কালিমাটির ঝুরোগল্প |
নীলকন্ঠ
আজ হঠাৎ পুকুরপাড়ে একথলে নীলকন্ঠ মোহর পেয়ে গেলাম।
ডাহুকটার পেছু ধাওয়া করে পা টিপে বেলগাছ অব্দি এসে আর দেখা
পেলাম না। পুকুরের ওপর
পানা থমথম করছে। আশেপাশে একটাও পাখি নেই। ভাবছি কোথায় গেল। ঠিক তখনি আমার পায়ের
কাছে ‘ধপ্’। তাকিয়ে দেখি নোংরা কাপড়ের একটা পুঁটলি। কোত্থেকে এল, কীভাবে এল, এসব
ভাবছি আর আকাশে চাইছি। বোমা নেই তো? সাপ-বিছে নেই তো? একটু ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু মানুষের কৌতুহলের কাছে ভয়ও
হার মানে। সেটাই হল।
পুঁটলি একটুখানি খুলেই অবাক। তাড়াতাড়ি আবার দড়ি আটকে দিলাম।
ভেতরে কিছু ধাতব শব্দ, নীল রং। আবার খুললাম। মোহর। অনেক মোহর। নীল রংয়ের মোহর।
প্রতি মোহরের আধা নীল, আধা আকাশি। মাঝে খয়েরি দিয়ে লেখা নীলকন্ঠ। ভারি অদ্ভুত।
আবার দড়ি আটকালাম। একটু ভাবা যাক এগুলো নিয়ে কী করব।
আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মোহর কখনো নীল হয়? মোহর কি
আকাশ থেকে পড়ে? কোন্ রাজা মোহরে নীলকন্ঠ লিখতেন? ইতিহাসে আমি কাঁচা হলেও হিসেবে
পাকা। এটা বুঝতে পারছি আমি এখন আমির। অন্তত একশোটা মোহর। প্রতি মোহর দু-লাখ ধরলেও
দু-কোটি। আর রোজকার দশটা-পাঁচটা নয়। বাড়ি ফিরে সেই এক জীবন নয়। লোডশেডিং নয়।
রেশনের লাইন নয়। ঘ্যানঘ্যানে সিরিয়াল নয়। উত্তেজনায় ঘেমে গেছি। বসে পড়লাম। আর তখনি
নজরে পড়ল পুঁটলিটা। কাঁপছে। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। অনেকটা বড়। কি আছে ওতে? ঘামছি।
দেখছি। আরো বড়। আমার থেকেও বড়। দড়ি খুলে যাচ্ছে। ভেতর থেকে বেগুনি আলো বেরিয়ে এল।
তারপর একে একে নীলকন্ঠ পাখি। ডানার ঝটপটে চারদিকে ‘রোলার রোলার’ শব্দ হচ্ছে।
আমার সামনেই ঝাঁকে ঝাঁকে নীলকন্ঠ পাখি। উড়ছে। গোল করে উড়তে
উড়তে ওরা মিশে যাচ্ছে আকাশে। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন। আমার ডানা হোক। আমিও উড়ে যাই।
মনে হল আজ সেই সময়। সেই স্বপ্নের উড়ান। ওদের পেছনে হাত আকাশে তুলে আমারো উড়তে উড়তে
অথৈনীলে মিশে যাবার আজ হাতছানি। এই সোনাঝুরি, বেল, সেগুন, শিরীষ, দেবদারু,
বাড়ি, ব্যালকনি, রাস্তা, চৌরাহা – সব ছেড়ে আজ আমার হারিয়ে যাবার দিন। আমি আর আমার
স্বপ্ন। বেশ বুঝতে পারছি পিঠে ডানা বেরচ্ছে। চোখ বুজলাম।
কিন্তু আমার বাস্তবের কী হবে? আমি তো পরাধীন। আমি, আমরা, সবাই।
বন্দী। একজন আমাদের
হারিয়ে দিয়েছে। সমাজ ভেঙে যাচ্ছে। সে আমাদের ছুঁতে দেয় না, পাশাপাশি বসতে দেয় না,
ভালবাসতে দেয় না। তার জন্য পুকুরের পাড় বেয়ে মোমবাতি সাজিয়েছি। গোলাপ। ওর সঙ্গে
অন্ধকারে মুখোমুখি না বসেই ডানা গুছিয়ে চলে যাব? চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা মোহরের
ফ্রি-ফল। নীলকন্ঠ অক্ষরগুলো। আরো বড় হচ্ছে। আরো। চোখ খুলে গেল।
তাহলে গল্পটা আবার রি-ওয়াইন্ড করা যাক।
আজ হঠাৎ পুকুরপাড়ে একথলে নীলকন্ঠ মোহর পেয়ে গেলাম।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন