বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২  




আগের বার বলেছিলাম, এই কোভিড আবহে আরো কয়েকটা মহামারী সম্বন্ধিত সিনেমার কথা লিখব, তবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। এই ছবিগুলো মূলত সাইকোলজিকাল। সমাজে কোন মহামারী হলে মানুষ মনের দিক থেকে কীরকম  বদলে যায়, সেই নিয়ে ছায়াছবি। অবাক ব্যাপার, আমার লেখা যখন এগোবে, দেখতে পাবেন এইসব সিনেমাতেও কী অদ্ভুতভাবে যেন আজকের পৃথিবীর জলছাপ  উঠে এসেছে। প্রথম ছবির নাম ‘ব্লাইন্ডনেস’ (২০০৮), দ্বিতীয় ছবির নাম ‘জেড ফর জাকারাইয়া’ (২০১৫) ও তৃতীয় ছবির নাম ‘ইট কামস অ্যাট নাইট’ (২০১৭)। তবে একটা ব্যাপার শুরুতেই জানিয়ে রাখি, মহামারী দেখালেই হিন্দি-ইংরাজি বাজার চলতি ছবির একটা কমন ফর্মূলা আছে... গোটা শহর ফাঁকা, মরে যাওয়া মানুষগুলো ভূতুড়ে জম্বি টাইপ বাঁকা শরীর নিয়ে এগোয়, আর বেঁচে থাকা মানুষদের কামড়ে তাদেরও জম্বি বানানোর চেষ্টা করে। এইসব হাস্যকর ছবির কোন উপাদান আমার লেখায় নেই। 


‘ব্লাইন্ডনেস’ সিনেমার ঝুলিতে বেশ কিছু পুরস্কার রয়েছে। এমনকি এই ছবি ২০০৮ কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘গোল্ডেন পাম’ পুরস্কারের জন্য সেরা ছবির দৌড়েও প্রথম সারিতে ছিল। ছায়াছবির পরিচালক ফার্নান্দো মিরেলেস। মুখ্য চরিত্রে জুলিয়েন মুর
(এখনকার একজন শক্তিশালী অভিনেত্রী, ২০১৪ সালে ‘স্টিল অ্যালিস’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পেয়েছেন) ও মার্ক রাফেলো (‘দ্য অ্যাভেঞ্জারস’ সিনেমার সেই বিখ্যাত হাল্ক)এক পোর্তুগিজ উপন্যাসের ছায়ায় তৈরি এই সিনেমা শুরু হচ্ছে অদ্ভুতভাবে। কোন এক ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় ট্রাফিক সিগনালে এক ব্যক্তি হঠাৎ বুঝলেন, তিনি আর দেখতে পাচ্ছেন না। তার চোখের সামনে সব সাদা হয়ে গেছে। অচেনা একজন তাকে তার গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়িতে ছেড়ে আসার পর সেই ব্যক্তির স্ত্রী তাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলেন। ডাক্তারের ভূমিকায় রাফেলো। তো, রাফেলোর কাছেও এই ধরনের কেস নতুন। তিনি রুগিকে হাসপাতালে রেফার করে দিলেন। কয়েকদিন পর রাফেলোর আরেক রুগিও হঠাৎ এই রোগে আক্রান্ত হল। এবং এরপর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে রাফেলো বুঝলেন তার চোখের সামনেও সবকিছু সাদা হয়ে গেছে। শহরে এই ছোঁয়াচে অন্ধত্ব রোগ মহামারীর মত হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল। ভয়ে মানুষ বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল। এর নাম দেওয়া হল ‘হোয়াইট ব্লাইন্ডনেস’। এই রোগে সদ্য অন্ধ হয়ে যাওয়া আক্রান্তদের, সুস্থ মানুষদের থেকে আলাদা রাখার জন্য, প্রশাসন এক পরিত্যক্ত মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যায় সেখানে তাদের চরম দুর্দশার একমাত্র সাক্ষী হল রাফেলোর স্ত্রীর ভূমিকায় জুলিয়েন, যে অন্ধ না হয়েও নিজের স্বামীর খেয়াল রাখার জন্য অন্ধের অভিনয় করে স্বামীর সঙ্গেই সেই মানসিক হাসপাতালে থাকতে আসেতার সাহায্যেই অন্যরা লাইন দিয়ে বাথরুম যেতে শেখে। এরপর সেখানে প্রতিদিন নতুন আক্রান্তদের আনা হয়, রোজ এদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে অসামাজিক ও শক্তিশালীরা দুর্বলদের ওপর অতাচার শুরু করে। বেশ কিছু বাজে কার্যকলাপ শুরু হয়। পুলিশের গুলিতে অনেকে মারা যায়। একদিন জুলিয়েন সাতজন এইরকম অন্ধকে নিয়ে সবার চোখ এড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ভাইরাস বিধ্বস্ত শুনশান  শহরের মধ্যে দিয়ে তারা এসে ওঠে রাফেলোর নিজের বাড়িতে। হঠাৎ একদিন সেই ব্যক্তি, যে গাড়ি চালাতে চালাতে অন্ধ হয়ে গেছিল, সে দৃষ্টি ফিরে পায়। বাকিরা আবার নতুন করে আশার আলো পায়।

এই সিনেমার সবথেকে নজরকাড়া অংশ হচ্ছে ঐ মানসিক হাসপাতালে অনেক রুগি হয়ে যাবার পর কীভাবে শক্তিশালীরা দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করছে,  হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের ভাগে বেশি পাবার জন্য অসামাজিক কাজকর্ম শুরু  করছে। এমনকি অন্ধ হয়েও বাকিদের ভয় দেখানোর জন্য গুলি চালাচ্ছে। এবার আসুন বাস্তবের মাটিতে। গোটা ভারত কোভিড আতঙ্কে ভুগছে। যে কোন সময় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। অথচ মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হতেই মাস্কের দাম হাতের বাইরে চলে গেল, প্যারাসিটামল অপ্রতুল হয়ে গেল, স্যানিটাইজার আর ডায়াবেটিসের ওষুধ উধাও হয়ে গেল। যে হ্যান্ড-ওয়াশের দাম পঞ্চাশ টাকা, সেটা দেখলাম দুশ টাকায় বিক্রি হচ্ছেদশ টাকার মাস্ক চল্লিশ টাকায়। বাধ্য হয়ে  সাধারণ মানুষ সেগুলো কিনছে। প্রাইভেট হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসার নামে পাঁচ-ছ’লাখ টাকার প্যাকেজ চালু হয়ে গেল। এগুলো অসামাজিক নয়? আরেকটু এগিয়ে আসুন। গত কয়েকমাস হল নিউজ চ্যানেলে দেখছি কোথাও কোভিড আক্রান্তর স্ত্রী ফ্ল্যাটের ছাদে কাপড় মেলতে উঠলে তাকে মারধর করা হচ্ছে, কোথাও আবার আক্রান্তর পরিবারকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে বা হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোথাও সংক্রামিতকে ৬ কিলোমিটার নিয়ে যাবার জন্য ৯০০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে, কখনো মৃত ব্যক্তিকে দাহ করার জন্য বা তার মুখ দেখানোর জন্য তার ছেলে- মেয়ের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে। তার মানে ভাইরাস আক্রান্ত একই সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ, আরেক শ্রেণীর দুর্বল মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার চালাচ্ছে।  মনোযোগ সহকারে ব্লাইন্ডনেস দেখুন – এই মুহূর্তের অনেক কিছুই চোখে পড়বে। 



১৯৭৪ সালে একই নামের বিখ্যাত উপন্যাসের ছায়ায় তৈরি ‘জেড ফর জাকারাইয়া’ ছবির পরিচালক ক্রেগ জোবেল। এই ছবিকে ফিনিক্স ফিল্ম ক্রিটিক সোসাইটি ২০১৫ সালের ‘ওভারলুকড ফিল্ম অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত করেছিল। সিনেমার প্রধান চরিত্রে চিওয়েটেল এজিওফোর। নায়িকার চরিত্রে মার্গট রবি। সহচরিত্রে ক্রিস পাইন। দুজনেই এজিওফোরের তুলনায় জুনিয়র। এজিওফোর অভিনীত ‘টুয়েলভ ইয়ারস এ স্লেভ’ ২০১৩-য় সেরা ছবির অস্কার পেয়েছিল। এজিওফোর বেশ
রিণত অভিনেতা। পকেটে বেশ কয়েকটা বেস্ট অ্যাক্টর পুরস্কার।  তবে বহু বছর আগে দেখা এজিওফো্রের প্রথম যে ছবি আমার মনে দাগ কেটেছিল সেটা হল ‘ডার্টি প্রেটি থিংস’ (২০০২)। যাইহোক, ‘জেড ফর জাকারাইয়া’ প্রসঙ্গে আসি। এই ছবি ভাইরাস ঘটিত কারণে নয়, রেডিও-অ্যাক্টিভ দূষণের জন্য প্রায়  গোটা শহরের মৃত্যুর পর শুরু হচ্ছে। মার্গট জনপদ থেকে বহুদূরে পাহাড়ের ওপর তার পূর্বপুরুষের ফার্ম হাউসে একাই থাকে। চাষবাস করার চেষ্টা করে। চাষ যা হয়, সেই খেয়েই দিন কাটায়। তার বাবা-মা-ভাই মহামারীর পর এই ফার্ম হাউস ছেড়ে জনপদে গেছিল যদি কেউ বেঁচে থাকে, তাদের উদ্ধার করতে। কিন্তু এদের কেউ আর ফিরে আসে নি। সেই থেকে মার্গট একা। একদিন এক ইঞ্জিনীয়র (এজিওফোর) বহুদূর থেকে ওষুধপত্র আর রেডিয়েশন স্যুট পরে (অনেকটা  এখনকার পিপিই কিটের মত) মার্গটের পাহাড়ে আসেসেখানে উপত্যকার দূষিত ঝর্ণার জলে স্নান করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অবশ্য মার্গটের সেবায় আবার ভাল হয়ে ওঠে। এই দুজন মিলে ফার্ম হাউসের চাষবাস অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়, ট্রাক্টর সারিয়ে আবার কর্মক্ষম করে তোলে। এমনকি এজিওফোর জলবিদ্যুতের সাহায্যে ফার্ম হাউসে আলো আনার কথাও ভাবতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই দুজনের রসায়ন খুব কাছাকাছি আসে এবং মার্গট এজিওফোরকে ভালবাসতে শুরু করে। এই অব্দি  ঠিকঠাক। তারপর শুরু হয় সমস্যা যেই তৃতীয় এক ব্যক্তি, ক্রিস, সেই ফার্মহাউসে এসে হাজির হয়। এজিওফোর ক্রিসের অতীত জানতে চাইলে ক্রিস সেইসব প্রশ্ন এড়িয়ে যায় অথচ মার্গটকে জানায় সে ক্যাথলিক। ফলে এজিওফোর ক্রিস-কে নিয়ে সন্দিহান হলেও মার্গট তাকে অভ্যর্থনা জানায় যেহেতু সে নিজেও ক্যাথলিক। এরপর অনেক নাটকীয় মোড় আছে এই সিনেমায় যা সিনেমার প্রয়োজনেই এসেছে। এবং একসময় দেখা যায় এজিওফোর ও ক্রিস জলবিদ্যুতের জন্য ঝর্ণার ওপর বিশাল এক কাঠের চাকা সারাচ্ছে। ক্রিস দড়ি ধরেও পিছলে খাদে পড়ে যাবার মুখে এজিওফোর দড়ির অন্যপ্রান্ত চেপে রেখে দুজনে দুজনের চোখের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে আছে। এখান থেকে সিন কাট করে পরিচালক চলে যান পরের সিনে, যেখানে এজিওফোর মার্গটকে জানাচ্ছে যে ক্রিস তাদের ছেড়ে চলে গেছে এবং মার্গট অনেক খুঁজেও ক্রিসকে না পেয়ে চুপচাপ হয়ে যায়। এরপর ফার্ম হাউসে বিদ্যুৎ আসে। মার্গট ও এজিওফোর তাদের দৈনন্দিন জীবনে আবার অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এবং আমরা বুঝতে পারি যে এজিওফোরের চোখে অপরাধবোধের গ্লানি লুকিয়ে।

এই ছবি দেখে অনেকের মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে জাকারাইয়া-র সঙ্গে ১৯৫৯ সালের ছবি ‘দি ওয়ার্ল্ড, দ্য ফ্লেশ অ্যান্ড দ্য ডেভিল’-এর অনেক মিল আছে। অ্যাটম বোমার বিষাক্ত ছোবলের ফলে এক শহরের জনশূন্য হয়ে যাওয়া, মাত্র দুটি পুরুষ  ও একটি নারীর বেঁচে থাকা, দুই পুরুষের লড়াই আর সবশেষে একসাথে তিনজনের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলা। যদিও আমার মনে হয়েছে, মোটিভ ও ফিনিশিংয়ের দিক থেকে ‘জাকারাইয়া’ অনেকটাই জটিল। এখানে মনস্তত্ব নিয়ে খুব সূক্ষ্ম দিক ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন রিসোর্স সীমিত, তখন প্রত্যেকজন অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। কার কাল কী হবে, কেউ জানে না। কে বেঁচে থাকবে, কেউ জানে না।  ফলে সবাই চাইবে, সে নিজে বেঁচে থাকুক আর প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে প্রতিটা রিসোর্স উপভোগ করুক। এবার ভাবুন, আজ আমাদের সমাজের জটিল অবস্থান কোথায়সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে। সবাই শুধু নিজে বেঁচে থাকতে চায়, অন্যের বিষয়ে কেউ জানতে চায় না। প্রত্যেকেই নিজের বাড়িতে একেক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে বেঁচে আছে। এমনকি কিছুদিন আগেই বনগাঁয় এক কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার বদলে চালক পিপিই কিট পরে পাশ থেকে মজা দেখছিল, কোন একজন মোবাইলে এই ঘটনার ভিডিও তুলছিল, কিন্তু এদের কেউ সেই ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয় নি বলে সে রাস্তাতেই মারা যায়। ভালভাবে দেখুন, ‘জাকারিয়া’ এই ঘটনাই অন্যভাবে দেখিয়েছে।  




তৃতীয় ছবি ‘ইট কামস অ্যাট নাইট’-এর পরিচালক এক তরু, ৩২ বছর বয়সী ট্রে এডওয়ার্ড শাল্টসএইমাত্র যেটা বল্লাম, সেটাকে একটু ঘুরিয়ে যদি এভাবে বলি যে সবাই চায়, সে নিজে তার পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকুক আর প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে সেই পরিবার প্রতিটা রিসোর্স উপভোগ করুক – যার শেষ ধাপ হল ডারউইনের ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’, তাহলে সেই নৈরাজ্যের সার্থক রূপায়ন এই  সিনেমা। এই ছবির ট্যাগ ‘ফিয়ার টার্নস মেন ইনটু মনস্টারস’। ইট কামস অ্যাট নাইট – অন্ধকারে কে আসে? কী আসে? ভয়। আর সেই ভয় থেকেই মানুষ অন্যকে  মেরে ফেলতেও পিছপা হয় না। ছবির শুরুতেই এমন একটা দৃশ্য আছে যা আপনাকে ধাক্কা মারবেই। আমি এই ছবি দেখার পর দু’রাত ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। খালি মনে হত, আমার যদি একদিন ঐ হাল হয়! সুতরাং আমি শুরুতেই  একটু সাবধানবাণী শুনিয়ে রাখি যে নরম হৃদয়ের পাঠক-পাঠিকা এই মুভি দেখবেন না। এটাও বলে রাখি, এই মুভি বেশ কয়েকটা ফিল্ম ক্রিটিক সোসাইটির সেরা হরর মুভি পুরস্কার পেয়েছে।

সিনেমা শুরু হচ্ছে অন্য মুভির মতই, এক ছোঁয়াচে অতিমারীর প্রকোপে দেশের পর দেশ জনশূন্য। এখন যারা বেঁচে আছে, তারা গভীর বনে-জঙ্গলে অন্যের ছোঁয়া  এড়িয়ে, লুটপাট এড়িয়ে থাকে। জঙ্গলে যা পাওয়া যায়, তাই খায়। এরকম এক পরিবারে সিনেমার প্রথম নায়ক জোয়েল এডগার্টন তার বউ, কিশোর ছেলে আর শ্বশুরকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকে। শুরুতেই আমরা দেখি জোয়েলের শ্বশুর সেই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য জোয়েল তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির একটু দূরে গিয়ে গুলি করে শ্বশুরকে মেরে ফেলে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এর কিছুদিন পর ছবির দ্বিতীয় নায়ক ক্রিস্টোফার অ্যাবট তাদের বাড়িতে খাবারের খোঁজে এসে জোয়েলের হাতে আটক হয়। যদিও অ্যাবটকে নিয়ে জোয়েল তাদের বাড়িতে যায় ও অ্যাবটের বউ ও ছোট বাচ্চাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর অনেক টানটান উত্তেজনা আছে, ভয় আছে, নাটকীয়তা আছে, অবিশ্বাস আছেপ্রায় শেষে, অ্যাবটের ছোট বাচ্চার রোগ হয়েছে সন্দেহে জোয়েল তাদের পুরো পরিবারকে গুলি করে মেরে ফেলে। সবশেষে, জোয়েলের ছেলে সেই ছোঁয়াচে রোগে মারা যায়।    

আজকাল আমরা টিভি চ্যানেলে মাঝে মাঝেই দেখি, রাস্তায় কোন একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছে কিন্তু করোনার ভয়ে কিন্তু কেউ তার ধারেকাছে যাচ্ছে না। সারাদিন পড়ে থাকার পর সন্ধেবেলা যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে সে আর নেই। অথবা ফাঁকা শুনশান রাস্তায় কোন বৃদ্ধ রেশন নিয়ে যখন  আসছিলেন, তখন একদল মুখঢাকা যুবক তার ব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। অথবা আরো শকিং ঘটনাও শোনা যায় – বয়স্ক গৃহকর্তা অফিস থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে জ্বর-কাশি নিয়ে ভুগছেন, নিঃশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু তার নিজের বউ-ছেলে-মেয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না করোনার ভয়ে, বরং বাইরে থেকে ঘরের দরজায় ল্যাচ টেনে তারা পুলিশে খবর দিচ্ছে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। পুলিশ এসে দরজা খুলে দেখছে সেই ব্যাক্তি ততক্ষণে মারা গেছেন। এর একটাই অর্থ। এই সমাজের ভেতর এক ঘুণপোকা ঢুকে গিয়ে আমাদের সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রয়োজন হলে পরোক্ষভাবে অন্যকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করছি না। আমরা সবাই চাই যদ্দিন সম্ভব নিজে বেঁচে থাকতে কার আমরা জানি আমাদের প্রত্যেকের জীবন অনিশ্চিত। এটাই তো এই ছবি জোর দিয়ে দেখাতে চাইছে। তাহলে কে বলে যে সিনেমা শুধুই রিল? কে বলে সিনেমা বাস্তবের ছায়ায় উঠে আসে না? আসলে এই তিনটে ছবিই এক সূতোয় বাঁধা – যখন সামাজিক বিপর্যয় আমাদের ঘিরে ধরে, তখন আমরা কী রকম বদলে যাই, আমাদের মনস্তত্ব কোনদিকে চালিত হয়,  অস্তিত্বের বিপন্নতা আমাদের কীভাবে স্বার্থপর হতে শেখায়, আমাদের ভেতরের  রাক্ষসটা কীভাবে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। এ যেন হুবহু জীবনানন্দের ১৯৪৬- ৪৭ – ‘মানুষ মেরেছি আমি – তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে / পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি’।

যাইহোক, ভাইরাস আর মহামারী নিয়ে অনেকগুলো সিনেমার কথা লিখলাম। উৎসাহী পাঠক বাকিটা নিজেরা খুঁজে পেতে দেখুন। এরপর আমি আগামীতে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বা মহামারী নিয়ে কোন সিনেমার কথাই আর কলমের ডগায় আনব না। বরং পরের বার জীবন ও তার উপভোগ্যতা, এই নিয়ে কয়েকটা ক্লাসিক সিনেমার কথা বলব। মন ভাল করব।  

 


1 টি মন্তব্য: