন্য অনেক গুরুতর বিষয়ে সেটার অভাব বোধহয় কেন?
অন্তিমে একটাই প্রশ্ন এই বিতর্ক মনে জাগায়। ধর্মীয় বিশ্বাস কি এত ঠুনকো যে একটা বিজ্ঞাপন সেটাতে আঘাত করতে পারে বা তাকে নাড়িয়ে দিতে পারে?
যদি তাই হয় তাহলে সেটা খুব দুঃখের। যে কোনো ধর্মের মূল উদ্দেশ্য চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রদান। এই ক্ষেত্রে সেই মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন