সমকালীন ছোটগল্প |
ব্লাডি রোজ
(এক)
অ্যাই শুনছো?
চিল চিৎকারের উৎস ঠাহর করে টয়লেটের বন্ধ
দরজার বাইরে পৌছোনোর পথে হ্যাঁ আসছি বলতে গিয়ে সদ্য মুখাগ্নি হওয়া দিনের প্রথম
সিগারেটের ধোঁয়াগুলো মিছিমিছি বেরিয়ে গেলো মুখ থেকে।
কী হয়েছে?
কী আবার হবে! রাতে চোদ্দবার পেচ্ছাপ করতে
ওঠো আর সব জল শেষ করে রেখে দিয়েছো। এখন আমি কী করি! ইস! এইভাবে দিন শুরু হলে কার
ভালো লাগে?
তো আমি কী করবো?
কী করবা মানে! পাম্পের সুইচটা দাও
এক্ষুনি। ওফ আর পারি না!
পাম্পের সুইচ দিতে গিয়ে জানা গেল কারেন্ট
নেই। ব্যাপারটা জানাতেই সাগরিকা চীৎকার করে উঠলো, “নিচের টিউবওয়েল থেকে দু’বালতি
জল নিয়ে এসো গে! আমার আজকের দিনটার বারোটা বেজে গেলো”।
চিড়বিড়ে কন্ঠস্বরটা যেন ক্রন্দসী হতে চায়।
কার যে দিনটার বারোটা বেজে গেলো সেই প্রশ্নটা সুবিনয়ের মাথায় একটা মস্ক্যুটো কয়েলের আকার ধারণ করতে চাইলো। তর্জনী এবং মধ্যমার ফাঁকের মৌজাগ্নিতে উদ্ভাসিত সিগারেটটার অপমৃত্যু হল বিরক্ত সুবিনয়ের স্লিপারের তলায়। দু’হাতে দু’খানা বালতি ঝুলিয়ে বিরস বদন সে অধোগামী হল। সিঁড়ি দিয়ে।
তলপেটে যত বেশি চাপই তৈরি হোক না কেন, টয়লেটে যাবার অগ্রাধিকার সাগরিকারই। ফ্যামিলি পিস কোড অনুযায়ি। এতে সুবিনয়ের সামান্য বেশি সময় গড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ অবশ্য হয়। বালিশ থেকে মাথাটা তুলে চুলগুলোকে ঝুঁটি করে বেঁধে দু’হাত আকাশে ছড়িয়ে আউ ওউ ইয়াঃ ইত্যাদি শব্দে ঈষৎ মুখবিকৃতি সহযোগে নিদ্রা ভঙ্গের জানান দিতে দিতে বাসি মুখের দুর্গন্ধে মশারিবদ্ধ বাতাসকে ভারি করে দিয়ে বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র জপতে জপতে সোজা টয়লেটে চলে যায় সাগরিকা। বিছানায় শুয়েই সুবিনয় কমোডের জলে তৈরি হওয়া শব্দতরঙ্গ শুনতে পায়। টয়লেট থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার মুখোমুখি হয়ে চুলগুলিকে যথাস্থানে স্থাপিত করবার সময় সাগরিকার চুড়িতে তৈরি হওয়া শব্দে সুবিনয় বুঝতে পারে, এবার তার গেটপাস এলো; যেতে পারে সে ভার মুক্তির উদ্দেশ্যে। এটাই রোজকার রুটিন ওদের পরিবারের।
কিন্তু আজকে মর্নিং শোজ দ্য ডে অন্য ভাষায় কথা বলেছে। শেষ রাতে প্রায় ঘন্টা তিনেক বাজে রকমের বজ্রপাত সহ মুষলধারায় বৃষ্টি ভোরের আমেজি ঘুমটাকে বরবাদ করে দিয়েছিল। ফলশ্রুতি লোডশেডিং।
বজ্রপাত এবং লোডশেডিংয়ের গল্প পানের খিলির মত মুখে পুরে পাড়ার অনেকেই একযোগে উপস্থিত হওয়াতে টিউবওয়েলটা এই সাত সকালে ভি আই পি হয়ে উঠেছে। সুবিনয় একটু দেরিই করে ফেলল বোধহয়। বেশ কয়েকজনের পিছনে সে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই পাশের অ্যাপার্টমেন্টের মন্ডলবাবু না কামানো গালের খোঁচাখোঁচা দাড়ির মতো জিজ্ঞেস করে বসলেনঃ “আপনার প্রজেক্টের অ্যাপ্রুভালটা পেলেন মুখারজিবাবু?” সঙ্গে অবশ্য একগাল হাসি ছড়ানো ছিলো ব্রাশ পোরা মুখের। সুবিনয় পাড়ায় মুখারজিবাবু বলেই সম্বোধিত হয়। তার নিজের না কামানো গালের স্পর্শে সাগরিকার প্রতিক্রিয়ার মতো একটা কিছু ফুটে উঠতে চাইছিলো সুবিনয়ের মুখমন্ডলে, যা সে গিলে ফেললো। ঘামাচি ঢাকতে যেমন গেঞ্জি থাকে তেমনি একপিস চর্চিত হাসি ফুটিয়ে সুবিনয় জানালো এ ব্যাপারে তার কোন তাড়াহুড়ো নেই। এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললো মুখে যেন এসব নিয়ে তার আদৌ কোন চাপ নেই। হলে হবে, না হলে না হবে। তাতে তার কিছু যায় আসে না। ইদানিং এই প্রশ্নটাই সুবিনয়কে সবচাইতে বেশী বিব্রত করে যেখানে সেখানে।
সকলেরই তো প্রায় একই রকম দিনারম্ভ ঘটেছে, কিন্তু সকলের কথাবার্তা শুনে, ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিলো সুবিনয়ের ট্রাজেডিটাই ব্যতিক্রমী। রানিং ওয়াটার, ইলেক্ট্রিসিটি, টি. ভি, চার্জযুক্ত মোবাইল এরা সবাই প্রচন্ড ক্ষমতা সম্পন্ন সব ম্যাগনেট দৈনন্দিন জীবনে। মানুষকে টেনে নিয়ে সেঁটে রাখে নিজস্ব মধ্যাকর্ষণের ত্বকে। এবং এইসব ক্ষমতাশালী চুম্বকেরা এরকম দৈবাৎ একযোগে হঠাৎ অক্রিয় হয়ে পড়লে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেকার স্বাভাবিক কিন্তু চাপাপড়া মুক্তিলোভ যেন অদৃশ্য ডানা মেলতে চায়।
কলতলার ভীড়টা ধীরে বাড়ছিলো। বাড়ছিলো গল্পের তোড়ও। বাজে রকমভাবে ফেঁসে থাকা সাগরিকার কথা মনে পড়লো এবং এটাও সুবিনয় বুঝতে পারলো যে, সৌজন্যে কেউ ডেকে বলবে না – দাদা আসুন। ফলে, ঠেলে ঠুলে কোনরকমে টিউবওয়েলের মহার্ঘ হাতলের দখলটা করায়ত্ব করে অনভ্যস্ত হাতে পাম্প করে দু’বালতি জল ভরে নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে একটা অনুচ্চারিত হেঁ হেঁ ধরনের হাসি হাসি ভাব উপহার দিয়ে সুবিনয় সবিনয়ে কলতলার প্রাতঃকালীন বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দু’হাতে দু’বালতি জল নিয়ে হাঁটবার সময় লক্ষ্য করলো, কৌতূহলী মন্ডলবাবু তার পাশে হাঁটছেন।
জলটা রেখে আসছি, বলে একই রকম ফ্রেমে বাঁধানো হাসিটি ধরিয়ে দিয়ে চব্বিশ সিঁড়ি পর্বতারোহণ করে সাগরিকার ত্রাতা হিসেবে নিজেকে টয়লেটের দরজার সামনে স্থাপিত করে সে বুঝতে পারলো পৃথিবীতে অক্সিজেন কমে গেছে। কয়েকপা হেঁটে গিয়ে সোফায় শরীরটা ছেড়ে দিল। যেভাবে ক্রেনের শিকল ছিঁড়ে ভারী বান্ডিল পড়ে যায় বন্দরে। তার ফুসফুস এখন কামারশালের হাপরের ভুমিকায় অবতীর্ণ।
তোয়ালের দুষ্টুমিতে কিছুটা এলোমেলো হয়ে যাওয়া ভিজে চুলের ঝুলন্ত কুন্তল ভূষিতা চাপমুক্ত সাগরিকা এবার করুণাময়ী হলো। “যাও,এবার তুমি গিয়ে এসো”।
কিন্তু সদ্য প্রস্ফুটিত করুণার তলায় তখনও তেতো ভাবটা রয়ে গেছে। এবং পর মুহূর্তেই তা ফুটেও উঠলো। “ধ্যাৎ, এভাবে কারো দিন শুরু হলে ভালো লাগে বলো?” তোয়ালের অবস্থান বদলের জন্য ক্ষণিকের বিরতি। “কী যে করো না তুমি, ধুর! আমি না বলে দিলে পাম্পের সুইচটাও দিতে ভুলে যাও”। দিনের শেষে অফিস ফেরৎ ক্লান্তি যেন কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণই হতে পারে না। ঘরে ঢুকেই ছাদের ট্যাঙ্কে জলের তলানির পরিমানটা অনুমান করে নিয়ে পাম্পের সুইচটা অন করা যে তারই উচিৎ ছিল, এই বোধ লাভে সুবিনয় ঋদ্ধ হয়ে ওঠে।
“যাও যাও আর দেরী কোরিয়ো না তো, তাড়াতাড়ি
ফ্রেশ হয়ে এসো গে। চা করবো। রাজ্যের কাজ জমে আছে”।
“পরে যাবো”
“মানে?”
“আপাতত ওটা মাথায় উঠেছে”।
সুবিনয় মুখে ব্রাশ নিয়ে ফাটো ফাটো তলপেটের জল নিষ্কাশনে দণ্ডায়মান হলো ইউরিনালে। অ্যামনিয়ার গন্ধে সারা ঘর ছেয়ে গেলে বিপত্তির দ্বিতীয় এপিসোড শুরু হয়ে যাবে এটা উপলব্ধি করে কষ্টার্জিত জলের অবশিষ্ট সবটুকু ইউরিনালে ঢেলে দিয়ে সে আবার কলতলামুখো হলো। হাতে বালতি। অল্পের জন্য হাতে হেরিকেন হতে হতে বেঁচে গেছে - এরকম ভেবে নিয়ে কর্তব্যনিষ্ঠ হয় সে।
আশ্চর্য, মন্ডলবাবু এখনও নিজেকে দিব্যি
মধ্যমনি করে রেখেছেন কলতলার সমবেত জনতার মাঝে। এবং তাকে দেখেই দু’পা এগিয়ে এলেন।
“আমি জানি আপনি কথার খেলাপের মানুষই নন।
বলে যখন গেলেন যে আসবেন তো আসবেনই, জানি। দেখুন, ব্যাপারটা অনুমোদন পেলে তো সকলেরই
লাভ হতো, তাই না!” সুবিনয়ের বিরক্ত মৌনতা কোন অর্থই বহন করছে না – এটা বোঝা গেলো
মন্ডলবাবুর না থেমে চালিয়ে যাওয়াতে।
“এতো বড়ো একটা ইনোভেশনের কাজ করলেন আপনি।
সকলেরই তো কত উপকার হতো, তাই না? বলুন! আর ঐ স্বামীনাথন সাহেব কিনা ঝুলিয়ে রাখলেন
অ্যাপ্রুভালটা!”
“এ ব্যাপারে আমার কোনও হেডেক নেই।আমার
করনীয়টুকু আমি করেছি। এখন ব্যাপারটা আমার নাগালের বাইরে। অ্যাপ্রুভাল না হলেও আমার
কোনও অ্যাগোনি থাকবে না”। কথা কটা বলেই সুবিনয় ফাঁক বুঝে দ্বিতীয় বারের মতো দু’বালতি
জল নিয়ে মন্ডলবাবুর দিকে আবার একফালি হেঁ হেঁ এগিয়ে দিয়ে আবার চব্বিশ সিঁড়ির আরোহণ
পর্ব সেরে, প্রয়জনীয় মাত্রায় হাঁপিয়ে নিয়ে, করুণাময়ী সাগরিকার এগিয়ে দেওয়া চায়ে চুমুকটি
দিয়ে এবার ফ্রেশ হতে ঢুকলো টয়লেটে। চায়ের পর পানের খিলিটা মুখে পুরে সাগরিকা বিনা
কারেন্টেই চার্জ পেয়ে গিয়ে এবার আর দেরী না করে ইনভার্টার কেনার কথাটা একটু
উচ্চগ্রামেই বলে রাখলো, যাতে কমোডে বসেই সুবিনয় শুনতে পায়। টিভি-টা চালু থাকলে এই
সময় সাগরিকা সিরিয়ালেই নিবিষ্ট থাকতো। সেটা নেই, তাই সুবিনয় যেন দেরী না করে বাজার
থেকে পান সুপারি জর্দা, নকুলদানা, কলা, ঝিঙ্গে, পটল, আলু এবং মাছের মধ্যে পাবদা
অথবা ইলিশ নিয়ে আসে সেই ফিরিস্তিও শুনিয়ে রাখলো। সিগারেট খাওয়াটা হেলথের দিক থেকে
ভাল নয় খুব সম্ভব, সেই কারণেই অথবা টয়লেটে আসবার সময় ওটা যে প্যাকেটের শেষ সিগারেট ছিলো সেটা জানে না বলেই হয়তো সিগারেট
আনবার কথা বলেনি। তাছাড়া
সিগারেটের ব্যাপারটা সাগরিকার বলে দেবার তালিকাতে থাকবেই বা কেন! সুবিনয়ের শান্তি
বিধান বোধ সদা জাগ্রত থাকে।
সেদিন কারেন্ট এসেছিল দুপুর বারোটার কিছু আগে। কিন্তু বারোটা বেজেছিলো তার অনেক আগেই। সকালের বিভ্রাটে ঘেঁটে যাওয়া রুটিনে এমনিতেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দেরী হয়ে গেছে। বেরোনোর আগেই মাথায় ঢুকে গেছে পরবর্তী শিডিউল। তখনই কলিং বেলের আওয়াজ। এবং বেশ কয়েকটি পুরুষ এবং নারী কন্ঠের ক্রমশ কল্কলিয়ে ওঠা শুনতে পেলেও কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছিলো না সুবিনয় কমোডে বসে।
নিকুচি করেছে ফ্রেশ হওয়ার। ব্যাপারটা বোঝবার একটা তাগিদ তাকে তুলেই দিলো এবং গেঞ্জির ওপরে তোয়ালে জড়ানো সে রিসেপশনে এতো লোকের সমাগমের কারণ বুঝতে না পেরে রীতিমতো বোকাটে একটি বিব্রত মুখে পাজামাটা গলিয়ে আসতে ব্যালকনির দিকে গেলো, যেভাবে সিনেমা হলে কেউ অনেক হাঁটু পার হয়ে পেচ্ছাপ করতে যায়। কলতলার সেই জটলার মধ্যমনি সেই মন্ডলবাবু এবং কৌতূহলের গুড়ে ডানা আটকে যাওয়া মাছির মতো আরো কিছু বাকমুগ্ধ সহ-গসিপার, যার মধ্যে অন্যতম পি এন পি সি র স্কুল থাকলে তার প্রিন্সিপাল হবার যোগ্যতা সম্পন্না লতিকা সরকার। তোয়ালেটা দড়িতে মেলে দিয়ে পাজামাটা পরে সুবিনয়ের মনে হলো ব্যালকনি থেকে সোজা একটা সিঁড়ি যদি থাকতো একেবারে রাস্তায় নেমে যাবার তাহলে সেটা দিয়েই সরাসরি নেমে গিয়ে সিগারেটটা কিনে আনা যেতো। তার শরীরকে ব্যালকনিতে রেখে কান এসে পৌঁছলো সমবেত অবাঞ্ছিত জটলাটির পাশে। মন্ডলবাবুর ইতিমধ্যেকার পরিবেশনা আশ্চর্যজনক ভাবে সাগরিকাকে কেমন যেন গদগদ করে তুলেছে। অবাক কান্ড হল, লতিকা সরকারেরও কন্ঠেও গুণমুগ্ধের ভজনা!
(দুই)
টিম লিডার সুবিনয় মুখারজি তার টিমকে জানিয়েছিলেন আজকে যেমন কোভিড-১৯ সারা দুনিয়াটাকে ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে তেমনটি যে ভবিষ্যতে আর কখনো হবে না, তার যেমন নিশ্চয়তা নেই তেমনি এটারও নিশ্চয়তা নেই যে আগামী দিনে মানুষকে অদৃশ্য জীবাণু যুদ্ধের আবহে বাঁচতে হবে না। একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস আজকে যেমন পৃথিবীর অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে, মোড় ঘুরিয়ে দিতে চাইছে, ভারসাম্য ওলটপালট করে দিতে চাইছে তেমনটি তো আগামীতে আবারও হতে পারে! এটা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে যে আমাদের হাতের আঙুল, চেটো এসব সারাক্ষণ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অভ্যাসে মুদ্রাদোষে প্রথমে কোন সার্ফেসে কিছু একটা ছুঁচ্ছে। ছুঁয়ে জীবাণু বা ভাইরাসকে গ্রহণ করছে। তারপরে সেই জীবাণু বা ভাইরাস মানুষের শরীরের নয় দুয়ারের মধ্যে ধড়ের ওপর দিকের সাতটি দুয়ার দিয়ে মানে দুই চোখ, দুই কান, দুই নাকের ফুটো এবং একমোবাদ্বিতীয়ম মুখটি দিয়ে শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। ব্যাস! হয়ে গেলো। ভাইরাসের আগমন, বসবাস, বংশবৃদ্ধি ইত্যাদি। তারপর যেগুলো কেউ আটকে রাখতে পারে না সেই হাঁচি, কাশি, থুথু এবং কথা বলার সময়ে বেরিয়ে আসা অদৃশ্য ড্রপলেটস সামনের মানুষটিকে সংক্রামিত করছে। সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, সংক্রমণের ভয় ছড়াচ্ছে, আতংক ছড়াচ্ছে, ছড়ানো হচ্ছে আতংকিত হবেন না বলে। ছড়িয়ে দেওয়া আতংকের ছাতার তলায় পঙ্গপালের মতো অথবা ভয়ংকর দ্রুত বিস্তারশীল আগাছার মতো ছড়াচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে আগ্রাসী অবিশ্বাস যেটা আবার খুব সহজেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়া হাল্কা রেণুর মত ছড়িয়ে দিচ্ছে নানা প্রজাতির হিংসাও। পাড়ায়, মহল্লায়, এলাকায়। ভারী বৃষ্টির মত অঝোর ধারার সাবধান বাণী শুনতে শুনতে মানুষের কান পচে গেলেও বিপদ মার্কা ভয়ের গুমোট ছায়াটা যাচ্ছে না। অথচ এই সব কিছুই হচ্ছে আমাদের একটা অক্ষমতা থেকে। সেটা হলো, আমরা কোথায় কোথায় কি কি ছুঁয়ে ফেলছি সেটা মনে রাখতে পারছি না। এখানেই স্ট্রাইক করেছিলো ইনোভেটিভ সুবিনয়ের আইডিয়াটা। “আপদা কো অবসর মে বদল ডালনে কা মোউকা”। আমরা যদি সিমপ্লি একটা টাচ সেন্সিং লগ ম্যানেজমেন্ট (TSLM) অ্যাপ ডেভেলপ করতে পারি তাহলেই কেল্লা ফতে! আমরা যখনই যা কিছু ছোঁবো সেই অ্যাপটা তা রেকর্ড করে ফেলে একটা লগ মেইন্টেইন করবে এবং পরবর্তী স্পর্শের আগে একটা অ্যালার্ম দেবে। তখনই মানুষ সতর্ক হয়ে যাবে নাক কান চোখ মুখ ছোঁয়ার আগে। এভাবে সকলের সচেতনতা এবং সতর্কতা ১০০ শতাংশে পৌঁছে গেলে আর কেউ সংক্রামিত হবেনা। আর সংক্রমন ব্যাপারটাই যদি এভাবে সমূলে নির্মূল করে দেওয়া যায় তাহলে মানবজাতি বাঁচবে মুক্ত আলোয়, চরৈবেতির পথে।
সুবিনয়ের টিম খুব ডেডিকেটেডলি কাজ করেছে। লিমিটেড টেস্টিংএ পেয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। কিন্তু বাজারে ছাড়বার আগের ফাইনাল প্রোটোকলটা যিনি দেখেন সেই স্বামীনাথন পর্যন্ত গিয়ে প্রজেক্টটা আপাতত রহস্যময় হিমঘরে ঢুকে বসে আছে। এ নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। অ্যাকাউন্টসের হেড নন্দিনীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অতিসজাগ প্রতিভার সুনাম নিয়ে গসিপ আছে। প্রোজেক্টটার ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল আটকে যাবার সম্ভাব্য কারনটা তার মাথাতেই প্রথম অনুমিত হয়।
ইনোভেটিভ প্ল্যানিং সেলের একেবারে চাপা স্বভাবের এবং প্রখর বুদ্ধিদ্বীপ্ত চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা, ফর্সা গালে একটু এলোমেলো কালো দাড়ি, মুখ বুজে কাজ করা আর অসাধারণ সব উদ্ভাবনী ধারণা-চিন্তা–ভাবনার সঙ্গে অক্লান্ত ভাবে হার্ড ওয়ার্ক করে যাওয়া এসবের জন্য সুবিনয় মুখারজি ওদের বস স্বামীনাথনের গুড বুকেই ছিল। অনেকটা জুনিয়ার এই কলিগটি নন্দিনীরও লাইকিং লিষ্টে ঢুকে পড়েছিল। প্রায় তার নিজেরই অজান্তে। অগ্রণী ভুমিকাটা অবশ্য নন্দিনীরই ছিল। নন্দিনীর অনেক গল্প অনেক কথার প্রায় নীরব শ্রোতা ছিল সে। যেমন বিশ্বস্ত নীরব শ্রোতা ছিল সে ধীমান সরকারের। ওদের এই ‘অপারেশন টাচ লগ’এর কোড নেম ছিল ‘ব্লাডি রোজ’ এবং নামটা নন্দিনীরই দেওয়া। ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল ফর মার্কেটিং-এর জন্য প্রোজেক্টটা জমা করার পর আরো অনেক দিনেরই মত ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি মাখিয়ে নন্দিনী বলেছিলো, “আই হ্যাভ ডাউট; স্বামীনাথন মে নট গিভ গ্রীন সিগন্যাল টু ইয়োর ব্লাডি রোজ”। তখনই স্বামীনাথনের স্পর্শদোষের দিকটা সুবিনয়কে বলেছিলো নন্দিনী। জানিয়েছিলো, স্বামীনাথনের পার্সোনাল সেক্রেটারি ঊর্মিলা, কনফিডেনশিয়াল সেক্রেটারি ডলি বোস এরা কেমন যেন অফ মুডে চলে গিয়েছিলো ব্লাডি রোজ জমা পড়ার পর। বছর তিনেক হলো ঊর্মিলা এবং ডলি বোসের উত্থান হয়েছে। অ্যাপটার মার্কেটিং অ্যাপ্রুভাল দিয়ে দিলে স্বামীনাথন ঊর্মিলা ডলি ট্র্যাংগেলের সমস্ত টাচ ডাটা জমা হয়ে থাকবে অ্যাপের লগে। স্বাভাবিক ভাবেই অ্যাপের ডেভেলপার হিসেবে ঐ সাঙ্ঘাতিক গোপন স্পর্শ বৃত্তান্ত চলে আসবে সুবিনয়ের গোচরে। আকারে ইঙ্গিতে এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ শাটার ফেলার মত করে নন্দিনী বলেছিল, “টেক ইট ইজিলি মুখারজি; টাইম হিলস অল উন্ডস। কম্পানি মে হ্যাভ অ্যানাদার বস ইন ফিউচার। তখন হয়ত তোমার এই প্রোজেক্ট নিয়েই হইচই পড়ে যাবে”।
“বাট ইফ আই ডোন্ট গেট উন্ডেড অ্যাট অল, ফর দিস প্রেটি ম্যাটার?” সুবিনয়ের শান্ত মুখের ততোধিক শান্ত এই কথাগুলো শুনে কাপের নিচের শেষ চাটুকু চুমুক দিয়ে পটল চেরা চোখ দুটো বিস্ফারিত করে নন্দিনী বড়জোর বলতে পেরেছিলো, “গ্রেট! দেন ইটস ফাইন! চলো একদিনে সব গল্প করে ফেললে হবে?”
মুখে নাইট হুডের মত কথা বললেও সুবিনয় উঠলো না। একটু যেন চিন্তিত দেখাচ্ছিল তাকে। যেন আরো গভীরে ডুব দিয়ে কিছু একটা বুঝতে চাইছে সে। প্রখর বুদ্ধিমতী নন্দিনী বোধহয় সেটা আঁচ করতে পেরেই বলেছিল, “তোমার এই অ্যাপকে ও আটকে দেবে রাইট টু প্রাইভেসির গ্রাউন্ডে”।
সুবিনয়ের ঘনায়মান বিষণ্নতাও মুচকি হেসে
ফেলেছিল।
“ফানি! ইয়ু আর স্মাইলিং!”
“দ্যাখো নন্দিনীদি, রাইট টু এন্টারটেনমেন্ট গ্রাউন্ডে পর্ণো ব্যান হয় না, আর রাইট টু প্রাইভেসির গ্রাউন্ডে যদি আমার ব্রেন চাইল্ড এই অ্যাপটা আটকে যায় তাহলে ডেভেলপমেন্টাল ইনোভেশনের তো কবর হয়ে যাবে! ওকে, র্যাদার লেট মি টেক ইট ইজিলি অ্যাজ ইয়ু কারেক্টলি অ্যাডভাইসড অ্যাজ আ রিয়াল সিনিয়র।”
নন্দিনী চলে যাবার পরেও আরও কিছুক্ষণ একাই বসেছিল সুবিনয় আর একটা চা-এর অর্ডার দিয়ে। ভাবছিল কিছুদিন আগেই এই একই টেবিলে বসে ট্যুর অপারেটর ধীমান সরকারের কথাগুলি। বছর তিনেক আগেও স্বামীনাথনের কাছে পৌঁছোতে হলে এই নন্দিনী ম্যাডামই ছিলেন একমাত্র মাধ্যম। স্বামীনাথনের সঙ্গে ওঁর দহরম মহরম নিয়েই তখন গসিপ; যেমন এখন গসিপ হয় ঊর্মিলা ডলিদের নিয়ে। নন্দিনী ম্যাডাম তখন যা বলেন কর্মীরা মেনে নেন। যুক্তি দিয়ে না হলেও পরিবেশনাটি রসসিক্ত থাকে ম্যাডামের। স্বামীনাথনের স্পর্শদোষের গন্ধ তখন থেকেই ভেসে বেড়ায় কম্পানির টেবিলে, ক্যান্টিনে, করিডোরে। অফিসিয়াল ট্যুরে অ্যাকাউন্টসের হেড হিসেবে তাকে যেতেই হত স্বামীনাথনের সঙ্গে। লতিকা সরকারের ট্যুর অপারেটার স্বামী তুখোড় ধীমান সরকারই তাদের ট্যুর ম্যানেজমেন্টের কাজ সামলাতেন মসৃণ ভাবে এবং প্রায় নিঃশব্দে। দার্জিলিং, দীঘা, দিউ এসব জায়গায় স্বামীনাথনের সঙ্গে নন্দিনী ম্যাডামের ট্যুর সিডিউল, হোটেল, কার, শপিং এই সব কিছুই চৌকশ ধীমান সরকার করে দিত সলিড পেশাদারিত্বের সঙ্গে। দার্জিলিং ট্যুরের সময় শপিং সেরে রুমে ফিরে ডিনারের পর রক্তগোলাপ এগিয়ে দিয়েছিলো স্বামীনাথন, ঈষৎ রক্তাভ মদির চোখে। নন্দিনী জিজ্ঞেস করেছিলো, “বলুন তো এর বুকে কার রক্ত জমে আছে?” স্বামীনাথনের বোল্ড আনসার ছিলো, “তোমার বুকের রক্তগুলো চলকে দেওয়া, উথলে দেওয়াতেই ওর জীবন সার্থক”।
এরপর ঊর্মিলা, ডলিদের উত্থানের সঙ্গে নন্দিনী ম্যাডামের বেড়েছে বেতন এবং প্রতিপত্তি। কিন্তু দায়িত্ব বেড়ে যাওয়াতে এখন আর আউটডোর ট্যুরে তার যেতে হয়না। সেসব ঝামেলা ঊর্মিলা ডলিরাই সামলে নেয়।
(তিন)
কিন্তু সুবিনয় এটা মেলাতে পারছে না কিছুতেই যে অন্য কম্পানির লোক মন্ডলবাবু স্বামীনাথনের এই প্রোজেক্ট আটকে দেবার ব্যাপারটা জানলেন কী করে? এমনিতে একটু সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যই বোধহয় লতিকা সরকার বা যূথিকাবৌদি এদের টুকটাক ফাইফরমাস – না ঠিক ফাইফরমাস নয় - মানে এই এটা ওটার প্রয়োজন হলে মন্ডলবাবুই সহায়তা করেন। ধীমান সরকারকে তো আড়াইশো দিনই বাইরে বাইরে ছুটে বেড়াতে হয় ট্যুর অপারেটারের ব্যবসার সূত্রে। আর যূথিকা বৌদির হাসব্যান্ড তো কেরালাতে চাকুরি করেন। বছরে দুবার আসেন দুহাত ভরে নিয়ে। ঢেলে দেন যূথিকাবৌদি এবং তার উচ্চমাধ্যমিক ফেল্টুস ছেলেটির মাথায়। সে সময় খানা পিনা ঘুমনা এসবে মাতোয়ারা দিনগুলোতে রুগ্ন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সহৃদয় সহযোগিতায় ভরিয়ে দেন ভালোমানুষ মন্ডলবাবু। আর লতিকা বৌদির তো জোর দিয়ে বলার জায়গা রয়েইছে, তার স্বামী দুনিয়া ঘুরে বেড়ান; ফলে দুনিয়ার নাড়ী নক্ষত্রের খবর ওর কাছে তো থাকবেই। মন্ডলবাবু ছাড়াও ধীমান সরকারের ট্যুরিষ্ট কোম্পানির ড্রাইভার অশোকও লতিকা সরকারের টুকিটাকি দেখাশোনা করে। বিহারী বিস্বস্ত ছেলেটি দেশে নিয়মিত টাকা পাঠায়। বাবা, মা, তিন বছরের ছেলে আর ওর বৌটা রয়েছে সেখানে। লতিকা সরকার এমনিতে হাতের চেটো চিত করতেই পছন্দ করেন। উপুড় করাটা তার ধাতে নেই; একথা নিন্দুকেরা বলাবলি করে। কিন্তু অশোকের দুঃখটা বোঝেন। এবং হতে পারে ব্যতিক্রমী ঘটনা, তবুও সেখানে তার হাতের পাতা উপুড়ও হয়। পর্যাপ্ত অবকাশকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত পাড়ার সব বাড়ির খবরাখবর যোগাড় এবং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অকাতরে তার পরিবেশনের মহৎ কাজটি তিনি করেন তার সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে।
এই সব খবর সুবিনয়ের পক্ষে যোগাড় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সাগরিকা যখন লতিকা সরকারের উগরে যাওয়া খবরগুলো তাকে বলে তখন এসব কথা অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। বিরক্তও লাগে। কিন্তু আজ তার এসব কথা মনে পড়ছে; কিছুতেই সে দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারছিল না। লিকেজটা ঠিক কোথায় তা ধরতে সে এখন গভীর ভাবে প্লাম্বার হতে চাইছে।
“কি গো তুমি এতক্ষণ ধরে ব্যালকনিতে কি
করছ? এরা সব এসেছেন তোমাকে গ্রিট করতে”।
“কিন্তু অভিনন্দিত হবার মত আমি করলামটা
কী, সেটাই তো আমার জানা নেই!”
সুবিনয়ের এটিকেট এবং ম্যানারিজমে কি মরচে ধরলো হঠাৎ?
সাগরিকাও যেন একটু আশ্চর্য হয়ে গেল। সবসময়কার মাপা মুচকি হাসিটা কি ও ব্যালকনিতে ফেলে এলো? পাড়ায় টাকাপয়সার দিক থেকে না হলেও সন্মানের দিক থেকে যে একটু উঁচু আসন রয়েছে তার পরিবারের, তড়িঘড়ি সেটার ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে যায় সে।
“না না, মানে কোনও কিছুই তো ফাইনাল হয়নি। তাই ” –- কিন্তু তার চেষ্টা সফল হতে পারে না সামনে থেকে ধেয়ে আসা বাক্যস্রোতে।
“কি যেন, ঐ স্বামীনাথন সাহেব না কে যেন আটকে না দিলে অ্যাতো দিনে এই যে সকলের সব ধরনের দিন রাতের ছোঁয়া ছুয়ির যাবতীয় খবর ঐ মোবাইল কোম্পানির ঝুলিতে জমা হয়ে থাকতো। অবশ্য তাতে রোগ ছড়ানোটা নাকি একদম বন্ধ হয়ে যেতো। আর আমাদের পাড়ার দাদার গৌরবে আমাদের সকলের মাথা উঁচু হয়ে যেতো!” লতিকা সরকারের কথায় ওদের ড্রাইভার অশোক এবং তার পিছন পিছন আসা উড়িয়া বন্ধুটিও কেমন যেন হেসে উঠলো। বুঝে নাকি না বুঝেই সেটা ভগবান জানেন। আর সুবিনয়ের ব্যালকনিতে ফেলে আসা মাপা হাসিটা ব্যতিক্রম ঘটিয়ে আজকে যেন লতিকার পাশে দাঁড়ানো মন্ডলবাবুর মুখে লেপটে আছে। বেশ একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন – বোঝাই যাচ্ছে।
“হ্যাঁ, আমার হাসব্যান্ড তো ইনোভেটিভ সেলেরই হেড। উনি তো এর আগেও এরকম কাজ করেছেন। এ জন্যই তো ওর এতো প্রেষ্টিজ রয়েছে কোম্পানিতে”। এবারও সাগরিকার কথা সবগুলো হয়তো বেরোতেই পারলো না, লতিকা বোঝাচ্ছে সাগরিকাকে, “না মানে দিদি ব্যাপারটা হলো কি রকম জানেন” ক্লাস নেবার সময় দিদিমনিরা যে রকম ছাত্রীর মুখের ওপর দৃষ্টি রেখে কথা বলেন সেভাবেই লতিকা বোঝানোটা চালিয়ে যান। “মানে, এই ধরুন আপনি পটি করলেন, স্নান করলেন, গা মুছলেন, জামাকাপড় বদলালেন বা ধরুন যেমন শুতে গেলেন তো দাদার মাথার চুলে একটু হাত বোলালেন বা ধরুন দাদা একটু ইয়ে মানে এই সব কিছুই জেনে জমিয়ে রাখবে দাদার আবিষ্কার করা মোবাইলের সুবিধা। আর অ্যালার্ম বাজলেই আপনি আর নাক কান চোখ মুখ ছোঁবেন না”।
লেডি বসের পাশে দাঁড়ানো ইয়েস ম্যান সাবরডিনেটের মত ক্রমাগত মাথা নেড়ে চলা মন্ডলবাবু যেন উপসংহার টেনে দেবার জন্য যোগ করলেন, “মানে ধরুন ম্যাডাম, মানুষের গোপনীয়তা তো আর রোগের উপরে হতে পারে না। আগে বাঁচলে তবে তো গোপনীয়তা। জান হ্যয় তো জাহান হ্যায়। আর দেখুন এতবড় একটা মহান আবিষ্কার কিনা ঐ ব্যাটা স্বামীনাথন সাহেব আটকে দিলো!”
এতক্ষণে এদের আগমন রহস্য যেন মেঘ সরে গিয়ে রোদ ওঠার মত পরিস্কার হতে লাগলো সাগরিকার কাছে। এরা কি আনন্দিত না আতঙ্কিত? বিষকেও কি সুন্দর লোভনীয় রংয়ে পরিবেশন করতে পারে মানুষ! ফুটিয়ে তোলা হাসির পেছনে কসাইয়ের চপারকে কি সুন্দর লুকিয়ে রাখতে পারে! কিন্তু এরা আতঙ্কিত হচ্ছেন কেন? মৃগনয়না সাগরিকার ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। ওদের বাহ্যিক আনন্দের আড়ালে কেঁপে ওঠা আতঙ্কটা দেখতে পেয়ে নাকি আতঙ্কের সংক্রমণ?
“ওফ্ বাব্বা, কারেন্ট এলো এতক্ষণে!” সাগরিকার সহর্ষ ঘোষণা ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। প্রত্যেকেরই যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেলো যার যার বাড়িতেও কিছু করার মতো জরুরী কাজ আছে। চার ফুটের সিঁড়ি দিয়ে একসঙ্গে জনা চারেক লোকের যেন একই রকম নেমে যাবার তাগিদ। তা যখন সম্ভব হল না তখন লেডিস ফার্স্ট ফরমুলা আঁচলে জড়িয়ে নিয়ে চওড়া পশ্চাতের গুরুভার নিয়ে লতিকা সরকার একবার ডানে একবার বাঁয়ে হেলেদুলে একটা মাদি কচ্ছপের মতো নেমে যাচ্ছে। অশোক আর ওর উড়িয়া সাগরেদটি লতিকার হাতের তলা দিয়ে ফুড়ুৎ করে গলে বেরিয়ে গেল। আর সফল অভিভাবকোচিত অচঞ্চল ধীর পদক্ষেপে লতিকার ঠিক পেছন পেছন খুব কম ব্যবধান রেখে নেমে যাচ্ছে সামাজিক মন্ডলবাবুটি।
(চার)
মানুষ নিজে ভেবে যেমন অনেক কিছুই করে, তেমনি দৈনন্দিন যাপনের গড়ে তোলা রুটিনও তাকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেয়। তখন রুটিনটা যেন মালিক আর নিজেকে তার জনমজুর বা ওয়ার্কার বলে মনে হয়। প্রাক দ্বিপ্রহরের ঐ বারোটা বেজে যাওয়া এপিসোডের পরেও স্নান, ঠাকুরঘর, লাঞ্চ, রেষ্ট, বিকেলের চা। সন্ধ্যারতি। শঙ্খ, ঘন্টা। সব কিছুই গড়িয়ে চলছিল। যথারীতি নিজস্ব গতিতে। এমনিতেই মৃদুভাষী সুবিনয়ের আরো চুপ মেরে যাওয়াটা নজর এড়ায়নি সাগরিকার। ও কি তথাকথিত গোপনীয়তা নামক মশারির নেট দিয়ে আড়াল করে লুকোনো বস্তুটিকে নিয়ে খুব গভীর ভাবে কিছু ভাবছে? এবং সাগরিকা নিজের বুকের এই সন্ধ্যার স্ফীতিটাকে বুঝতে চাইছে যে সেটা উৎসাহ জনিত কারণে নাকি উদ্বেগে? যাইহোক, এসব কোনও কিছুই বেশি গড়াতে বা বাড়তে দেওয়া উচিত নয় বিবেচনা করে সে সুবিনয়ের পাশে গিয়ে বসলো। কপালের ওপর ঝুলে পড়া কোঁকড়ানো চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে বললো, “অ্যাই, কী এতো ভাবছো বলো তো?” সুবিনয়ের মুখে সেই মাপা হাসিটা আবার কিছুটা ফিরে এসেছে। যদিও তা থেকে কিছুই অনুমান করা যায় না। বোঝা যায় না।
“শোনো, পুষ্পাঞ্জলি থেকে ঠাকুরঘরের জন্য
কিছু ফুল এনো তো! আর একটা বড় দেখে গোলাপ এনো”।
“ঠাকুরকে গোলাপ দেবে নাকি?”
“ধ্যুৎ! ঠাকুরকে আবার গোলাপ দিতে যাবো
কেন! একটু গাঁদা আর বেলফুল এনো। ঠাকুরকে দেবো। গোলাপটা আনবে আমার জন্য”।
হালকা চশমার আড়ালে সুবিনয়ের চোখজোড়া যেন
একটু লাফিয়ে উঠল। জিজ্ঞাসু।
একটা দুষ্টুমি মাখিয়ে সাগরিকা কিছুক্ষণ
সুবিনয়ের চোখের ভিতরে তাকিয়ে থাকে। “আজকে যে আমাদের উনিশতম অ্যানিভারসারি, সেটা
ভুলে গেছো?”
ডিনারের পরের সিগারেটটা পুড়ে পুড়ে পৌঁছে গেছে অ্যাশট্রেতে। গিফটের প্যাকেটটা খুলে গোলাপটা সাগরিকার হাতে তুলে দিতেই সে যেন খুশিতে ডুব দিয়ে স্নান করে উঠল। একটা রক্তিমাভা যেন নবজন্ম লাভ করলো সাগরিকার মুখমন্ডলে। অস্ফুটে বলে উঠলো, “আঃ! ঠিক সেদিনের মতো!” একটু আনমনা বিরতি।
“আঃ! সেই রক্তগোলাপ!”
সুবিনয়ের মনোযোগী দৃষ্টি সাগরিকার লালাভ
মুখে। ছোট্টো একটু নীরবতা। মৃদু হেসে বললো, “একটু ইংরেজিতে তর্জমা করে বলো না
প্লিজ!”
“ব্লাডি রোজ!”
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন