সমকালীন ছোটগল্প |
জগতে
আনন্দযজ্ঞে
-প্রতিটি
হোটেলের ঘরের লাগোয়া যে ওয়াশরুম, তার আয়নায় দেওয়ালে একটি টিপ লেগে থাকে। টিপগুলি প্রায়শ
ফ্যাকাশে লাল। বিকেল-সন্ধের সূর্যর মতো, ছেতরে যাওয়া লাল। যারা চলে গেছে, তাদের ছায়া
ওই টিপের মধ্যে রয়ে যায়।
-চলো,
বাইরে গিয়ে বসি। হিম পড়ছে, চাদর জড়িয়ে নাও। সকালে এই সামনের পর্দা সরালে সূর্যোদয় দেখতে
পাবে। আর ওই টিলার উপর দাঁড়ালে বাংলাদেশ।
-বাঃ!
তারা ফুটেছে অনেক! তুমি যাও, আমি খাবার অর্ডারটা
দিয়ে আসছি৷
-
এসোই না। ওসব পরে হবে। এখন হাঁটতে ইচ্ছে করছে বাইরে খানিক। এই অন্ধকার…
কী
বিপুল! আর আমরা কি ছোট, না? তোমার ওই টিপের
চেয়েও। ইন ফ্যাক্ট পুরো গ্রহটাই, ওই টিপের
মতো…
-কিন্তু
আমি ওর মধ্যেই শেষবেলার সূর্য দেখলাম। ওর গায়ে ক্লান্তি ছিল, অবসাদ ছিল।
-একটা
কথা বলতে ভয় পাচ্ছি অনেক দিন ধরে। আমার মনে হয়, তুমি ভালো নেই। দেখাচ্ছ, ভালো আছ। কিন্তু
আসলে ভালো নেই। নিরানন্দই মূল সুর।
-ভালো
নেই বলতে?
-তোমার
কথায় ক্লান্তি আর অবসাদের কথা প্রায় আসে ঘুরে-ফিরে৷ মৃত্যুও আসে।
-হ্যাঁ,
মৃত্যু। এক্স্যাক্টলি। ওই টিপে নিভন্ত চুল্লির আগুনও ছিল। একটা গোটা মেয়েকে ঢুকিয়ে
দিল ঘটাং শব্দে। ‘কমরেড লাল সেলাম’ শোনা গেল। চুল্লিমুখেও ওরকম লাল ছিল। মেয়েটিকে আমি চিনতাম। কিছু মৃত্যু
থাকে, যার জন্য কোনো প্রস্তুতি থাকে না। আনপ্রেডিক্টেবল। মনে হয়, ওর যদি এই পরিণতি
হয়, আমার তবে কেন নয়? জীবনের সঙ্গে বাঁধন আলগা হয়ে যায় এইভাবে।
আবার
যাকে চিনতাম না, গমখেতে পুলিশ গোপনে পোড়াচ্ছিল যার দেহ, তার চুল্লিতেও মরা লালিমা ছিল।
তা দেখলে মনে হয়, আর ক’টা দিন বেঁচে যাই। কিছু জরুরি কাজ আছে, করে যাই।
-অবশ্যই
করবে কাজ। কিন্তু অবসাদ এলে করবে কী করে? এই যে এখানে এলে, এ বিশালতা স্পর্শ করছে কি
তোমায়?
-বা
রে! অনেককেই তো করে না! যারা সাধারণ। সেটা কি অসুখ?
-না।
তারা যদি তাতেই ভালো থাকে, তবে অসুখ কেন হবে? কিন্তু আমার ধারণা, তুমি খারাপ আছ। সবাই
যা জানে তোমার সম্পর্কে, তা আবরণ মাত্র, তুমি নয়। সাহস, প্রতিবাদ - শুধু এগুলো দিয়ে মেপে ফেলা যায়
না... ওগুলো সরালে অনেক ক্ষয় দেখা যাবে। কষ্ট পেয়েছ। চেপে রেখেছ। সাবলাইমেট করেছ শুধুমাত্র
একই রকম কষ্টে থাকা লোকজনকে সাহায্য করে। সেটা সেরে ওঠার উপায় হিসেবে মন্দ নয়। তাতে
ভালোই হয়েছে। কিন্তু মুশকিলও আছে। একই রকম ঘটনা রোজ দেখতে দেখতে তোমার ট্রিগারও হয়।
প্রতিদিন হয়। তুমি স্বীকার করো না। তুমি নৈর্ব্যক্তিক হতে পারো না। তোমার অতীত মনে
পড়ে। কিছু ক্ষত হাঁ-মুখ আছে। তাতে রোজ নতুন
আঘাত। আচ্ছা, সবাই তোমাকে বিরোধিতামূলক কাজে ডাকে কেন?
-কারণ
বিরোধ দরকারি। দ্রোহ দরকার।
-অথচ
সৃষ্টির মূল সুর আনন্দ।
-সে
তো এক নির্দিষ্ট দর্শন বলে। কারণ সে দর্শন অনেক বড় কিছুকে খোঁজে। যা আমার ধরাছোঁয়ার
বাইরে। আমার দর্শন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে। একটা নির্দিষ্ট ছোট গ্রহের এক ছোট কোণের
ছোট শ্রেণি বা লিঙ্গের যাপন ঘিরে। সেটা হয়ত তোমার কাছে সামান্য।
-না।
গুরুত্বপূর্ণ। অস্বীকার করি না যে পরম সত্যের প্রতি একটা আকর্ষণ আমার ছিল। যেমন, তোমাদের
মতে, প্রিভিলেজড মানুষদের থাকে। মনে হত, আমরা ছোটখাটো ঝঞ্ঝাটে মেতে আছি। আমাদের সব সমাজনীতি, রাজনীতি
খুদে টিপের চেয়েও ছোট জায়গাটুক ঘিরেই তো, বলো! ডাইভার্শন মনে হত। যেন এসব ষড়যন্ত্র,
এরা বৃহৎ কিছুকে স্পর্শ করতে দিচ্ছে না। ধরো, সত্যকে। সত্য কী তোমার কাছে?
-যা
অপরিবর্তনীয়, পরম, চিরন্তন ইত্যাদি। তাই তো? কিন্তু এমন কোনো সত্য আমি চিনি না। আমার
সব সত্য স্থানিক। আমার কাছে এমন সত্য শুধুই থিয়োরেটিকাল ট্রিটিজ।
-তুমি
মনে হয় আমার মতো প্রিভিলেজড মানুষদের ঘৃণা করো, তাই না? আমরা কোনো কাজে লাগি না, শুধু
বায়বীয় ভাববাদী সত্য নিয়ে পড়ে থাকি?
-না।
ঘৃণা করি না। ঈর্ষা করি। এই যে আমার স্থানাঙ্ক আমাকে তোমার মতো করে ভাবতে দিচ্ছে না,
তার জন্য তোমাকে ঈর্ষা করি। এই যে তুমি যখন পর্দা সরিয়ে তারা ভরা আকাশ দেখো, তখন আমি
টয়লেটের টিপে আটকে যাই, এই তফাতের কারণে ঈর্ষা করি। কিন্তু তারপরেও আটকে থাকি স্বেচ্ছায়।
পৃথিবীতে সবকিছু পার্থিব প্রয়োজনে ঘটে না তো। সত্যানুসন্ধান তেমনই হয়ত। আনন্দানুসন্ধানও। প্রয়োজনের কাজগুলো না হয় আমি করি।
আমার বোনকে পিটিয়ে মারবে, আমার সন্তানতুল্যকে
ধর্ষণ করবে, আর আমি ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ পার্টিসিপেট করব, এ হবে না আমার দ্বারা।
-ভুল
বুঝছ। আমি কোনো আনন্দকে বা সত্যকে ছুঁয়ে ফেলিনি। চেষ্টা করেছি মাত্র, কখনও সখনও। তুমি,
তোমরা যা যা করছ, তা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
কিন্তু যেহেতু তা করছ আউট অফ অ্যাংগার... ক্রোধ যে পাত্রে থাকে, সে পাত্রকে
ক্ষইয়ে দেয়, জানো তো? ...তাই তুমি অস্থির, দুঃখী। তা বাইরে থেকে লোকে বুঝতে পারে না।
আমি পারি। একই কাজ আনন্দের সঙ্গেও করা যায় না?
-যায়?
ক্রোধ ছাড়া দ্রোহ হয়?
-হয়
না, না? কি জানি! আমার রাগ আসে না।
-তাই
তোমার দ্রোহ নেই। কষ্ট পেলেও ক্ষমা করে দাও। তুমি ভীষণ ক্ষমাশীল, তা আমি জানি। তাতে
শান্তি পাও? ব্যক্তি হয়ত শান্তি পেতেও পারে এভাবে। কিন্তু যদি অনেকে একইভাবে খারাপ
থাকে? যদি একটা পুরো সিস্টেমকে উপড়ে ফেলতে হয়? রাগ লাগবে না?
-সিস্টেমের
প্রতি রাগ থাকুক। কিন্তু মানুষের প্রতি প্রেম ছাড়াও দ্রোহ হয় কি? ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি। আচ্ছা ধরো, নির্যাতককে
যতটা ঘৃণা করো, আর্তকে তার চেয়ে বেশি ভালেবাসা যায় না? কাজ অপরিবর্তিত থাকে। বদলে যায়
ভঙ্গি।
-কে
জানে! রাগ তো হয়। কান্নাও পায়।
-আচ্ছা
তোমার জীবৎকালে যদি সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়, তারপরে তোমার লেখারা কী বলবে? গল্পের
চরিত্ররা কী করবে?
-
আমি বেঁচে থাকতে তেমন হবে না।
-ধরো
যদি হয়, তাহলে? তারপরে কী? তারপরের পৃথিবীটা নিয়ে কী ভিশন?
-এঁকে
রাখা হয়নি পুরোপুরি।
-আমি
নিশ্চয় অরাজনৈতিক, অনৈতিহাসিক কথা বলে ফেলেছি অনেক।
-না
না, বলো। মতের অমিল হতেই পারে।
-অমিল
কোথায়? অমিল যে নেই, তা বোঝাবার জন্যই জানতে চাইছিলাম, পৃথিবীতে সাম্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তোমার বা তোমার
উত্তরসূরীর বোধের কেন্দ্রে কী থাকবে? কী নিয়ে ভাববে, লিখবে? সেই দরজা কি খোলা? সব সমস্যা
মিটে গেলে, অসাম্য, অন্যায় দূর হলে যা নেমে আসবে, তাই তো আনন্দ। শান্তি ঘরে ফিরবে।
সেই আনন্দধারার সাথে তোমাদের লক্ষ্যের বিরোধ সত্যি আছে কি? বিরোধিতাই কি একমাত্র রাজনীতি?
নাকি বিরোধিতা আনন্দে পৌঁছনোর মার্গ?
-আমি
তোমায় চিনি বলে বলছি না। অন্য কেউ হলে বলত ‘ম্যান্সপ্লেন’ করছ।
-জানি,
বলত। কিন্তু তুমি জানো, আমি কখনও তোমার কোনো কাজে বাধা দেব না। শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে
দেওয়ার কাজটি আমার। ওটার সত্ত্ব ছাড়ছি না। তুমি করবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, যা যা করণীয়।
ক্লান্ত হলে আমাকে বোলো। কষ্ট নিয়ে নেব। হরিদ্বারে এক সাধু ছিলেন, জানো? থেকে থেকে
বলে উঠতেন ‘আনন্দ হি আনন্দ!’ অদ্ভুত এক্সট্যাসি। আমি সেই এক্সট্যাসি অনুভব করিনি। কিন্তু অমনটা অনুভব করা যে যায়, তা মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেব। তুমি
রেগে যাবে। আমি থেমে যাব। তারপর আবার মনে করিয়ে দেব।
-দেখ।
তারা ফুটছে। ‘দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ...’ না?
-হুঁ।
আনন্দের গন্ধ। একদিন পাবে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন