ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(২)
উদ্ভাস
বলছিল, এর জন্য শুধু তোর কথারাই দায়ী ছিল না। ওইসব কথায় জাদু ছিল ঠিকই। কিন্তু তোর
বাড়ির পরিবেশটাও খুব কাজে এসেছিল। বহুরকম সুযোগসুবিধা সেখানে ওরা পেত, যা নিজেদের বাড়িতে
পাওয়া অসম্ভব ছিল। খুব মজায় থাকত ওরা। আর পেত স্বাধীনতা। অবাধ, বিপুল। একটা জাদুর রাজ্য
সৃষ্টি করেছিলি তুই। শূন্যের ওপর। তার লোভেই
ছুটে আসত ওরা। আর তুই স্বপ্ন দেখতিস, ওদের নিয়ে এক স্বপ্নের ক্যাথিড্রাল তৈরি করবি
তুই। ক্যাথিড্রাল নয়, তুই তো বলতিস ফুলের বাগান।
সারাজীবন ওরা তোর পাশে থাকবে। নিশ্ছিদ্র তোদের সম্পর্ক। শাশ্বত ও অটুট এই সম্পর্কের
নামই বন্ধুত্ব। বন্ধুদের নিয়েই সৌন্দর্য ও স্বাধীনতার এই সমান্তরাল দুনিয়া গড়ে তুলবি
তুই। পাগলের মতো তুই ওদের ভালোবাসতিস। একটু একটু করে ওরা দখল করে নিল তোর সমস্ত অস্তিত্ব।
একচিলতে জায়গাও আর ফাঁকা পড়ে রইল না।
তুই ভরে উঠলি। নিজের সামান্য সুখ, তুচ্ছ অর্জনও ওদের সঙ্গে ভাগ না করে নিলে তুই স্বস্তি পেতিস না। বই পড়ে গান শুনে, সিনেমা বা ছবি দেখে যে অনুভূতি হতো, ওদের তা জানাতে না পারলে ছটফট করতিস। ওদের জন্য কিছু করার জন্য মুখিয়ে থাকতিস। পরোপকার হয়ে উঠল তোর নেশা। নিজের যেখানে যা যোগাযোগ সব জায়গায় ওদের নিয়ে যেতিস, ওদের উপকার করার জন্য ছুটে ছুটে বেড়াতিস, নানাভাবে ওদের সুযোগ সুযোগসুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতিস, বিনিময়ে কী পাচ্ছিস না পাচ্ছিস, তার হিসাব না রেখেই। ওদের জন্য নিজেকে তুই বিলিয়ে দিয়েছিলি। নিজের হাতে কিছুই রাখিস না তুই। তোর মধ্যে আর কোনও বাস্তবতাই অবশিষ্ট ছিল না। সৌন্দর্য আর মহত্ব নিয়ে এই পাগলামি তোকে একদম নষ্ট করে
দিয়েছিল।
একটু একটু করে তুই দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিলি আর একটু একটু করে গড়ে উঠছিল তোর ফুলের বাগান।
নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছিল হৃদয়। শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, অসাধারণ। সবার চেয়ে আলাদা। ভিন্ন গ্রহের এক মানুষ। মোহ, বিভ্রান্তি আর কল্পনার দুনিয়ায় প্রবেশ করেছিল সে। রোজকার জীবনের তুচ্ছ তুচ্ছ বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল। একমাত্র বন্ধুদের উপস্থিতিতেই নিরাপদ বোধ করত। কারণ যে কল্পনার রাজ্যে ও বিচরণ করত, ওরাই ছিল তার মুখ্য অবলম্বন। ওরা ছিল বলেই শূন্যতাকে নিছক শূন্য মনে হতো না। বন্ধুরা ছিল ওর জীবনের উঁচু উঁচু স্তম্ভ, শূন্যতার গায়ে সেইসব রঙিন আলপনা যাদের ওপরে ভর দিয়ে ও টিঁকিয়ে রেখেছিল নিজের তৈরি এক মায়াবিশ্ব।
উদ্ভাস বলছিল, বন্ধুরা একে একে তোকে ত্যাগ করতে শুরু করেছিল। কেন সেটাই তো আসল গল্প। আমরা শুধু দেখতে পাচ্ছি একটা একটা করে স্তম্ভ খসে যাচ্ছিল। তোর কল্পনার দুনিয়া নড়বড় করতে শুরু করেছিল। যত ওরা সরে যেতে চাইছিল, তত তুই ওদের আঁকড়ে ধরতে চাইছিলি। আসলে তুই টের পেতে শুরু করেছিলি সবকিছু আর আগের মতো নেই। খুব নিঃশব্দে ধ্বস নামা শুরু হয়ে গেছে। তুই ভয় পেয়ে গেছিলি। আসলে তোর নিজের জীবন বলে আর কিছু ছিল না। তুই সবটাই দিয়ে দিয়েছিলি ওদের। তোর নিজের অস্তিত্বটাই একটা নিখাদ শূন্যতায় পরিণত হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে একদম দেউলিয়া হয়ে গেছিলি তুই। আত্মশক্তি বলে তোর মধ্যে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ওরা না থাকলে যে বিপুল শূন্যতা বেরিয়ে আসবে, সেটাকে মোকাবিলা করারা সাহস তোর ছিল না। ওরা তোর ভয়ের কারণটা টের পেয়েছিল। একে একে সবাই ত্যাগ করেছিল তোকে। কেউ তোকে করুণা দেখায় নি। শুধু তাই নয় ভেতরে ভেতরে সবাই তোর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল। ওরা বুঝতে পেরেছিল এভাবে যে মানুষোটা নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, সৌন্দর্য, স্বাধীনতা আর বন্ধুত্বের জন্য দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, তাকে নস্যাৎ করে দিতে না পারলে নিজেদের অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ ও মূল্যবান করে তোলা যাবে না। তোকে বিসর্জন দেওয়াটা ওদের কাছে জরুরি ছিল। যে মানুষটা পরিত্রাতার ভূমিকা নিয়েছে, তাকে মুছে দিলে তবেই নিজেদের উত্থান সম্ভব। তোকে সহ্য করে চলার অর্থ, তোর মিথ্যেকেও সহ্য করে চলা। তুই তো সত্যিই তাই নোস, যা তুই হয়ে আছিস। ওদের প্রত্যেকেরই একটা নিজের জীবন আছে, ওদের প্রত্যেকের কাছেই নিজের অস্তিত্বের মূল্য আছে। আর সেই মূল্যকে তোর মতো বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতাও ওদের নেই। শূন্যতার গায়ে রঙিন আলপনাগুলো মিলিয়ে গেছিল। মোহ ও বিভ্রমের ওপর যে কল্পনার রাজ্যটা দাঁড়িয়েছিল, তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছিল। তুই একা হয়ে গেছিলি। সম্পূর্ণ একা। আর যে সত্যকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলি, সেটাই তোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আর সেই সত্য এই যে তুই দেউলিয়া হয়ে গেছিস। দশমাস রাজার মতো বেঁচে ছিলিস তুই। কিন্তু এ এক অত্যন্ত হঠকারী রাজা, যার কোনো দূরদর্শিতা নেই, যে শুধু নিজের প্রাণশক্তিকে বেহিসেবির মতো খরচ করে যায়। এই অপচয়ের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। ভিখিরি হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো ভবিতব্যই থাকতে পারে না এর...
হৃদয় জানলা দিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকাল। খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিল সে। অনেকের অনেকের জীবনে। এখন সে একজন তুচ্ছ মামুলি মানুষ। স্বপ্নের দুনিয়াটা শূন্যে মিলিয়ে গেছে। বাস্তবের কঠিন কঠোর জমিতে সে এসে নেমে দাঁড়িয়েছে। এখন তার সঙ্গে আর দশজনের কোনও তফাৎ নেই। সে এখন অনায়াসে সবার মধ্যে মিশে যেতে পারে। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। সমীহ করে কথা বলবে না। তোষামোদ মিশিয়ে প্রশস্তি উচ্চারণ করবে না। একা, সে এখন ভীষণ একা। তার রাজকীয় রঙিন পোশাকটা খসে গেছে। এখন তাকে দেখে আর চেনার কোনও উপায়ই নেই, একদিন সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কত মানুষের জীবনে...
হৃদয় জানতে চেয়েছিল, আমার কি তাহলে সবটাই ব্যর্থতা? উদ্ভাস হেসেছিল। তারপর রহস্য করে বলেছিল, মানুষের জীবনটাই একটা হেঁইয়ালি, বুঝলি? ব্যর্থ মানুষের কি এত প্রতিপক্ষ থাকে? একা মানুষের? তোর তো এখন ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারের দশা! তোর সফলতার জীবন এতদিনে শুরু হয়েছে...
হৃদয় আর
কিছু জানতে চায় নি। পালিয়ে এসেছে এই ক্যাথিড্রালে। এখানে বেশ লুকিয়ে থাকা যায়। আর চুপ
করে বসে শোনা যায় অবিরাম সমুদ্রের গর্জন। কিন্তু কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবে সে? একটু পরেই
ওকে বাইরে বেরোতে হবে। ওর বুকের মধ্যে যে ক্যাথিড্রালটা ছিল, যে ক্যাথিড্রালটা ঘিরে
ছিল ওর ফুলের বাগান, সেটা এখনও আগের মতোই রয়েছে। সেটার গায়ে সামান্য আঁচড়ও কেউ কাটতে
পারে নি। কিন্তু বাইরে গিয়ে ও যখন দাঁড়াবে, কেউ ওকে চিনতে পারবে না। যা কিছু দেখে ওকে
চেনা যেত, তার সবটাই শূন্যে মিলিয়ে গেছে। মুছে গেছে। একটা অর্থহীন অস্তিত্বে পরিণত
হয়েছে সে। তুচ্ছ মামুলি এক মানুষে! তার চেয়ে এখানে লুকিয়ে থাকাই ভালো। হৃদয়ের কানে
সঙ্গীত ভেসে আসতে থাকে। একসঙ্গে অনেকে মিলে যেন প্রার্থনা করছে। স্তোত্রের মতোই শোনাচ্ছে
সেই সঙ্গীত। কান খাড়া করে, একাগ্র হয়ে, সেই সঙ্গীত সে শুনতে থাকে...
উদ্ভাস এখন মন দিয়ে ডায়েরি পড়ছে। আজ সকালেই মৃতদেহটা ভেসে এসেছে। তার পকেটে ছিল একটা ডায়েরি। সমুদ্রের ধারে মর্নিংওয়াক করতে গিয়ে উদ্ভাসই প্রথম আবিষ্কার করে। একটা নৌকার ওপর শোয়ানো ছিল মৃতদেহটা। একটু পরেই পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ফিরতে হবে ওকে। রিপোর্ট দিতে হবে। তার আগেই পড়ে ফেলতে হবে গোটা কাহিনিটি। একটা রোমহর্ষক কাহিনি। উদ্ভাস ক্রমেই ডুবে যেতে থাকে সেই ডায়েরির মধ্যে। হৃদয় ও তার ফুলের বাগান। সে কথা বলতে শুরু করে বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে। তাদেরই একজন হয়ে ওঠে। কখনও আবার আলাদা হয়ে যায় তাদের থেকে। তখন সে শুধুই একজন বিবৃতিকার। এভাবেই, নিভৃত এক দুনিয়ায়, বিভিন্ন ভূমিকায় ঢুকে পড়তে থাকে সে...
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন