কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

পায়েল চ্যাটার্জি

 

সমকালীন ছোটগল্প


সমস্যা

 

মনোরঞ্জনবাবু  ভারি সমস্যায় পড়েছেন। গভীর সমস্যা। সমাধান সূত্র ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই। তাঁর বর্তমান সমস্যা হল তাঁর জীবনে এই মুহূর্তে কোনো সমস্যা নেই। এমন কোনো চিন্তা নেই যা তাঁর মস্তিষ্ককে খোরাক জোগাতে পারে। সমস্যাবিহীন জীবন যেন নুন ছাড়া খাবার। রান্না হয়ে গেছে, তাই খাওয়া ভিন্ন উপায় নেই। তবে স্বাদহীন। তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত এমন অবস্থা ছিল না। সদ্য রিটায়ারমেন্টের পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা কোন ব্যাংকে রাখা সমীচীন হবে তা কিছুতেই ঠাহর করে উঠতে পারছিলেন না। বেশ সমস্যায় পড়া গিয়েছিল। শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশের সীমারেখাটা কেমন যেন লক্ষণরেখার মতো মনে হচ্ছিল। এপারে লাভের হাতছানি ওপারে লোকসানের আশঙ্কা। এই  লাভ-লোকসানের দোলাচলের কাটাকুটি খেলায় চিন্তার খোরাকটা ভালই জোগাড় হচ্ছিল। গিন্নির সঙ্গে বসে ব্যাংকের ম্যানেজারদের ফোন করা, তারপর নানা ওয়েবসাইট দেখা। মাথায় কিলবিল করে ঘুরছিল নানা চিন্তা। কিন্তু সে আর ক'দিন। কিছুদিন পরেই সব সমস্যা মিটে গেল। টাকা নির্দিষ্ট জায়গায় তার আবাস গড়ে নিল। রিটায়ারমেন্টের পর কাগজপত্র সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যাও বেশ নির্বিঘ্নেই মিটে গেল। তাই মস্তিষ্কের অবকাশ। অসহ্য হয়ে পড়ছিল মনোরঞ্জনবাবুর কাছে।  

আসলে ছোটবেলা থেকেই নানা সমস্যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে জীবন কেটেছে ওঁর। এই যেমন খেলেই পেটের গন্ডগোল, আবার কোন সুস্বাদু খাবারের গন্ধ ও পেট পর্যন্ত না পৌঁছলে পরিপাকযন্ত্রের মুখভার।  তাই কোন আনুমানিক সুস্বাদু খাবার দেখলেই চিন্তারা মাথার মধ্যে মিছিল শুরু করে দিত। নানান চিন্তার বেড়াজাল পেরিয়ে যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন মনোরঞ্জনবাবু। তারপর জুটে যেত আবার কোন সমস্যা। কম বয়সের সঙ্গে সমস্যারা কি সমানুপাতিক আচরণ করে তবে! “মানু কী সমস্যায় পড়া গেলো বল তো!” মায়ের এই কথাতেই যেন  বাঁচার স্বাদ পেতেন মনোরঞ্জন মুখুজ্জে। সমস্যাদের সবচেয়ে বেশি সঙ্গ দিত পড়াশোনা। “অংকে তোর সমস্যা তো কিছুতেই মিটছে না রে মানু!” বাবার এই কথা শুনে যারপরনাই আনন্দিত হতেন মনোরঞ্জনবাবু। নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ  জ্ঞাপন করতেন। ভাগ্যিস অংক, ইতিহাস, ইংরেজির মতো বিষয়গুলো রয়েছে!  তাই তো সমস্যারাও মনোরঞ্জনবাবুকে ত্যাগ দেয় না কিছুতেই। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বাবার জোরাজুরিতে এমন কিছু বিষয়ে পড়াশোনা করতে হল, যেগুলোতে তিনি পারদর্শী। সমস্যাগুলো সেভাবে ধরা দিয়েও ঠিক ধরা দিতো না। ভারি মন খারাপ হয়ে যেত মনোরঞ্জন মুখুজ্জের। সমস্যাবিহীন জীবনে যেন  পূর্ণতা নেই কোন। পড়াশোনার পাঠ চুকলে চাকরি বা পারিবারিক অন্যান্য দায় দায়িত্ব সামলানোর ক্ষেত্রে সমস্যারা বিশ্বস্ত সঙ্গ দিয়েছেন মনোরঞ্জনবাবুকে।

চাকরিক্ষেত্রে সমস্যাগুলো টেস্ট ম্যাচের মতো ধীরগতিতে এগোলেও বিয়ের পর  সমস্যারা যেন প্রাণ ফিরে পেল। এক্কেবারে টি-টোয়েন্টির গতি। মনোরঞ্জনবাবুর  মস্তিষ্কের তখন দম ফেলার সময় নেই। বিয়ে যে সমস্যারই নামান্তর, তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। বিয়ের পরের সমস্যাগুলোও মন্দ লাগতো না  মনোরঞ্জনবাবুর। শাড়ির রং পছন্দ না হলে গিন্নির মুখভার, অমুকের বাড়িতে গিয়ে তমুকের বউকে নাকি আড়চোখে দেখেছেন মনোরঞ্জনবাবু! তারপর আজ  সংসারের এই সমস্যা, এটা নেই, সেটা নেই এসব টক-ঝাল-মিষ্টি সমস্যাদের নিয়ে ভালোই কেটেছিল বেশ কয়েক বছর। তারপর মেয়ে হল। মেয়ের পড়াশোনা, চাকরি, বিয়ে সব মিলিয়ে সমস্যারা নিরাশ করেনি তাঁকে। তারপর  চাকরি থেকে অবসর। বিবাহিত জীবনে সমস্যারাও থিতিয়ে পড়েছে। কতবার  গিন্নির অপছন্দের মাছ নিয়ে চলে এসেছেন বাজার থেকে। পাশের বাড়ির ঘোষবাবুর বৌয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন গিন্নির সামনে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে  আগেকার মত ক্রিয়াগুলোর প্রতিক্রিয়া থাকে না। তবে কি সমস্যারা বিদায় নিল মনোরঞ্জনবাবুর জীবন থেকে! কেমন করে বাঁচবেন উনি! কেমন নিস্তরঙ্গ জীবন! বুদবুদের মত ক্ষণস্থায়ী ইচ্ছেরা! সব যেন পানসে!

“নীরা ফোন করেছিল, ভালো খবর আছে, নতুন অতিথি আসছে, সামনের  মাসেই এখানে আসছে, এখন থাকবে”। গিন্নির কথায় যেন কিসের গন্ধ পেলেন  মনোরঞ্জনবাবু। অনেকদিন পর। তাঁর মেয়ে নীরা সন্তানসম্ভবা। একটা ছোট্ট পুতুল। আনন্দের পুঁটুলি। তাদের যত্ন নিতে হবে। আদর-আপ্যায়ন। খাওয়া-দাওয়া। তারপর পুঁটলিটা চলে এলে, কত দায়িত্ব! নানা উপাচার। সমস্যারা  আবার বাসা বাঁধতে শুরু করেছে মনোরঞ্জনবাবুর মস্তিষ্কে। মাথায়, নাকি মনে?  কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমস্যারা। এতদিন পর নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে মনোরঞ্জন মুখুজ্জের। আর সমস্যাবিহীন জীবন কাটাতে হবে না বোধহয়!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন