বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

 

সভ্যতার ধূসর পর্ব আর অপনায়ক নন্দলাল




Antihero-র ধারণার জনক ব’লে ধরে নেওয়া ফিওদর দস্তয়েভস্কি Notes from the Underground বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের দশম অধ্যায়ে বলেছিলেন, কোনো  উপন্যাসের পক্ষে নায়ক দরকার, আর antihero-র সকল বৈশিষ্ট্য এখানেই খোলসা করে বলা আছে, আর সব চেয়ে যেটা বড় ব্যাপার, এর সবই একটা অপ্রীতিকর বোধের জন্ম দেয়, কারণ আমরা সবাই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, আর আমাদের প্রত্যেকেই কম বেশি পঙ্গু লোক। আমরা জীবনের এর থেকে এত বিচ্ছিন্ন যে আমরা সবাই একসঙ্গেই সত্যিকার জীবনের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা  পোষণ করি, আর সেজন্যে তার কথা মনে করিয়ে দেওয়া সহ্য  করতে  পারি  না। (‘A novel needs a hero, and all the traits of an antihero are expressly gathered together here, and what matters most, it all produces an unpleasant impression, for we are all divorced from life, we are all cripples, every one of us, more or less. We are so divorced from it that we feel at once a sort of loathing for real life, and so cannot bear to be reminded of it.’) দস্তয়েভস্কির এই বইয়ের ত্রিশ বছর আগেই অবশ্য Georg Büchner তাঁর Woyzeck  নাটকে ‘loser’-এর কথা বলেছিলেন। সেও এক antihero। এদের কাজ বিরাজমান সমাজ আর তার অধঃশায়ী আদর্শতত্ত্বকে  ‘perturber’, ‘disturber’, এমনকি 'subverter’ হিসেবে একটু নড়িয়ে দেওয়া। ব্রেখট বলে গেছেন, ‘Unhappy the country that needs heroes’। মনে আছে চেক লেখক Jaroslav Hašek-এর লেখা Good [মানে bad] Soldier Švejk ব্যঙ্গোপন্যাসের কথা, যার থেকে ১৯৬০-এ The Good Soldier Schweik নামের ছবি আর থিয়েটার ওয়ার্কশপে বিভাস চক্রবর্তীর অসাধারণ চরিত্রায়নে ‘সোয়াইক গেল যুদ্ধে’ সোয়াইক গেল বাংলা  নাটকের কথা। সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে আর্দালি হিসেবে  কর্মরত সোয়াইক সম্পর্কে Victor Brombert-এর In  Praise of Antiheroes: Figures and Themes in Modern European Literature, 1830-1980 (Chicage and London: University of Chicage, 1999) নামক অসাধারণ সাহিত্যসমালোচনা গ্রন্থে কথাগুলি হলো, সমরপ্রিয় উগ্র দেশপ্রেমী এক পাগল হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে এক অবীর কিন্তু বিদ্রোহী জীবনধারণশিল্পী (an unheroic yet rebellious  survival artist in a jingoistic world gone mad), পৃঃ ৭। তার ভান করা মানসিক দুর্বলতাকে সে কর্তৃত্বের সঙ্গে স্থায়ী লড়াইয়ে অস্ত্র  হিসেবে ব্যবহার করে। তার কাজ বিপ্লব নয়, নবারুণ ভট্টাচার্যর ভাষায় ফ্যাতাড়ুগিরি বা চোক্তারি, এই যেমন কর্তৃত্বের বাড়িতে গিয়ে তার বৈঠকখানার সোফায় গোপনে আঙুল ঢুকিয়ে গর্ত ক’রে দিলেন।    

Antihero-র এই জীবনধারণশিল্পীর দিকটা আমি নিচ্ছি। বাংলা সাহিত্যে এর একটা প্রাক্‌নিদর্শনও পাচ্ছি, যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নন্দলাল। আসলে নন্দলালকে দেখছি এই পতিত সময়ের প্রতীক বা নির্যাস হিসেবে। এই পতিত সময়ের চিত্রকল্পায়নের জন্য মুষলপর্বের ইমেজ নিচ্ছি না। সেই কবে  যদুবংশের কিশোররা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার জন্যে শরকাঠি হাতে নিলো, আর দৈবী ব্যতিচারে বা হস্তক্ষেপে শরকাঠি মুষল হয়ে গেল, তখন থেকে বাংলা ভাষায় স্বানীত সংকটের সব চেয়ে কবিপ্রসিদ্ধ, বিবর্ণ বর্ণক মুষলপর্ব। আমি এর নাম দিচ্ছি ধূসরপর্ব। কবে থেকেই Jean Baudrillard-র কথামতো পৃথিবীর সেই ওরিজিন্যাল আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আছে কেবল তার নকল (copy) বা simulacrum। সেই নকল, যাকে বলা যাবে ধূসর অ-পাণ্ডুলিপি তা মানুষের অনেক অত্যাচারের প্রকোপ সহ্য ক’রে শেষে এক ভাইরাসের চাপে ধুঁকছে। কিম্বা হয়তো গ্রিক গে বা হিন্দু শাস্ত্রের ধরিত্রী দেবীর মতো পৃথিবীর মূল পাণ্ডুলিপি হারানো পৃথিবীর নকল নয় তার মহাকীট মানুষরাই ধুঁকছে। তাতে গে-র কিছু আসে যায়ই না। এই সময়ের যুগবাণী বাজছে, ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন, ভালো থাকুন, আর হাত ধোন। ঘরে থাকাটাই সভ্যতার প্রতি আপনার শ্রেষ্ঠ অবদান। আর আমরা সম্পন্ন বৃদ্ধরা নিজেদের বানিয়ে ফেলেছি নন্দলাল। যার সম্বন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন। এই আত্মসর্বস্বতাকে নিয়ে লেখা  ব্যঙ্গকবিতাটি একসময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনবিমুখ মানুষের সম্বন্ধে লোকের মুখে মুখে ঘুরতো। পরে ছাত্রপাঠ্য  কেতাবে স্থান পায়। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা আন্দোলনবিমুখ নন্দলালদের রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রাপ্তির যুগে এই কবিতাটির খবর সমসময়ের অনেকে হয়তো রাখেন না।

নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ-

স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।

সকলে বলিল, ‘আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল?

নন্দ বলিল, ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?

আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’

তখন সকলে বলিল - ‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ!’

 

নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তাহারে কেবা!

সকলে বলিল, ‘যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা।

নন্দ বলিল, ‘ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-

না হয় দিলাম, - কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?

বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারি দিক্।

তখন সকলে বলিল - ‘হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে, ঠিক!’

 

নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ করিল বাহির,

গালি দিয়া সবে গদ্যে পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির;

পড়িলো ধন্য দেশের জন্য নন্দ খাটিয়া খুন;

লেখে যতো তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ;

খাইতে ধরিল লুচি ও ছোকা ও সন্দেশ থাল থাল,

তখন সকলে বলিল - ‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।

 

নন্দ একদা কাগজেতে এক সাহেবকে দেয় গালি;

সাহেব আসিয়া গলাটি তাহার টিপিয়া ধরিল খালি;

নন্দ বলিল, “আ-হা-হা! কর কি, কর কি! ছাড় না ছাই,

কি হবে দেশের, গলাটিপুনিতে আমি যদি মারা যাই?

বলো ক’ বিঘৎ নাকে দিব খত যা বলো করিব তাহা

তখন সকলে বলিল - “বাহবা বাহবা বাহবা বাহা!”

 

নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;

চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,

নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিশনহয়;

হাঁটিতে সর্প, কুক্কুর আর গাড়ি-চাপা-পড়া ভয়,

তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল

সকলে বলিল - ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।

আমরা যারা এই কোভিডক্লান্ত যুগে অপনায়কের নন্দলালবৃত্তি গ্রহণ করেছি, তারা নিজেদের বাড়িকে বানিয়েছি দুর্গ। বাইরে না গিয়ে, ফোনে অনলাইনে রসদ আনিয়ে, বাইরে থেকে ব্যাগে ক’রে ফেরিওয়ালা-ঠ্যালাওয়ালাদের জিনিস তুলে  নিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখছি। কিন্তু বাইরে আছে উন্মুক্ত কারাগার। সেখানে পেটের দায়ে আবদ্ধবিচরণে আটক হাজার মানুষ, যাঁদের অন্ন আসে কেবল এই সম্পন্ন নন্দলালদের জিনিস যুগিয়ে। আমরা জীবনধারণশিল্পীরা বুঝে গেছি যে  একটা সময়ে যে মানুষরা সমাজে, ইতিহাসে বীরনায়কের ভূমিকা পালন করতেন না, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলা হতো এরা দেশের জন্য কেবল মলমূত্র ত্যাগ করেছেন।  কিন্তু এখন অপনায়কদের যুগে তাতেও চলবে। আমরা নন্দলালরা বলব ‘আমরা কত করছি দেখ!/মলদ্বারে স্বার্থত্যাগ’। সকলে বলবে আহা! ‘যদি করো প্রস্রাব,/ ঘরে ও নিভৃতে/ তাতে রবে ঢের ছাপ/ নব পৃথিবীতে’। 


বন্ধু, এই লেখা এক উদ্ভ্রান্ত বৃদ্ধের, যে করোনাগমনকালে যাবতীয় সাবধানতা অবলম্বন ক’রে এখন উত্তর চব্বিশ পরগণার এক অনভিজাত কিন্তু সম্পন্ন এলাকায় চতুর্দিকে করোনাক্রান্তদের বাড়ির মাঝখানে বসে আছে। একটি মৃত্যুর ছায়াও পড়েছে। সে অবাক হয়ে দেখছে ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল’ পংক্তিটি তার ব্যঙ্গবিষ হারিয়েছে। কারণ বীরত্বের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। দেশের জন্য যুদ্ধে, বিপ্লবে স্বার্থত্যাগ আর তার সংজ্ঞা নয়। তার জন্য কেবল দরকার ‘তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে’ থেকে ফোনে অনলাইনে আ-মাজন যাবতীয় কেনাকাটা করা যাতে অর্থব্যবস্থার সংকোচন আটকানো যায়। কিন্তু চতুর্দিকে যা ঘটছে মানুষের উপর অন্যায় যোগীরাজ্যে, দিদিরাজ্যে, মোদীরাজ্যে তার সম্বন্ধে ভাববেন না। আমরা কেবল বলে যাবো, ‘দেশের জন্য করছি দেখ,/ মলদ্বারে স্বার্থত্যাগ’; ‘নিজগৃহে পেচ্ছাপ,/ তাহাতেও ঢের ছাপ,/ থেকে যাবে পৃথিবীতে,/ বেঁচে থেকে যাও জিতে’। সকলে বলবে ‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।

কিন্তু তবু এই আত্মনিগ্রহের পরও সবাইকে আসন্ন মহাপূজার শারদ অভিনন্দন জানিয়ে বলবো এই পূজায় বাইরে প্রতিমা দর্শনে বেরোবেন না। বাইরে পানভোজন করবেন না! এর ফলে করোনাক্রমণ সুনামি হয়ে উঠতে পারে। অপনায়ক থেকে আবার খলনায়ক হবো নাকি?            

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন