কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯

বিকাশ মুখোপাধ্যায়



ইতিহাসের জেরোনিমো




(৪)


জেরোনিমো অ্যাপাচে

ভারত-ভূমির খোঁজে ক্রিস্টোফার কলম্বাস জাহাজ বোঝাই কামান, বন্দুক ও গোলা-বারুদসহ সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেন ১৪৯২ সালের ১১ অক্টোবর। ভুলক্রমে তিনি পৌঁছে যান দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকার বাহামা দ্বীপসমূহের একটি দ্বীপে, যা মেক্সিকোর নিকটবর্তী। কলম্বাস এই দ্বীপটিকেই  ‘ভারত’ ভূখন্ড বলে মনে করেন। অবশ্য তাঁর এই আবিষ্কার দশহাজার বছর ধরে বিশ্বের মূল ভূখন্ড থেকে দূরে থাকা এই দ্বীপসমূহ দক্ষিণ আমেরিকার মূল স্রোতে যুক্ত হয়ে এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দেয়। মেক্সিকোকে তিনি ভারত ভেবে ভুল করেন। কলম্বাসের ভারত অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের সোনা রূপো হীরে জহরত ও অন্যান্য সম্পদ লুট করে স্পেনে নিয়ে যাওয়া। পরে তাঁর ভুল ভাঙ্গে। ভারতবর্ষে না পৌঁছোতে পারায় অবশ্য কলম্বাসের মনে কোনো  অনুতাপ হয়নি, কারণ তিনি যে ভূখন্ডটিকে ভারত মনে করেছিলেন, সেই সভ্য ভূখন্ডের বিভিন্ন স্থাপত্যের গর্ভগৃহে মজুদ ছিল প্রচুর মণি-মাণিক্য।

কলম্বাস মনে করতেন এখানে এক অসভ্য বর্বর জাতি বাস করে। তিনি জানতেন না এই মাটিতেই মায়া, এজটেক, অলম্যাখ ইত্যাদি সহস্রাব্দ প্রাচীন বহু সভ্যতার পীঠস্থান এবং যা ইউরোপীয় সভ্যতার চাইতেও প্রাচীন। এখানকার মূল আদিবাসী সমুদায় শিকার ও নিজেদের রক্ষার্থে পাথরের তৈরি অস্ত্র ও তীর ধনুকের ব্যবহার করতেন। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র, কামান-বন্দুক সজ্জিত ঘোড়সওয়ার লুটেরাদের সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাই তাঁরা স্পেনীয় ডাকাতদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেননি। স্বাভাবিক ভাবেই গোটা দ্বীপটাই স্পেনীয় দস্যুদের কবলে চলে আসে এবং সেখানকার অধিবাসীরা হয়ে যায় কার্যত স্পেনের গোলাম। স্পেনের তৎকালীন রাজা পঞ্চম চার্লস কলম্বাসের কাছে এই আবিষ্কারের খবর পান। এই ধন-সম্পদের খোঁজ রাজাকে লোভী করে তোলে এবং তাই তা হস্তগত করার উদ্দেশ্যে কাল-বিলম্ব না করে তিনি কন  কডস্তাদর কোরটেস (Kon Kodstadar Kortes) নামের এক দুঃসাহসিক অপরাধীর নেতৃত্বে মেক্সিকো লুটের জন্য গোলা-বারুদসহ সৈন্যদল পাঠান। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয়, রাজা চার্লস পঞ্চম একসময় এই কোরটেসকে  নির্বাসিত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাজা-মহারাজারা নিজেদের আরও বেশি সম্পদশালী করার স্বপ্নে মশগুল হয়ে ওঠেন, অবশ্য সে সময়ে স্পেনই ছিল এ ব্যাপারে সবচাইতে সুবিধাজনক অবস্থায়, কারণ জলদস্যু হিসেবে স্পেনীয়রাই ছিল সবচাইতে বেশি পারদর্শী। স্পেনীয় দস্যুদের নজর ছিল দ্বীপসমূহের সম্পত্তির ওপর, তাই অসহায় রেড-ইন্ডিয়ানসদের তারা বারুদ-বন্দুকের দাপটে ভিটেছাড়া করে লুন্ঠনের মহাযজ্ঞ শুরু করে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে জাহাজ বোঝাই লুটের মাল ইউরোপে চালান করা শুরু হয়। মেক্সিকোর পর এই জলদস্যুদের নজর পড়ে পেরুর সম্পত্তির ওপর। পেরুর প্রাচীন ইনকা সভ্যতা ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ এক মহা-সভ্যতা। এভাবেই ব্রাজিল ও কয়েকটি দেশ ব্যতিরেকে লাতিন আমেরিকার প্রায় ৩৬ হাজার বর্গমাইল এলাকায় স্পেনের আধিপত্য কায়েম হয়।

লুটের ধন-সম্পত্তি দিয়ে কোরটেস যদিও স্পেনের রাজকোষ ভরিয়ে তুলেছিল, কিন্তু রাজা পঞ্চম তাকে বিশ্বাস করতেন না। কোরটেস ফিরে এলেও আড়াইশ বছরের মধ্যে প্রায় তিন লাখেরও বেশি স্পেনীয়ার্ড নিজেদের ভাগ্য অন্বেষণের আশায় মেক্সিকোতে পা রাখে। প্রথমে রাজকর্মচারী হিসেবে ভাইসরয়, ন্যায়াধীশ (জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট) ও ধর্ম্প্রচারকের দল মেক্সিকোতে আসে। এরপর রাজার অনুমতিপত্র নিয়ে হাজার হাজার ব্যক্তি মেক্সিকোতে ভীড় জমায়। স্পেনীয়ান পরিচয় সেখানে থাকলেও তারা জানত না যে বাকি জীবনটা তাদের মেক্সিকোতেই অতিবাহিত করতে হবে। রাজার অনুমতিপত্র নিয়ে যারা মাক্সিকো পৌঁছায় তাদের জন্য ছিল বিশেষ সুবিধা, যেমন নামমাত্র দামে মর্জিমাফিক জমি পাওয়ার অধিকার, রেড-ইন্ডিয়ানস আদিবাসীদের দাসে পরিণত করে তাদের শোষণ করার অধিকার প্রমুখসহ যে কোনো ধরনের আইনের উর্ধে থাকার অধিকার ভোগ করত বহিরাগতরা।

ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই বোঝা যায় যে, সে সময় মাত্র ২৫০  পেসোতে (মেক্সিকোর টাকা) তারা ৯০,০০০ হেক্টর জমি  কিনতে পারতো, যদিও এই নামমাত্র দামে একটি ঘোড়াও কেনা যেত না। স্পেনের প্রায় সমস্ত লুম্পেনরাই মেক্সিকোতে ভীড় জমায় এবং কম  দামে জমি কিনে চাষ-আবাদ শুরু করে। পার্বত্য অঞ্চলে যারা জমি কিনেছিল তারা প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিল ধনী। কারণ এই পাহাড় খনন করেই তাদের সম্পত্তি বাড়তে থাকে। মেক্সিকান ও বহিরাগতদের সম্পর্কের ফলে যে নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি হয় তাদের শরীরে স্পেনীয় রক্ত বইলেও মেক্সিকোই ছিল তাদের জন্মভূমি। এই প্রজন্মের নামকরণ করা হয়  ‘ক্রিয়োলোস’, যদিও তারা ‘পেনিনসুলার’ বলেই মনে করত নিজেদের। এমন ব্যক্তিরা সাধারণত সরকারী চাকরি, ছোটখাটো ব্যবসা, শিক্ষকতা, ধর্মপ্রচারকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। এই ব্যক্তিবৃন্দও কর বা বিচারব্যবস্থা থেকে মুক্ত ছিল। স্পেনীয়ার্ড ও স্থানীয় রেড-ইন্ডিয়ানস বা আফ্রিকান রমণীদের সংমিশ্রণে যে প্রজন্মের সৃষ্টি হয়, তাদের ‘মেস্তিজোস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই মেস্তিজোস গোষ্ঠীর স্তর সমাজের সর্বনিম্ন গোষ্ঠীর থেকে একধাপ উঁচুতে। আর সবচেয়ে নিচুস্তরে স্থানীয় রেড-ইন্ডিয়ানস সম্প্রদায়। সমাজে তাদের অবস্থা ছিল বড়ই কষ্টের। আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক শোষণের পাশাপাশি এইসব মানুষগুলোকে ক্রীতদাস হিসেবে জন্তু-জানোয়ারের মতো খাটানো হতো। কার্যত বেঁচে থাকার তাগিদেই তারা এই অত্যাচার সহ্য করত। স্পেনীয়দের অত্যাচারে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি এমনকি নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত ত্যাগ করতে হতো। মাত্রা ছাড়া অত্যাচার সহ্য করতে অপারগ ব্যক্তিরা অনেক সময় গভীর জঙ্গলে পালিয়ে  যেত। মেক্সিকো সমাজের এই হিংস্র তথা মানবতাবিরোধী প্রেক্ষাপটে ‘অ্যাপাচে’ উপজাতি সম্প্রদায়ের ঘরে ১৮২৯ সালে জন্ম নিলেন এক শিশু। শিশুটির মা-বাবা তাঁর নাম রাখলেন ‘গোয়াথালে’। পরবর্তীকালে স্প্যানিশদের দৌলতে তিনি  ‘জেরোনিমো অ্যাপাচে’ নামে পরিচিত হন।

 (ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন