কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

দেবলীনা চক্রবর্তী







কবিতার কালিমাটি

ছেঁড়াপাতা...


(১)

এই স্থবির নিঃশ্চুপ জীবনে কিছু স্বয়ংক্রিয় উদ্ভট ভাবনা ও আতঙ্ক গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে আর টোকা দিয়ে যাচ্ছে বেলা-অবেলায়। ওদের শহরে কোন কারফিউ নেই, ওরা নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে গলি থেকে রাজপথ, গ্রাম থেকে মোহল্লা। সীমাহীন স্বাধীনতা এখন ওদের রাজ্যে। রাতের অন্ধকার হোক বা সকালের নরম ভোরের আলোয় ওদের বিষাক্ত ডানায় ভরা আছে যে নীল বিষ, ছড়িয়ে দিচ্ছে অবলীলায়, অকাতরে! আর আমরা বুকের হাঁপরে, নিশ্বাসে প্রশ্বাসে জড়িয়ে নিচ্ছি সেই ভয়!

আমরা যতই থাকি ঘরবন্দি ওরা কিন্তু জানে আমাদের মনের গোপন চাবিকাঠি! জানি না কবে নির্মূল হবে ওদের এই অবাধ্য আধিপত্য!


(২)

কিছু কিছু দিন হয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপমা নির্ভর। যেভাবে খুশি তাকে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করা যায়, প্রতিটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই তাকে ভীষণ সুন্দর লাগে, তাকে আদর করে ছোট্ট ছোট্ট বিশেষ নাম ধরে ডাকা যায়। নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে আয়নার সামনে রাখা যায় আরও একটু বেশি তৃপ্তি পাওয়ার জন্য।  
অর্থাৎ একটা পরিপূর্ণ দিন তার সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই ধরা দেয় আর তার বর্ণালি ছটায় মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া যায়। 
     
কিন্তু এর বিপরীত দিনও তো আসে, যা ভীষণ  সাদামাটা, কেমন ফ্যাকাশে মনে  হয়। তার রূপ রস গন্ধ বর্ণ সব যেন কেমন আলুনি স্বাদের! উপমায় বর্ণনা করা যায় না কিছুতেই... ভালো না’লাগাগুলো যেন সেই দিনগুলোতে আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরে, মন খারাপের মেঘ জমে। গুমোট মনে বৃষ্টি নামলেও তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, লুকিয়ে রাখতে হয়। 
            
তাহলে উপমা কি শুধু সৌন্দর্যের পরিভাষা! যা শুধু চঞ্চল করে, দৃপ্ত করে, উর্বর করে তাকেই শুধু মনে ও শব্দে গেঁথে রাখতে হয়!
কিন্তু যে মলিন, যে অপুষ্টিতে ভোগে - যার শরীরে তাপ বাড়লে কপালে হাত দেওয়ার কেউ নেই! মন খুলে মনের কথা কাউকে বলতে চায় তবু তার তেমন বিশ্বস্ত বন্ধু নেই! খোলা মাঠে সকলের সাথে স্বাধিকারে ছুটতে চায়, রঙিন মলাটের ছবি বই ওল্টাতে চায়, ধর্ম নির্বিশেষে এক পাতে বসে পেট ভরে খেতে চায়! 
তাদের কেন কোন অলৌকিক উপমায় সাজানো যায় না! এ অক্ষমতা কার! 

মনের এই অক্ষর দোলাচল কবে গাণিতিক সরলরেখা টানবে শব্দের সরল বিন্যাসে!
এ প্রশ্ন ভীষণ ঝড় তোলে কলমে, কলম ভেঙে আসে...

৩)

 জুড়ে থাকা যে কোন আনন্দের অনুভূতি'টাই আলাদা, সে পরিবারের সাথে জুড়ে থাকা হোক বা পরিচিত পরিবেশে অথবা স্মৃতিতে না হয় কোন সদিচ্ছায় কিম্বা শব্দ কুহকে। এই শব্দ সত্যি কুয়াশার মতো কখনো ঘন, গাঢ় ঠান্ডা ভিজে অনুভূতির মতো প্রত্যাশিত, আবার কখনো পাতলা চাদরের মতো সুখে আবিষ্ট হয়!


কথায় কথা বাড়ে যেমন প্রথমে আলাপচারিতা, ভালোমন্দ আদান প্রদান তারপর খুশি উচ্ছ্বাস কলরব। এরপর কথার সরণি বেয়ে বহুদূর ছুটে যাওয়া, মাঝেমধ্যে স্পিড ব্রেকারে হোঁচট আর তারপর শহর ও প্রান্তিক লোকালয় ছাড়িয়ে গেলে মাঝে মধ্যে টোল প্লাজা অর্থাৎ কথা সুরক্ষার মাশুল গুনতেই হয়। ওই যাতে আলকাতরা জড়ানো সরল ও সুদূর প্রসারী কথারা গতিপথে কোন বাধা না পায়।

এত সতর্কতা ও এত দেখভালের পরেও মাঝেমধ্যে শব্দের খেই হারিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায়, ব্যহত হয়! কিছুতেই কথায় কথা আর এগোতে চায় না। কেমন জট পাকিয়ে যায়।

সরল গতিপথের মাঝে এইভাবে হঠাৎ থমকে যাওয়া শব্দের যেন পুরনো অভ্যেস, যেন হঠাৎ করে চেনা পথের হাতছানি থেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, মূক-বধির এক স্থবিরতায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলা! আর তখনই আসে ব্যাধি, অবসাদ, অশিক্ষার অন্ধকার, ক্রমশ গ্রাস করে ফেলা অধঃপতন।

অথচ শেষ বলে তো কিছু হয় না! এই পথ শুধু তো শব্দ স্ফুরণের নয় - এ পথ আলোর, শিক্ষার, জ্ঞানের পথ। 
এ পথে চলার তো নেই কোন সীমা, নেই কাঁটাতার, নেই পরিধি। এই পথের শুরু সেই মাতৃজঠর থেকে। 
ধীরে ধীরে আলোর উন্মোচন, সুশিক্ষা ও রুচিবোধের একটি-দুটি নুড়ি সংগ্রহ করতে করতে শুধু এগিয়ে যাওয়া... অনন্তের যাত্রাপথ।

"অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন। জীবন প্রসব করে চলাই জীবন, শুধু যোগ বিয়োগের খেলাই জীবন।" 




1 কমেন্টস্: