সিনেমার পৃথিবী – ২
আগের বার বলেছিলাম, এই কোভিড আবহে আরো কয়েকটা মহামারী সম্বন্ধিত সিনেমার কথা লিখব, তবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। এই ছবিগুলো মূলত সাইকোলজিকাল। সমাজে কোন মহামারী হলে মানুষ মনের দিক থেকে কীরকম বদলে যায়, সেই নিয়ে ছায়াছবি। অবাক ব্যাপার, আমার লেখা যখন এগোবে, দেখতে পাবেন এইসব সিনেমাতেও কী অদ্ভুতভাবে যেন আজকের পৃথিবীর জলছাপ উঠে এসেছে। প্রথম ছবির নাম ‘ব্লাইন্ডনেস’ (২০০৮), দ্বিতীয় ছবির নাম ‘জেড ফর জাকারাইয়া’ (২০১৫) ও তৃতীয় ছবির নাম ‘ইট কামস অ্যাট নাইট’ (২০১৭)। তবে একটা ব্যাপার শুরুতেই জানিয়ে রাখি, মহামারী দেখালেই হিন্দি-ইংরাজি বাজার চলতি ছবির একটা কমন ফর্মূলা আছে... গোটা শহর ফাঁকা, মরে যাওয়া মানুষগুলো ভূতুড়ে জম্বি টাইপ বাঁকা শরীর নিয়ে এগোয়, আর বেঁচে থাকা মানুষদের কামড়ে তাদেরও জম্বি বানানোর চেষ্টা করে। এইসব হাস্যকর ছবির কোন উপাদান আমার লেখায় নেই।
এই সিনেমার সবথেকে নজরকাড়া অংশ হচ্ছে ঐ মানসিক হাসপাতালে অনেক রুগি হয়ে যাবার পর কীভাবে শক্তিশালীরা দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করছে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের ভাগে বেশি পাবার জন্য অসামাজিক কাজকর্ম শুরু করছে। এমনকি অন্ধ হয়েও বাকিদের ভয় দেখানোর জন্য গুলি চালাচ্ছে। এবার আসুন বাস্তবের মাটিতে। গোটা ভারত কোভিড আতঙ্কে ভুগছে। যে কোন সময় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। অথচ মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হতেই মাস্কের দাম হাতের বাইরে চলে গেল, প্যারাসিটামল অপ্রতুল হয়ে গেল, স্যানিটাইজার আর ডায়াবেটিসের ওষুধ উধাও হয়ে গেল। যে হ্যান্ড-ওয়াশের দাম পঞ্চাশ টাকা, সেটা দেখলাম দু’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দশ টাকার মাস্ক চল্লিশ টাকায়। বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষ সেগুলো কিনছে। প্রাইভেট হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসার নামে পাঁচ-ছ’লাখ টাকার প্যাকেজ চালু হয়ে গেল। এগুলো অসামাজিক নয়? আরেকটু এগিয়ে আসুন। গত কয়েকমাস হল নিউজ চ্যানেলে দেখছি কোথাও কোভিড আক্রান্তর স্ত্রী ফ্ল্যাটের ছাদে কাপড় মেলতে উঠলে তাকে মারধর করা হচ্ছে, কোথাও আবার আক্রান্তর পরিবারকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে বা হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোথাও সংক্রামিতকে ৬ কিলোমিটার নিয়ে যাবার জন্য ৯০০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে, কখনো মৃত ব্যক্তিকে দাহ করার জন্য বা তার মুখ দেখানোর জন্য তার ছেলে- মেয়ের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে। তার মানে ভাইরাস আক্রান্ত একই সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ, আরেক শ্রেণীর দুর্বল মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার চালাচ্ছে। মনোযোগ সহকারে ব্লাইন্ডনেস দেখুন – এই মুহূর্তের অনেক কিছুই চোখে পড়বে।
এই ছবি দেখে অনেকের মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে জাকারাইয়া-র সঙ্গে ১৯৫৯ সালের
ছবি ‘দি ওয়ার্ল্ড, দ্য ফ্লেশ অ্যান্ড দ্য ডেভিল’-এর অনেক মিল আছে। অ্যাটম বোমার
বিষাক্ত ছোবলের ফলে এক শহরের জনশূন্য হয়ে যাওয়া, মাত্র দুটি পুরুষ ও একটি নারীর বেঁচে থাকা, দুই পুরুষের লড়াই আর সবশেষে
একসাথে তিনজনের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলা। যদিও আমার মনে হয়েছে, মোটিভ ও ফিনিশিংয়ের
দিক থেকে ‘জাকারাইয়া’ অনেকটাই জটিল। এখানে মনস্তত্ব নিয়ে খুব সূক্ষ্ম দিক ধরার
চেষ্টা করা হয়েছে। যখন রিসোর্স সীমিত, তখন প্রত্যেকজন অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ কাল কী হবে, কেউ জানে না। কে বেঁচে থাকবে, কেউ জানে না। ফলে সবাই চাইবে, সে নিজে বেঁচে থাকুক আর
প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে প্রতিটা রিসোর্স উপভোগ করুক। এবার ভাবুন, আজ আমাদের সমাজের
জটিল অবস্থান কোথায়।
সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে।
সবাই শুধু নিজে বেঁচে থাকতে চায়, অন্যের বিষয়ে কেউ জানতে চায় না। প্রত্যেকেই নিজের
বাড়িতে একেক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে বেঁচে আছে। এমনকি কিছুদিন আগেই বনগাঁয় এক কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে
দেওয়ার বদলে চালক পিপিই কিট পরে পাশ থেকে মজা দেখছিল, কোন একজন মোবাইলে এই ঘটনার
ভিডিও তুলছিল, কিন্তু এদের কেউ সেই ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয় নি বলে সে
রাস্তাতেই মারা
যায়। ভালভাবে দেখুন, ‘জাকারিয়া’ এই ঘটনাই অন্যভাবে দেখিয়েছে।
তৃতীয় ছবি ‘ইট কামস অ্যাট নাইট’-এর পরিচালক এক তরুণ, ৩২ বছর বয়সী ট্রে এডওয়ার্ড শাল্টস। এইমাত্র যেটা বল্লাম, সেটাকে একটু ঘুরিয়ে যদি এভাবে বলি যে সবাই চায়, সে নিজে তার পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকুক আর প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে সেই পরিবার প্রতিটা রিসোর্স উপভোগ করুক – যার শেষ ধাপ হল ডারউইনের ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’, তাহলে সেই নৈরাজ্যের সার্থক রূপায়ন এই সিনেমা। এই ছবির ট্যাগ ‘ফিয়ার টার্নস মেন ইনটু মনস্টারস’। ইট কামস অ্যাট নাইট – অন্ধকারে কে আসে? কী আসে? ভয়। আর সেই ভয় থেকেই মানুষ অন্যকে মেরে ফেলতেও পিছপা হয় না। ছবির শুরুতেই এমন একটা দৃশ্য আছে যা আপনাকে ধাক্কা মারবেই। আমি এই ছবি দেখার পর দু’রাত ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। খালি মনে হত, আমার যদি একদিন ঐ হাল হয়! সুতরাং আমি শুরুতেই একটু সাবধানবাণী শুনিয়ে রাখি যে নরম হৃদয়ের পাঠক-পাঠিকা এই মুভি দেখবেন না। এটাও বলে রাখি, এই মুভি বেশ কয়েকটা ফিল্ম ক্রিটিক সোসাইটির সেরা হরর মুভি পুরস্কার পেয়েছে।
সিনেমা শুরু হচ্ছে অন্য মুভির মতই, এক
ছোঁয়াচে অতিমারীর প্রকোপে দেশের পর দেশ জনশূন্য। এখন যারা বেঁচে আছে, তারা
গভীর বনে-জঙ্গলে অন্যের ছোঁয়া এড়িয়ে, লুটপাট এড়িয়ে থাকে। জঙ্গলে যা পাওয়া যায়, তাই খায়। এরকম এক পরিবারে
সিনেমার প্রথম নায়ক জোয়েল এডগার্টন তার বউ, কিশোর ছেলে আর শ্বশুরকে নিয়ে জঙ্গলের
মধ্যে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকে। শুরুতেই আমরা দেখি জোয়েলের শ্বশুর সেই ছোঁয়াচে
রোগে আক্রান্ত। এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য জোয়েল তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির একটু
দূরে গিয়ে গুলি করে শ্বশুরকে মেরে ফেলে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এর
কিছুদিন পর ছবির দ্বিতীয় নায়ক ক্রিস্টোফার অ্যাবট তাদের বাড়িতে খাবারের খোঁজে এসে
জোয়েলের হাতে আটক হয়। যদিও অ্যাবটকে নিয়ে জোয়েল তাদের বাড়িতে যায় ও অ্যাবটের বউ ও
ছোট বাচ্চাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর অনেক টানটান উত্তেজনা আছে, ভয়
আছে, নাটকীয়তা আছে, অবিশ্বাস আছে। প্রায় শেষে, অ্যাবটের ছোট বাচ্চার রোগ হয়েছে সন্দেহে জোয়েল
তাদের পুরো পরিবারকে গুলি করে মেরে ফেলে। সবশেষে, জোয়েলের ছেলে সেই ছোঁয়াচে রোগে
মারা যায়।
আজকাল আমরা টিভি চ্যানেলে মাঝে মাঝেই দেখি, রাস্তায় কোন একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে
রয়েছে কিন্তু করোনার ভয়ে কিন্তু কেউ তার ধারেকাছে যাচ্ছে না। সারাদিন পড়ে থাকার পর
সন্ধেবেলা যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে সে আর নেই। অথবা
ফাঁকা শুনশান রাস্তায় কোন বৃদ্ধ রেশন নিয়ে যখন আসছিলেন, তখন একদল মুখঢাকা যুবক তার ব্যাগ ছিনতাই করে
নিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। অথবা আরো শকিং ঘটনাও শোনা
যায় – বয়স্ক গৃহকর্তা অফিস থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে জ্বর-কাশি নিয়ে ভুগছেন,
নিঃশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু তার নিজের বউ-ছেলে-মেয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না করোনার
ভয়ে, বরং বাইরে থেকে ঘরের দরজায় ল্যাচ টেনে তারা পুলিশে খবর দিচ্ছে বাবাকে
হাসপাতালে নিয়ে যেতে। পুলিশ এসে দরজা খুলে দেখছে সেই ব্যাক্তি ততক্ষণে মারা গেছেন। এর একটাই অর্থ। এই সমাজের ভেতর এক ঘুণপোকা ঢুকে গিয়ে আমাদের
সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রয়োজন হলে পরোক্ষভাবে অন্যকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করছি
না। আমরা সবাই চাই যদ্দিন সম্ভব নিজে বেঁচে থাকতে কারণ আমরা জানি আমাদের প্রত্যেকের জীবন অনিশ্চিত। এটাই তো এই ছবি জোর দিয়ে দেখাতে চাইছে।
তাহলে কে বলে যে সিনেমা শুধুই রিল? কে বলে সিনেমা বাস্তবের ছায়ায় উঠে আসে না? আসলে
এই তিনটে ছবিই এক সূতোয় বাঁধা – যখন সামাজিক বিপর্যয় আমাদের ঘিরে ধরে, তখন আমরা কী রকম বদলে যাই, আমাদের মনস্তত্ব কোনদিকে
চালিত হয়, অস্তিত্বের
বিপন্নতা আমাদের কীভাবে স্বার্থপর হতে শেখায়, আমাদের ভেতরের রাক্ষসটা কীভাবে আস্তে
আস্তে বেরিয়ে আসে। এ যেন হুবহু জীবনানন্দের ১৯৪৬- ৪৭ – ‘মানুষ
মেরেছি আমি – তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে / পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি’।
যাইহোক, ভাইরাস আর মহামারী নিয়ে অনেকগুলো সিনেমার কথা লিখলাম। উৎসাহী পাঠক বাকিটা নিজেরা খুঁজে পেতে দেখুন। এরপর আমি আগামীতে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বা মহামারী নিয়ে কোন সিনেমার কথাই আর কলমের ডগায় আনব না। বরং পরের বার জীবন ও তার উপভোগ্যতা, এই নিয়ে কয়েকটা ক্লাসিক সিনেমার কথা বলব। মন ভাল করব।
বেশ ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন