কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

সমান্তরাল মহাবিশ্ব ও আমরা



ঠিকই শুনেছেন সমান্তরাল মহাবিশ্ব - এতদিন হয়তো আমরা জেনে এসেছি এই মহাবিশ্ব এবং বিশ্ব একটাই। আমরাই একমাত্র সেই সৌভাগ্যবান যারা কিনা  সৌরজগতের একমাত্র প্রাণের সঞ্চারীতে জন্মগ্রহণ করেছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক সৌরজগতে আমরাই একমাত্র, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সৌরজগৎটা যে একমাত্র আমরাই উপভোগ করছি একথা সত্যি নয়। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও  এর সপক্ষে বিজ্ঞানের যথেষ্ট প্রমাণ ও গাণিতিক নির্ণয় আছে। একটু সহজভাবে সমান্তরাল মহাবিশ্বের উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায় যে - এই ধরুন এই মুহূর্তে যেমন আপনি এই লেখাটি দেখে ক্লিক করলেন, হয়তো এখন পড়ছেনও - সমান্তরাল মহাবিশ্বের সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনারই এক প্রতিরূপ আর এক মহাবিশ্বে বা ইউনিভার্সে লেখাটি দেখে এড়িয়ে গেছেন, আর একটি মহাবিশ্বে আপনার আর এক প্রতিরূপ লেখাটি ক্লিক করে খুলে আবার ধরুন বন্ধ করে দিলো অর্থাৎ লেখাটি খুলেও শেষ অব্দি পড়লো না -- এমনই একটি মুহূর্তের বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য কার্যকলাপ ও ফলাফল সমান্তরাল ভাবেই ঘটমান। কিন্তু  যেহেতু সমান্তরাল তাই আমরা চেষ্টা করেও অন্য আর একটি ফলাফল দেখতে পাবো না।

পরবর্তী কালে মানে উনিশ শতক থেকে এই থিওরি নিয়ে চর্চা বৃদ্ধি পেলেও কিন্তু এর শুরুটা হয় ১৫০০-১৬০০ সালে। সমান্তরাল মহাবিশ্ব তত্ত্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা হলেন দার্শনিক জিয়রদনো ব্রুনো – যিনি কোপারনিকাস-এর সূর্যতত্ত্ব সমর্থন করে চার্চ এবং তথাকথিত ঈশ্বর-পুত্রদের রোষানলে পড়েন। ১৫৮৪ সালে তাঁর একটি বই সেই যুগে তাঁকে আরও সমস্যার মধ্যে ফেলে যেখানে তিনি বলেন, পৃথিবী তো সৌর জগতের কেন্দ্রে নয়ই বরং আরও এমন পৃথিবী তথা সৌরজগতের সংখ্যা বাস্তবে অসীম হতে পারে। ব্রুনো বলেন, এই মহাবিশ্বের আরও অন্য গ্রহে প্রাণের সঞ্চার  থাকা সম্ভব এবং এই ধরনের অসংখ্য প্রাণওয়ালা গ্রহ অন্য মহাবিশ্বে থাকতে পারে। ব্রুনোর এই তত্ত্ব আজকের দিনেই অধিকাংশ মানুষ মেনে নিতে পারবে না, আর সেই সময়ের কথা তো বলাই বাহুল্য। এনার্স ক্যসরের মত কিছু দার্শনিক তাঁর তত্ত্বের গুরুত্ব বুঝতে পারলেও কিন্তু সেই চার্চতান্ত্রিক সমাজ ও ঈশ্বর-পুত্ররা তাঁকে পুড়িয়ে মারে - দিনটা ছিল ১৭ই ফেব্রয়ারি, ১৬০০ সাল।

কিন্তু ইতিহাস বারবার বলে এসছে ব্যক্তিকে মারা যায়, তার দর্শনকে নয়,  সুতরাং এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় কি করে? উনিশ শতক থেকে আবার ব্রুনোর এই তত্ত্ব ফিরে আসলো জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পরবর্তী কালে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার হাত ধরে। সারা জাগানো প্রমাণ পাওয়া যায় আশির দশকে ইনফ্লেশন নিয়ে প্রান্তিক গাণিতিক সমাধানের সময়। এই ইনফ্লেশন নিয়ে সেই সময় মূলত গবেষণা করছিলেন আলেকজান্ডার ভিলেনকিন ও অদ্রে লিন্ড, তাঁরা পর্যবেক্ষণ  করেন, মহাজগতিক স্ফীতি একবার শুরু হলে আর থামে না এবং এর নাম দেন ইটার্ণাল ইনফ্লেশন বা চিরন্তন স্ফীতি। অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা এই চিরন্তন স্ফীতির গাণিতিক পরিণতি মাত্র, কোনো রূপকথার কাল্পনিক গল্প নয়।

অতি সংক্ষেপে অনন্ত মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ধারণাটি হলো : আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের শূন্যতার ভিতর দিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু একাধিকবার ঘটতে পারে, এবং হয়ত বাস্তবে ঘটেছেও। এই একাধিক মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ব্যাপারটি প্রাথমিকভাবে ট্রিয়ন আর পরবর্তীতে মূলতঃ আদ্রে লিন্ডে এবং আলেকজাণ্ডার ভিলেঙ্কিনের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সৃষ্টির উষালগ্নে ইনফ্লেশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদ থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরী হয়েছে, যেগুলো একটা অপরটা থেকে সংস্পর্শবিহীন অবস্থায় দূরে সরে গেছে। এ ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্বের একটিতেই হয়ত আমরা অবস্থান করছি অন্যগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে একেবারেই জ্ঞাত না হয়ে। আঁদ্রে লিন্ডের দেওয়া তত্ত্ব থেকে আসে কেওটিক ইনফ্লেশন যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য সম্প্রসারিত বুদ্বুদ এবং প্রতিটি সম্প্রসারিত বুদ্বুদই আবার জন্ম দিয়েছে এক একটি ‘বিগ-ব্যাং’-এর। আর সেই এক একটি বিগ-ব্যাং পরিশেষে জন্ম দিয়েছে এক একটি  পকেট মহাবিশ্বের। আমরা এ ধরনেরই একটি পকেট মহাবিশ্বে বাস করছি। 


আসলে নব্বইয়ের দশকে দেশকাল (spacetime) কীভাবে ‘ফ্লাকচুয়েট’ করে এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কতিপয় বিজ্ঞানী (যেমন এডওয়ার্ড ফার্হি, এলেন গুথ এবং জেমাল গুভেন প্রমুখ) দেখলেন, দেশকালকে কেবল আইনস্টাইনের
 আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী ইচ্ছেমত বাঁকানো কিংবা প্রসারিত করাই যাচ্ছে না, সেই সাথে একে টুকরো করে ভেঙ্গেচুরেও ফেলাও সম্ভব। কখনো সখনো বৃহৎ মহাবিশ্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে খুব ক্ষুদ্র স্থান বা দেশ জন্ম নিতে পারে। এটিই সেই ‘শিশু মহাবিশ্বের’ উৎপত্তির ধারণা, যেটি নিয়ে স্টিফেন হকিং একটি বই লিখেছিলেন ১৯৯৪ সালে।

(ক্রমশ) 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন