কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

রঞ্জনা ব্যানার্জী




ছেলেটা


শেষরাতের শেষ ট্রেন থেকে কেবল একজন যাত্রীই নেমেছিল। শেষ প্রহরের আধভাঙা চাঁদ আকাশের গায়ে ঝুলছে তখনওরাতের চেয়েও অন্ধকার এক খবরের বাহক আজ সেজনহীন প্ল্যাটফর্মে তার হাতের সিগারেটের আগুন কুয়াশার ফিনফিনে চাদরের তলায়, সলমাজরির মত চমকাচ্ছেএই মফস্বল শহরের শেষ মাথায় মালতিলতায় ছাওয়া বাড়িটিই তার গন্তব্য।

ছেলেটার মুখে লাগাতার ওর বাড়ির গল্প শুনে এই শহরের একটা নিখুঁত ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল ওর মগজেস্টেশনের বাইরে পা দিয়েইওর সব কেমন চেনা লাগছিল
বাড়ির নাম ‘শান্ত ভবন’ও টিপ্পনী কেটেছিল, ‘শান্তি ভবন শুনসি কিন্তু ভবন শান্ত - এই প্রত্থম শুইনলাম’ ছেলেটা রেগে গিয়েছিল। কেটে কেটে বলেছিল, ‘শান্ত আমার ছোটচাচা শহিদ মুক্তিযোদ্ধা’আর তখনই অস্বস্তিকর সেই ব্যথা পাক খেয়ে উঠেছিল শিরদাঁড়া বেয়ে। ওর কোমরের হাড়ে অনন্য সেই যুদ্ধের চিহ্ন খোদাই হয়ে আছে
এক শুক্রবারে ছেলেটাকে শুনিয়েছিল সেইসব যুদ্ধদিনের দুর্বার কথাছেলেটাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলকিন্তু এরপরেই, মোবাইলে ছবি তুলেছিল ফটাফট। সেইসঙ্গে ফেইসবুকে তড়িঘড়ি আপ্লোড ক্যাপশন, ‘অজর মুক্তিযোদ্ধা’ বিরক্ত হয়েছিলমুক্তিযুদ্ধ এদের কাছে মামুলি স্ট্যাটাস!

গত বছরের মাঝামাঝি নুরুমিয়ার মেসে বোর্ডার হয়ে এসেছিল ছেলেটাএর আগে নটরডেম কলেজের কাছেই কোথাও থাকতো। ইন্টারে গোল্ডেন ‘এ’, মেডিকেলে চান্স পাবেই ধরে নিয়েছিল, নিদেনপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি। খরচ কমাতেই এই পাড়ায় আসা। এ’বছর দম লাগিয়ে পড়ছে চান্স পেতেই হবে। 

এক বছরের জুনিয়র মেয়েটার সঙ্গে জুড়ে গেল এই সেদিন। একই আবৃত্তি দলের সদস্য সিদ্ধেশ্বরীর ছাত্রী পুরনো ঢাকার বাসিন্দা‘প্রীতি’নামের মতই ফুটফুটে দেখতে ছেলেটার মোবাইলে অসংখ্য ছবি। শাসনও করেছিল খানিক, ‘পাকনামি ছাইড়া পড়ায় মন দ্যাও ভাইগ্না’

২০ শে ফেব্রুয়ারি বিকেলে অল্পক্ষণের জন্যে এসেছিল ছেলেটাপাঞ্জাবিতে বেশ পরিপাটি দেখাচ্ছিল ওদের আবৃত্তি দলের অনুষ্ঠান আছে সন্ধ্যায়। কার্ড দিয়েছিল আগেই। দোকানের ছেলেটা ছুটিতেযাওয়া হয়নি।

রাতের খাওয়া সেরে সবে উঠেছে, ঠিক তখুনি ফোন। হাউমাউ করে কাঁদছে ছেলেটা, ‘মামা প্রীতিদের বিল্ডিং জ্বলে’ ‘কী!’ চারপাশে শোরগোল, সাইরেন... ছেলেটার গলা হারিয়ে গেল কিছুতেই আর যোগাযোগ হ’লো নাছুটে গিয়েছিল অকুস্থলে। সমস্ত ঢাকা শহর ভেঙে পড়েছে চকবাজারে। ছেলেটা ছিল না কোত্থাওমেসেও ফেরেনিকেন গিয়েছিল চকবাজারে? প্রীতিকে পৌঁছে দিতে?

ভোর হতেই ছুটেছিল মেডিকেলে। সারসার লাশ! পোড়া কয়লার স্তুপ যেন! ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া সনাক্তকরণ অসম্ভব মেসের রেজিস্টারে ওর বাড়ির ঠিকানা আছে, ফোন নম্বর নেই নুরু মিয়া রুম খুলে দিয়েছিল। থমকে তাকিয়েছিল দুজনই! দেয়ালে ঝুলছে ওর সেই ছবি; ‘অজর মুক্তিযোদ্ধা’। শ্রদ্ধাটা তবে মামুলি ছিল না!

মাঠ পেরিয়ে ঠিকঠাক বাড়িটার সামনে চলে এসেছেওছাইরঙা গেটের মাথায় থোকা থোকা মালতিফুলপিলারের গায়ে সাদা পাথরে লেখা, ‘শান্ত ভবন’

আজানের সুরে ভোর ভাঙছে গেটে হাত দিতে গিয়ে ও থমকায়বুকের ভেতর অস্থির রুমাল নাড়ে কেউ। সাদা পাথরে লেখা ‘শান্ত ভবন’ যেন একজোড়া চেনা চোখ হয়ে দেখছে ওকে। 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন