কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৬ |
হ্যাঁকাতে
'এ ছেলে ভারি হ্যাঁকাতে।' কাগজের ঠোঙায় চিনি ঢালতে
ঢালতে বলে শ্রীনিবাস। গৌতমমাস্টার হাসে। 'হ্যাঁকাতে' শব্দটার মানেই বুঝবে না শহরের
লোক। অথচ চব্বিশ পরগণায় খুব চলে। খাতাতে ছাত্ররা লিখে ফেললে, বাংলার মাস্টার গৌতম
মণ্ডল কেটে করে দেন, 'একরোখা' বা 'জেদি'। যদিও সেই জোশটা আসে না, তবু মান্য ভাষার উপর জোর দেওয়া তাঁর জরুরি
মনে হয়।
মুজিবরের ছেলে ফজলুল। আজ স্বয়ং মুদির দোকানে এসেছে
আলু-পেঁয়াজ নিতে। ফজলুল এখন সেলিব্রিটি। অথচ ছেলেটা গৌতম মাস্টারের স্কুলের ড্রপ
আউট৷ উদোম গা চুলকাতে চুলকাতে এখন লাজুক হাসছে। সে মহারাষ্ট্রে কবে ভিড়েছিল, খবর
রাখেনি গৌতমমাস্টার। শ্রমিকের ম্যারাথনের কথা কাগজে পড়েও, দড়ি-পাকানো হ্যাঁকাতে
ছেলেটার কথা মাথায় আসেনি।
মুজিবর নকি সর্বস্ব বেচে সাইকেল কেনার টাকা
পাঠিয়েছিল। কুঁচকিতে টান যতই ধরুক, বাড়ি ফিরেছে ফজলুল। তাকে দেখতে আশপাশের গাঁ
উজাড় করে লোক আসছে। খবরওয়ালারাও এসেছে। গৌতম মাস্টারের খানিক ঈর্ষা হয়। আবার
ছাত্রগরবে ছাতিও ফুলে ওঠে।
অন্ধকার হয়ে এল। শ্রীনিবাস ঝাঁপ ফেলছে।
'কাল আর এ দোকান থাকবে কিনা বলতে পারি না,
মাস্টার৷ হ্যাঁকাতে একটা ঝড় আসছে।'
'সাহস বলিহারি তোর!' প্যাডেলে পা মেরে মাস্টার
বলে।
ফজলুল বলে, 'সাহস! ও তো মরণের ডাক, স্যার। মরতি
হলে গাঁয়েই মরব।'
ওর চোখের ভাষা কোন শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়?
আকাশ মাথায় ভেঙে পড়বে এইবার৷ ঝড়ের বিপরীতে সাইকেল
ঠেলতে কষ্ট খুব। রাস্তার আলো নিবে এল। এও সাইকেল, কিন্তু সুখী। বাড়ি পৌঁছতে হাঁফিয়ে
উঠেছে হ্যান্ডেল, প্যাডেল।
বউ হ্যারিকেন হাতে বলছে, 'পিছনের বাড়িগুলোর
অ্যাসবেস্টস উড়ে গেল মনে হয়।'
ওদিকেই মসজিদপাড়া, ফজলুলদের বাড়ি। দিনকতক সরগরম
ছিল। মফস্বলের হটস্পট। মন্ত্রী-সান্ত্রীদের আনাগোনা। এখন নিশ্চয় অ্যাসবেস্টস উড়ে
ঘর থৈ থৈ। এবার? বাঁকা হাসি গৌতম মাস্টারের চোখে।
সে রাত জেগে কাটল। সে কী অশরীরী গোঁ গোঁ অন্ধকার
চিরে! দোতলা বাড়িটা টাইম মেশিন। কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে, শ্বাপদদের মধ্যে একলা কটা মানুষ
অন্ধকারে। জলের পাইপ ফাটল কি? বাথরুমের জানলার পাল্লা উড়ে গেল।
সকালে আড়ালহীন বাথরুমে যাওয়া দুষ্কর। সাইকেল ছেতরে
পড়ে আছে উঠোনে। যে গাছ পড়ে পাইপ ফেটেছে, সেটা কেটে সরানো দরকার। মসজিদ পাড়ায় লোক
মিলতে পারে।
করাত নিয়ে ফজলুল আর তার ভাই এল গুরুঋণ শুধতে।
প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিক অফিস, কাউকেই ফোনে পাওয়া যায় না।
'কদিন জল টেনে কাজকম্ম সারুন স্যার। তেরপল এখন
মেলা মুশকিল হবে, তবে আমরা পেলে আপনাকেও একটুকরো দে যাব'খন। জানলাটা ঢেকে নেবেন।'
করাত ঝুলিয়ে চলে যাচ্ছে মুজিবরের দড়িপাকানো ছেলে।
মান্য বাংলা শব্দ দিয়ে ওর চোখের ভাষা প্রকাশ করা যায় না। গৌতমমাস্টার বিড়বিড় করে।
'শালার হ্যাঁকাতে ঝড়! হ্যাঁকাতে
মানুষ আবার জাগবে নিশ্চয়!'
Khubb bhaalo..
উত্তরমুছুন