সমকালীন ছোটগল্প |
অন্ধ আলো
মীনা
লোকালয়ের
ভিতর অথচ জনশূন্য। মর্মর ভাস্কর্যগুলি ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে। সবুজহীন পোড়া লাল
টিলার উপর প্রাচীন ধ্বংসস্তুপ। সেসময়কার ভাস্করেরা প্রাসাদটি গড়তে এমন এক ভৌগলিক
অবস্থান বেছেছিলেন যে সব ঋতুতেই বসন্ত হাওয়ার বিরাজ। আদি বাসিন্দারা
বলতেন, রতি মদনের জন্য
বিশ্বকর্মা ভগবান রাতারাতি একটি বিহার পীঠ বানাতে চেয়েছিলেন। নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি, মুরগা ডেকে দিয়েছিল। পাথরের
স্তম্ভগুলিতে শুধুই পুরুষ দেবতা। যুদ্ধ ও প্রেম বিহারের নক্সা। স্তম্ভের জটলার
ভিতরে একটি কারুখচিত ভাঙ্গা চোরা অন্ধ গলি। অবশ্যই গর্ত ও নোংরা লাল মাটির পরিত্যক্ত
উইঢিবিতে ভরা। লোকে এখানে খুব একটা ঢুকতে আসে না। বলে, জোড়া সাপ ঘোরাফেরা
করে। বিষধর ফণাওলা সাপ। মাঝে যে ক’জন পুরাতত্ত্ববিদ ও সংবাদদাতা ওই অন্ধ গলি
দিয়ে ঢুকে গর্ভগৃহে একটি প্রস্তর খচিত শয্যা দেখে বিস্তর লেখালেখি প্রচার করেছিলেন বটে, কিন্তু ওই
পর্যন্তই। জায়গাটি যেমন বিরান ছিল, এখনো তেমনিই।
এখন
সেই পাতালঘরে ছোট ধুনির সাইজের উনুনে রুটি সেঁকছে মীনা। পাথরের কারুখচিত শয্যাটি
এখন তাদের দখলে। না মীনা এখানে একা নয়। সেই পাথর চৌকির বিছানাটি ঘিরে রয়েছে ষোলোটি
পাথরের নগ্ন দেবতা। মর্মর মূর্তিগুলো শোয়া বসা নুয়ে থাকা অবস্থায়
নানান রতি ভঙ্গিমায়। সবকটির পুং লিঙ্গ স্পষ্ট। অন্ধকার মীনার এমন সয়ে গেছে, পাথর কুঠুরির ইঞ্চি
ইঞ্চি নিখুঁত দেখতে পায়। কখনো কখনো মীনা শিউরে ওঠে। পাথরগুলো নরম নরম লাগে? নড়ছে নাকি? ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো
গাঁয়ের মদনাগুলোর মতন?
ওই মত্ত মাতালগুলোকে ভয় হয় না। ওরা ভীতু। এখানে আসতে ভয় পায়। বাইরেই কাজ সারতে হয়।
মীনার ভয় এখানের শান্তিকে, ভয় হয় এই পবিত্রদের। আমি তো নষ্ট, ওরাও যদি নষ্ট হয়ে
যায়? কখনো এমন হলে গলা
শুকিয়ে যায়, শিবলালকে জড়িয়ে ধরে
যেন ওর ভিতরে ঢুকে যেতে চায়। শিবলাল আদর করে। বলে,-কি হল্য? ডরাছিস যে? মীনা আঙুল বাড়িয়ে
দেখায়। শিবলাল জন্মান্ধ। কিন্তু তুখোড় আন্দাজ।–ধুর! এই পাথরগুলানকে তর
ভয়? শরম? গাঁয়ের মরদগুলানের
কাছে তুই তো তোর সব বিকে খাচ্ছিস লো,তব্যা?আর যার দেহ পাথর, জান নাই তাকে তোর লাজ?তুই তো অমন ছিলিস
নাই? ছুটু ল্যা তোকে
দেখছি যে?
–নাগো, হামার ওই ঠাকুর দেবতাগুলানকে
বড় ভয়।
–কেনে
রে?
–না
হামার ছুয়ায় উনারা যদি ছুত্ হয়ে যায়? যদি লষ্ট হয়ে যায়?
মীনা
নগ্ন পাষাণ পুরুষদের কখনো ছোঁয় না। কিন্তু দৃষ্টির কি দোষ? অন্ধকারেও ঘুরে ফিরে নিত্য
নতুন করে নগ্নতা তার কাছে সৌন্দর্য হয়ে ধরা দেয়। এই নগ্নতা বারো ভাতারের মতো
কুত্সিত বিকৃত নয়। একে মীনা দৈবপ্রেম বলে শুরু থেকেই মেনে আসছে। তাও প্রায় বিশ বছর
হয়ে গেল। সেই ছোট থেকে বাপ-মা-হারা মীনা দৃষ্টিহীন নাগরের সাথে গাঁঠছড়া বেঁধেছে, তবে থেকেই সে এই
অন্ধকার রহস্যময় প্রস্তর কুঠুরিতে
নিজের চোখকে পরোক্ষ অন্ধ রাখতে ভালোবাসে। সারাদিন এই চোরা কুঠুরিতে ঢুকে থাকে
মীনা। সন্ধে হতে না হতেই সেজেগুজে বাইরে বেরোয় কোমর লচকে নাগিন সাপের মত। একটা
ঝোলা তার বুকে ঝোলানো থাকে। এলাকার সবাই জানে ওতে থাকে বশীকরণের ও বাণ মারার নানা
উপকরণ। থাকে সাপের খোলস গোদন্ত ঘোড়ারক্ষুর
পেচকেরচক্ষু ও মাংস স্ত্রী-রজ কৃকলাস আরো কত কী! আশেপাশের প্রায় সব গাঁয়ের
বদ পুরুষদের পুরুষশক্তি তার জানা। সাধাসিধে মানুষদের এড়িয়েই চলে। কিন্তু
হারামিগুলোর জন্য ওষুধ ও ওষুধের অছিলায় দেহভাড়া। বেশিক্ষণ বাইরে থাকে না, রাত হতে না হতেই
ফিরে আসে পাথর খোপে। জোড়া নাগ
সে দেখেছে। অবলা জীব, কিন্তু মীনা জানে, ওদের না ঘাঁটালে ওরা
কিচ্ছুটি করবে না। কখনো কখনো মীনা অবাক হয়ে ভাবে, তুমার কী লীলা হে ভগমান!
সাপের মতন অবুঝ জীব,
তাথেও দুজনার কেমন পীরিত?
মীনা
ফিরতে দেরি করে না। দেরি হয় না। ও জানে, পুরুষের গরম খসানোয়
মাত্র ক’মিনিট। তারপর ঝোলায় ভরা ওষুধ
বিক্রি আর পয়সা আদায়। যখন গলির মুখে আসে তখন বিস্তর জোনাকি। একটা ভৌতিক রহস্যময় প্রবেশ
দ্বার দিয়ে মীনা ঘরে ঢোকে। পাথর চৌকির
পাশে একটা পাথরের গর্ত ও জল নিকাশের নালী আছে। হয়তো অতীতে শিবলিঙ্গ ছিল, পুজো প্রার্থনার
ব্যবস্থাও ছিল। এখান থেকে দেবতাকে তুলে অন্য কোথাও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মীনা
শিবলালের জন্যে ওই গর্তে স্নানের জল ভরে রাখে। নিজেও স্নান করে। তারপর দুজনার রান্না
করে রাখে। ওর পায়ে তেল মালিশ করতে বাটিতে রসুন-তেল ফুটিয়ে রাখে। ওইসব করতে করতে মনে মনে শিবলালের সাথে
কথা বলে। কখনো কখনো হুঁশ হয়, পাথর দেবতাদের দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হাসে। আরে? সত্যি সত্যি আমি
বকবক করছি নাকি?
তারপর
প্রতীক্ষা। রাত ঘন হতে নিঃশব্দে
পায়ে পায়ে শিবলাল ভিতরে ঢোকে অলৌকিক ছায়ার মতো। কাঁধ থেকে ঝোলা ভর্তি অবিক্রিত মাল একটি নির্দিষ্ট
জায়গায় রাখে,
বুকে
ঝোলানো টাকার থলেতে খুচরো পয়সা ঝন ঝন করে বাজে। অন্ধ হলে হবে কী, টাকাগুলো গুনে
হিসাব করে রাখে একটা পাথরের গুপ্ত কুলুঙ্গীতে। তারপর নিশ্চিন্তে জামাকাপড় খুলে পাথরের
বাথটবে নিজেকে অর্ধনিমজ্জিত করে। মীনা তার গায়ে সাবান মাখায় আর বাঁকা চোখে
দেবতাদের দিকে তাকায়। স্নান সেরে শিবলাল পাথর সিংহাসনে সম্রাটের মত বসে। মীনা
আবেগে আপ্লুত হয়। মীনা জানে, ওই পাথরের আসনে বসলেই
শিবলালকে কেমন ক্যালেণ্ডারের নারায়ণ
ঠাকুরের মতো লাগে। মীনার বুকে প্রেমের উফান ওঠে। লক্ষ্মীর মতো সে নারায়ণের পাশে
বসার জন্যে ছটফট করতে থাকে। শিবলাল মীনার আবেগ বোঝে। পাথরের উপর হাত থাবড়ে ওকে
বসতে ইঙ্গিত করে। ওদের মৌনভঙ্গ হয়। শিবলালের প্রবচন শুরু হয়।
আগে
আগে মীনা বলত, তোর কি ভয় ডর নাই? রাত্যের বেলায় না জানি কত
জীব কত হাওয়া ঘুরে বুলছে। রাত্যের বেলায় আঁধারে কোন দিকে পা পড়ছে না পড়ছে, যদি খালে খুসালে পড়্যে
হোস তো কী হবেক?
শিবলাল
হাসে,
আমার
আবার দিন কি রাত, আলো কি আঁধার। আমার সবেতেই হুঁশ গো। তরা চোখ দিয়ে যা দেখিস বুঝিস
আমি আমার ভিতর দিয়ে সেটা বুঝি। আমার কি ডর?
শিবলালের
ভয় ডর নেই। অন্ধ চোখের পিছনে আছে অতি সজাগ দৃষ্টি। মীনা একথা উঠতে বসতে টের পায়।
শিবলাল রোজ তার ফেরির গল্প শোনায়। ডেলি প্যাসেঞ্জারেরা বলে শিবলালের মারাত্মক হুঁশ। বেশি নয়, সারাদিনে দুটো আপ
ডাউন লোক্যাল ও দুটো চলতি এক্সপ্রেসে অনায়াসে ওঠা নামা করে। নেল কাটার থেকে বাচ্চার খেলনা সব ঝোলা থেকে নিমেষে বার
করে, আর ওর টাকার হিসেব রাখা
চোখওলা চৌকস দোকানির মতন।স ব টাকাই ও ছুঁয়ে বুঝে যায় আর
ফেরত টাকাও ঠিকঠাক দিতে ভুল হয় না। বড়দের তাসের সেট ও রুবিক কিউব রাখে। দেখতে না
পেলে কি হয়, তাসের ম্যাজিক ও
রুবিকের সমাধান নিমেষে করে দেয়। একবার একটা বাচ্চাকে খেলনা
মোবাইল বিক্রি করতে দেখে এক প্যাসেঞ্জার কি একটা বাঁকা কথা
বলেছিল। শিবলাল গা না করে মুচকি
হেসে চলে যাচ্ছিল। এক রেগুলার প্যাসেঞ্জার শিবলালকে থামতে বলে ওই ভদ্রলোককে তাঁর
স্মার্ট মোবাইল শিবলালের হাতে ধরিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিল। মুখে বলেছিল, শিবলাল ওই টাচ মোবাইলে
রেকর্ডিং গান বা ইউ টিউব খুলে গান বাজিয়ে দেখাতে পারে। শিবলাল সেই অসম্ভব চমত্কার
কাজটি করে দেখিয়েছিল। শিবলালের এইসব রোজনামচা শুনতে শুনতে মীনা শিবলালকে জড়িয়ে ধরে
কখন যে ঘুমিয়ে যায়!
শিবলাল
আজ ট্রেন
আউটারে ঘণ্টাখানেক থেমে যেতেই ওই লোকটা আবার তার মাথাটা খেয়ে শূন্য করে নেমে গেছে।
তারপরও একঘণ্টা শিবলাল নিজের ও পরিবারের জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন ও উত্কণ্ঠিত অসাড় হয়ে
ট্রেনের দরজায় ঠেস দিয়ে বসেছিল। অনেকে ওকে পা মাড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে পার হচ্ছিল। তাতে
আরও নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল সে। এরকমটা আগে কখনো হয়নি। চলতি ট্রেনে ভিড়ের মধ্যেও সে
এমনভাবে চলাফেরা করে যে সামনে বা পিছন দিয়ে কেউ এলে গেলে আগে থেকেই সরে যায়।
রেগুলার যাত্রী এটা লক্ষ্য করে খুব অবাক হয়ে যায়। শিবলালের আজ বুক
ধড়ফড় করছে। থেকে থেকে মাথা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। দিকভ্রষ্ট হয়ে টলে পড়ছে শরীর। ওই
লোকটা... ওই লোকটা তার মাথার ভিতরে ঢুকে সর্বস্ব শুষে নিয়েছে
যেন। তার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার, ওই মানুষটা শিবলালের মনের সব গোপন কথা কী করে গড়গড় করে বলে
দিল? আজ মাস দুই
ধরে ছায়ার মতন সেঁটে রয়েছে ও। বার পাঁচেক ও শিবলালের সাথে
কথা বলেছে। শিবলাল অস্বস্তিতে
চুপ,
কিন্তু
ওই লোকটা গড়গড় করে মীনার কথা বলেই গেছে।
আজ
পথ হাঁটতে খুব ভুল হচ্ছে শিবলালের। এমন দিশাহীন সে কখনো হয় না। দিশার কথা তাকে
ভাবতে হয় না। পা নিজে নিজেই পথ খুঁজে নেয়। সে জন্মান্ধ, চোখে দেখার আকার
প্রকার কী তা তো তার বোধগম্য নয়, কিন্তু সচল নিশ্চল
বস্তুর জ্যামিতি সে নিজের
মতো জেনে গেছে। ধাতু জৈব রঙ আকার সব অংকের মতন নিমেষ সমাধানে মাথায় আসে। একবার সে
মীনাকে বলেছিল, তোর মাসিকের রঙ লাল, আমার ভিতরে রক্তের
রঙ লাল, গোলাপের রঙ লাল। এই লাল কী? আমি বুঝতে নাই পারি মীনা। লাল কী আমাকে বুঝা। মীনা
সরলভাবে বুঝিয়েছিল, তাসলাতে (পোড়ামাটির ছোট গামলা) কাঠকয়লার আগুন যখন ধুঁকিস (হাওয়া
করা) ন? তখন কেমন আঁচ লাগে
বল ন? গরম তাপ লাগে কি না? ওই জ্বলন্ত আঙ্গার
তাপটা লাল রঙের।
-হ্যাঁ? তবে হামদের রক্তও
গরম? কি বলিস?
–হঁ
লাল। ছুঁলেই তাপ।
অন্যদিন
সে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পড়ত। সামনে কোনো মাল বা মানুষ আছে কিনা অনায়াসে বুঝে
যেত। আজ প্লাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেন থেকে নামতেই পড়ে গিয়ে হাঁটুতে চোট লাগলো। হাঁটতে
গিয়ে সারা গা কাঁপছে। এমন তো কখনো হয়নি? কোন মানুষের কেমন অবয়ব তার মাথায় আসে আর তেমনি তার
সাথে ব্যবহার হয়। কিন্তু এখন তার মাথায় আর কোনো কিছু আসছে না। শুধু
একটা ছায়া ছায়া আকার। তাড়ালেও যাচ্ছে না। শিবলাল জানে ওই ছায়া অবয়ব
সেই লোকটার। কোনো কিছু কি হতে যাচ্ছে? মীনা ভালো থাকলেই হলো। ও ভালো না থাকলে দুনিয়া
আঁধার। আতঙ্কিত শিবলাল স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কার গলা পেয়ে চমকে
উঠল, আরে
শিবলাল? এত রাতে তুমি ওদিকে
কোথায় চললে? শিবলাল বুঝতে পারলো
সে উল্টো দিকে চলে এসেছে। বড় অসহায় লাগলো নিজেকে। লোকটা এগিয়ে এসে হাত ধরে তার
বিহড় ডুংরীর রাস্তা ধরিয়ে দিল। ধীরে ধীরে সে নিজবাসে এলো বটে কিন্তু তার সামনে ওই
অদৃশ্য ছায়া একমুহূর্তেও তাকে ছাড়েনি। ভগ্নস্তুপে ঢোকার রাস্তা
উঁচু ও পাকদন্ডি। শিবলালের অসুবিধে হয় না। সে গলিমুখে এসে আকাশের
দিকে মুখ তোলে। আজ নিশ্চয়ই পূর্ণিমা। সারাগায়ে কেমন শীতল স্পর্শ। একেই কি আলো বলে? ঠিক মাথার উপরটা
ঠান্ডা ঠান্ডা লাগতে শিবলাল বুঝে যায় এখন অনেক রাত। কুঠুরিতে ঢোকার এই গলিটার কোনো
ছাদ নেই। জ্যোত্স্নার আলো ফুটফুট করছে। পায়ের নিচে ঠান্ডা নরম ধুলো। মীনা বলে লাল
কার্পেট।
সুড়ঙ্গ
গলিপথ দিয়ে কুঠুরিতে ঢুকতে ঢুকতে শিবলালের কপালের ভিতরে ধকধকে জ্বলন্ত অঙ্গার তেজ।
সেই লাল জ্যোতি মাথার ভিতরে চক্কর দিচ্ছে আর সেটার পিছনে সেই ছায়া লোকটার গলা খাঁকারি
‘শিবলাল শিবলাল’। শিবলাল হাঁটু ভেঙে সেখানেই
বসে পড়ে। পাথর দেওয়ালের ছুঁচালো নক্সা তার কোমরের কাছে বিঁধে যায়। তার অতি
স্পর্শকাতর ভাবাবেগে জন্মগত প্রাকচেতনা এসে তাকে সচেত করে তোলে। ভয়ডর তার কখনোই
ছিল না কিন্তু এখন হঠাৎ ভীষণ ভয় পায়। কপালে বিনবিন করে ঘাম ফোটে। পরিষ্কার বুঝতে পারে, লোকটা নিশ্চয় এইখানে
পৌছে গেছে। মীনার কাছেই আছে। কী ক্ষতি করেছে ও? কী করতে পারে? মনে পড়ছে, ট্রেনের বাজনা
শব্দের তালে তালে ওর কথাগুলো শিবলালের মরমে ঢুকছিলো। মনে হচ্ছিল ওর কয়েকটা দাঁত
নেই,
মুখে
উত্কট মড়া গন্ধ,
গলায়
অসুখ পেটও ঠিক নেই। বলা নেই কওয়া নেই শুরু হয়ে গেছিল ওর খেঁসখেসে কথা শিবলালের
কানের গোড়ায় মুখ রেখে, শিবলাল হে, তোমার তো তিরিশের ভাগলপূরিয়া
বউ। তায় আবার নিজস্ব মরদ থাকতেও চরে খাওয়া বাঁজা। ওইসব মেয়েছেলে আমার
বিরাট পছন্দ। সারাদেশ চষে বেড়ালেও ওই একটিই স্যাম্পেল। সেটি তোমার
বউ। হ্যাঁ আগে জন চারেক খুব খুঁজে খাজে পেয়েছি তবে ওরা আর বেঁচে নেই। তুমি এখন
ভাবছো আমার পরিবারের কথা? না হে না, আমার এতেই আনন্দ। ধর আর
মারো। ওর গলার আওয়াজ বদলে গেছিল।
এইকথা
এখন মনে পড়তেই শিবলাল কেঁপে উঠলো। মনের গহন থেকে অতিচেতনা তাকে তার মহাবিপদের
ইঙ্গিত দিচ্ছে। মীনা তার চেতন জীবনের ওতপ্রোত অঙ্গ। মীনা ছাড়া জীবন সত্যিকারের
আঁধার। ও মীনাকে কী করবে? অন্ধপাথুরে গলির মাঝে শিবলাল পড়েই থাকল। ওই লোকটার
বাঁকা দুর্গন্ধময় কথা এখন মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর প্রাকচেতন শক্তি শিবলালের
চেয়েও প্রখর। বলেছিল,
শিবলাল তোমার রাখনিটাকে আমি মনশ্চক্ষে হরদম দেখি। কিন্তু চাক্ষুষ কখনো দেখিনি। মাইরি
বলছি। ভগবান আমাকে এমন দৃষ্টি দিয়েছেন, জানো? এখন তোমার বউটা ল্যাংটো হয়ে একজনার চান করার মতো একটা
ডোবাতে ডুবকি মারছে, আর মনে মনে তোমার কথাই ভাবছে, এটা আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট
দেখতে পাচ্ছি।
শিবলাল
পড়ে পড়ে হাঁফাতে লাগলো। এতদিন অন্ধত্বের উপর কোনো অনুযোগ ছিল না পরোয়াও ছিল না।
মনোলোক আর দৃশ্যলোকের তফাত বুঝতে চেষ্টা করেনি। কিন্তু এখন নিজের উপর ধিক্কার
হচ্ছে। যে সময় ট্রেনে বসে ওই লোকটা ওই কুকথা বলছিল সত্যিই
তখন পাথর চৌবাচ্চায় মীনার স্নানের সময়। একথা মীনা আর শিবলাল ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তির
জানার কথা নয়। তাহলে কি ওই লোকটা মনশ্চক্ষে ওদের সবকিছু আন্দাজ করে
ফেলেছে? শিবলাল অন্ধগলির
মাঝে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। পাথর দেওয়ালের একটা ফাটলে গুঁজে রাখা আছে ওদের দুজনার তিল
তিল করে জমানো সঞ্চয়। মীনা মাঝে মাঝেই বলে, এই পাথর দেবতাগুলানের মাঝে
আর থাকতে মন চাইছে না গো! ইবারে তো চল কুথাও ঘর বাঁধি। ঘর ফিরতি শিবলাল রোজ মনে মনে সঞ্চয় গুনে নেয়। রোজ
প্রার্থনা করে,
ভগবান
আর কতদিন মীনাকে দিয়ে কুকর্ম করাবে? ইবারে তো উয়ার শরীর লষ্ট করাকাজ বন্ধ কর।
মীনার
রোজকার শরীর ভাড়া দেওয়ার কথা ওরা দুজনেই মেনে নিয়েছে। তাই যত দিন যাচ্ছে প্রেম
বাঁধন ততই গাঢ় হচ্ছে। এইসময় ওই লোকটা মীনাকে ভোগ করে তো করুক, শিবলালের অনিষ্ট
কিছু হবার নেই। কিন্তু ওই টাকাটা? ওই লোকটার যা ক্ষেমতা আর বুদ্ধি, টাকার গন্ধ যদি পায়
তাহলে?
সারা
জীবনের রক্ত জল করা টাকা। যখন থেকে হুঁশ হয়েছে, সেই কচি বয়েস থেকে
মীনা আর রোজগার ছাড়া তো কিছুই জানা নেই। সেই ভিক্ষা থেকে ফিরি পাই
পাই জমানো টাকা। এতদিনের এই দুর্গম সাপখোপের বাসে কারও বুকের পাটা নেই যে এখানে
ঢোকে। সেখানে ওই লোকটা নিশ্চয় ঢুকে আছে। তাও এই রাতের বেলায়? ওনারা জোড়ায়
ঘোরাফেরা করেন এখন। সে কেমন শয়তান। শিবলাল এই প্রথম বুঝতে পারলো তার অন্ধ চোখ থেকে
জল গড়াচ্ছে। ভেবেছে দুজনা এই বদ্ধ নোংরা সংসার থেকে পালাবে। এখন মীনা ও
সঞ্চয় দুইই সংকটে। শিবলাল ভাবে, মীনার আর কী হতে পারে। ওকে যা করার করবে। তা না হয় ওর সহ্য করার
ক্ষমতা আছে। কিন্তু...
শিবলাল
হঠাৎ
চমকে গেল। মীনার সদ্য স্নান করা উদোম গায়ের গন্ধ। এত কাছে? ঘর ছেড়ে গলিতে এসে
গেছে,
ল্যাংটো? কি হয়েছে? শিবলাল হাওয়াতে নাক
ঘুরিয়ে শুঁকতে লাগলো। আরেকটা খুব হালকা দুর্গন্ধ। ওই লোকটার মুখের
গন্ধ? লোকটা মীনাকে ধরে
রেখেছে। কানখাড়া করে শব্দ শুনতে লাগলো। লোকটা মীনার সাথে নিশ্চয় কিছু করছে। শিবলাল ওমনিই পড়ে রইল। ঝোলার
খেলনা জিনিষগুলো ছড়িয়ে পড়ে আছে তার পাশে। এখন ভিতরে যাওয়াই যাবে না।
একটুও বাধা দেবার চেষ্টা করলে লোকটা খুনখার হয়ে কিছুই করে বসতে পারে। শিবলালের
ঠোঁটের উপর দু’ফোঁটা নোনাজল। শিবলালের বুকের ওপর আছড়ে পড়ল মীনা।
মীনার চোখে জল এই প্রথম বুঝলো সে। শিবলাল ওর সারা দেহে হাত ঘোরাতে লাগে।
–ই
কি মিনু? তর হাতগুলান পাছ
বাঁধা কেনে? কি করেছে তোকে যে
কাঁদছিস?
-না
হামাকে এখনো কিছু করে নাই। তব্যা উ উয়াদেরকে... মীনার গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।
-কাখে? কাখে কি করল্য?
-উয়াদিগকে
লোকটা এসিড দিয়ে মরাল্য।
শিবলালের
শরীর অবশ হয়ে আসে। এতদিন এ পৃথিবী তার জন্য অন্ধকার ছিল না। এখন সত্যিকারের
অন্ধকার তাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে। দুটি নাগ রক্ষক হয়ে ছিল তাদের দুজনের। ওরা
সর্বক্ষণ জোড়ায় থাকতো, জোড়ায় ঘোরাফেরা করতো। সেই রক্ষাকর্তাদের আকার প্রকার তার জানা নেই, কিন্তু ওদের বলিষ্ঠ
প্রহরা তার জানা ছিল।
-উ
ওই লোকটা কুথায়? জবাব পেল না
শিবলাল। তার বুকের উপর নগ্ন মাংসল চাপ হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। চারপাশটা
নরকের দুর্গন্ধে ভরে গেল। আর চাপা হাসি। মীনাকে তুলে নিয়েছে লোকটা। মীনার সাথে
কিছু করতে যাচ্ছে। শিবলাল প্রাণপণে নিজেকে চেপে স্থির হয়ে পড়ে
রইলো। গন্ধে ও শব্দে বুঝলো মীনা আর ওই লোকটা তার খুব কাছে ধুলো মাটিতে পড়ে আছে।
মীনার মুখ বাঁধা। পা আছড়াচ্ছে। পায়ের তোড়া টিনটিন করে বাজছে। শিবলাল হাতজোড় করে
কাতর গলায় বলতে লাগলো, ও ভাই, মিনুর হাত পা মুখ বাঁধ্যে রাখেছ কেনে? খুলে দাও কেন্নে।
ধুলায় কেনে ফেলে রাখেছ উয়াকে? ভিতরে যাও। সিংহাসন আছে, শুয়াও। যা করার কর। উ
পালাবেক নাই। আমি কথা দিচ্ছি। এই ধুলা কাঁকরে মীনার বড লাগে গো। আমি এই ছুটু ল্যা
উয়াকে দেখছি। আরেকপ্রস্থ দুর্গন্ধময় খিকখিক হাসি।
-আমি
তো সেটাই চাইছিলাম। মাগীটা বলল কীসব পাথরের দেবতা অশুচ হয়ে যাবে। শ্লা যতসব নাখড়াই।
এবার মীনার মর্মান্তিক গোঙ্গানি। শিবলাল কেঁপে ওঠে। মীনার
অনেক সহ্য। ও চটকরে কাতর হয় না। তবে কি লোকটা?
–হাঁ
দেখ বাবু। মানুষে যেমন ভোগ করে, তেমনি আরামসে কর। উয়ার বাঁধন খুলে দাও দেখি। আমি
একটুও বাধা দিব নাই।
-তুই
তো অন্ধ রে শিবলাল। তুই কি বাধা দিবি? আমাকে আমার কাজ করতে দে।
-কি
করব্যে আমার মিনুকে?
কি কাজ?
-চামড়া
ছিঁড়ব আর খন্ড খন্ড কাটব। অনেকদিন উপোসি আছি। অনেক
বুদ্ধি করে একটা পেয়েছি।
ঝলকে
ঝলকে হিসহিস দুর্গন্ধময় জবাব।
-কাটা
ছেঁড়া কর না গো। আমি যে সহ্য করতে পারব না। শুন, আমার অনেক টাকা জমা
আছে। মিনুকে নিয়ে ঘরের ভিতরে যাও। পাথরের খোপ থেকে টাকাগুলান উ বাহির করে দিবেক।
লিজের ঘর করার জন্যে টাকা। সেই ভিখ মাঙার বয়েস থাক্যে। সব লাও কানার লাঠি কেড়ে নিও না
গো!
-আঃ
শালা কানাটা আচ্ছা জ্বালাচ্ছে তো? আমার সুখটাই নষ্ট করে দিচ্ছে। আরে তোর ভিখের টাকা
নিয়ে আমি কি করব?
চুপ। চুপ কর বলছি। নইলে এখনি তোর গলার নলি দু’ফাঁক করে দেব।
লোকটার
গলা নেমে এল। মীনার নাকি সুরে আর্তনাদ। শিবলাল দেখল লোকটাকে
থামানোর একটাই উপায়। ওর পৈশাচিক সুখে ব্যাঘাত দেওয়া। শিবলাল ‘ও মাগো ও বাবা রে’ বলে চিত্কার করতে
শুরু করে দিল।
কিছুক্ষণ পরই শিবলালের বুকের
উপর ভারী চাপ। লোকটা ওর বুকের ওপর চেপে বসেছে। একহাত শিবলালের মুখ চেপে ধরেছে। মাটিতে দু’হাত থাবড়াতে লাগলো শিবলাল।
ধুলোর গন্ধ ও লোকটার চাপ আর সহ্য হচ্ছে না। মীনা এখন কি করছে? নিজের কষ্টের চেয়ে
ওর চিন্তায় চোখ আবার গরম হয়ে উঠল। শিবলাল হাত মাটিতে ঘোরতে ঘোরাতে একটা ছোট্ট
প্লাস্টিকের খেলনা বল হাতে এল। মুঠো করে ধরে থাকলো সে। তার প্রাকচেতন নির্দেশ
দিয়েছে কি করতে হবে। লোকটা একটুক্ষণ থেমে গেল। তারপর হো হো হাসি।
–কি
করবি শিবলাল?
ওই
অতটুকু বলটা নিয়ে খেলবি না আমায় মারবি? তো নে, মার আমাকে। হা হা হা।
এবার
ধুলোর গন্ধ ছাপিয়ে অসহ্য দুর্গন্ধ। শিবলালের মুখের ওপর লোকটার
মুখ। লোকটা ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে বুকের বোতাম খুলতে ব্যস্ত। শিবলাল চুপ করে রইল।
-ঠিক
আছে। আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। সেটা না করে আগে তোর মুখ বন্ধ করি। তারপর
নিশ্চিন্তে...
-কি
করব্যে গো? আমার জামা খুলছো?
-ছুরিটা
তোর বুকে গাঁথব।
শিবলাল
মনে মনে মেপে নিলো লোকটার মুখের দূরত্ব। সে জানে ওই লোকটার প্রাকচেতন শক্তি ওর
চেয়ে বেশি। আগে থেকেই বুঝে যায় কি হতে চলেছে। তাই ওর মন অন্যদিকে আকৃষ্ট করা
দরকার। শিবলাল হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
-দয়া
কর। আমাকে মার না গো। তুমি যেমনটি বলবে আমি তাই করব। আমাকে মেরে কি করবে? আমার গুর্দা (কিডনি)
বিকবে? মীনার চামড়া বিকবে? হ্যাঁ গো আমার বড়
জোর পিসাব লেগেছে। ইখেনেই করে দিই?
লোকটা
শিবলালের বোকা বোকা কথাতে হা হা করে হেসে উঠলো। শিবলাল এই মুহূর্তের অপেক্ষাতে
ছিল। হাত উঠিয়ে ওর হাঁমুখ লক্ষ্য করে সজোরে প্লাস্টিকের পিংপং বলটা মুখের ভিতরে
চালান করে দিল। বাহুমূলে একটা তীক্ষ্ণ চিরে যাওয়া ব্যথা ও আঙুলে লোকটার ভাঙাদাঁত
বসে যাওয়া শিবলাল তোয়াক্কা করল না। লোকটার গলা অব্দি বলটা আরও ঠেসে দিতে লাগল।
মীনা
কোনোমতে দেওয়াল ধরে তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। জ্যোত্স্না যেন পাথর দেওয়াল ভেদ করে তার
নগ্ন শরীর আরপার। চাঁদ যেন তখুনি অনেকটা নেমে এসেছে। সবকিছু
স্বচ্ছ দিনের মত। এমনকি তার ঊরু দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া রক্ত ফিকে লাল, পরিষ্কার দেখতে
পাচ্ছে। মীনা ঘরঘর গলার জান্তব আর্তনাদ শুনে তাকাতেই পরিষ্কার
দেখতে পেল একটু দূরে বসে উজ্জ্বল মণিমানিক খচিত মুকুটপরা শিবলাল সত্যিকারের
নারায়ণ। তার হাতের সুদর্শন চক্র ওই লোকটার গলায় ক্রমশ ক্রমশ বসে যাচ্ছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন