পদাবলি - ৩
(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায়
আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে
পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।
পদা— পদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন
না। গরীব নয়,
কিন্তু গরীব সেজে থাকে।
বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে
বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে
কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।
মাদাম তুভোঁ— আদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা
চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ
বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায়
এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)
বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ
হয়ে এল। এদিকে ঘোর বর্ষা নেমেছে। সেদিন সকাল থেকেই টিপির টিপির, টিপির
টিপির... এদিকে ঘুম চোখ খুলেই এমন একটা ছবি দেখে ফেলেছি যে, পুরো
ব্যোমকে আছি। এদিকে সারাদিন টিপির টিপির, টিপির, টিপির...
এদিকে পুরো ব্যোমকে থাকা... এদিকে সেই একই টিপির টিপির, টিপির টিপির... ওদিকে
ব্যোমকে... যাক বাবা! এতক্ষণে ঝেড়ে নামল আকাশ ভেঙে। আমিও ব্যোম ভোলে বলে হেঁকে
উঠলাম। ওই ছবিটার বৃত্তান্ত ক্লিয়ার করি এবার। এক জেলের হাতে পাক্কা তিন কেজি
সাইজের ইলিশ, আর তাকে ঘিরে ফোটো খিঁচলেওলাদের ভিড়। হ্যাঁ গো, এই
আমাদেরই উলুবেড়ের গঙ্গা থেকে উঠেছে। কদিন আগে আরও
দুখানিও নাকি উঠেছে। তা বেশ হয়েছে। দাম-টাম তো হবেই তেনাদের। সমস্যা সেটা না! মানে
ওই ছবি তোলা মাছ এখন কার ঘরে রান্না হয়ে পেটে গেছে, পেটে যাওয়ার আগে তার
অনেক রকমারি আছে অবশ্য। এই যেমন কাটতে গিয়ে কতখানি রক্ত বেরল টাটকা টাটকা... কেমন
বাস বেরল, হাত কবার ধুলে মাছের গন্ধ গেল... তারপর ভাজতে গেলে কেমন খুশবু
ছড়ালো, তারপর যেটা মোক্ষম, ওই তেলটা কার নাকি কার কার পেটে গেল... বাকিটা কী
কী ভাবে রান্না করা হল... ঘটিদের ঘরে গেলে সে মাছের জাত যাবে নির্ঘাত! তবুও যদি যায়...
ইত্যাদি হাজারে হাজারে ভাবনায় সত্যি বলছি মাথাটা ব্যোমকেই ছিল সারাদিন। ভাগ্যিস এই
বৃষ্টিটা এল... জলের মাছ আবার জলেই গেল গিয়ে। যার যেভাবে খুশি খাক না, আমার কী! যত্তসব!
এইরকম ভাবনার মাঝেই পদা এলো।
কিন্তু পদা যেন সে
পদা নয়। ধীরে বিষণ্ণ বদনে এল আজ। বলল, ‘সেই তো মরেই যাব। না হয় ফাইনালের দিনই যাই!’ আমি হাঁ হাঁ করে
উঠলাম। এ আবার কী অলুক্ষণে কথা! পদা মিনমিন করে জানাল, ‘দেখ এক দলই তো
জেতে। সেকেন্ড, থার্ড
হওয়ায় কোন কৌলীন্য নেই। কী খেলায়, কী লেখায়, ফার্স্ট হওয়াটাই
আসল। এতদিন জিতে এসে ক্রোয়েশিয়া হেরে গেলে, কেউ তাকে মনে
রাখবে না। তেমনি ওই ফরাসীগুলো যদি এতদিন বাদে আবার জেতে, ওদের নিয়েই
ধেইধেই করবে সবাই। আমি চিরকাল হেরো পার্টি। তুইও তো তাড়াস আমায় সবসময়ে’। ওর অভিমান দেখে মায়া হল। বললাম, ‘ছাড় তো! তবে যাই
বল, আর তাই বল- ক্যামেরাম্যান কিন্তু টোটালি কনফিউজড ছিল। সুন্দরী
ক্রোয়েশিয়ান প্রেসিডেন্ট কেমন করে হাসলেন, কেমন করে ফরাসী
বাদশাকে হাগ করলেন, আরে একবার আবার তেনার হাত টেনে নিল না? মিস
করলাম। এরপর মড্রিচকে মুন্ডু নেড়ে আদর দিলেন, হায় হায়.. ফলস
আইল্যাশ লাগানো চোখে এই বুঝি জল এল... জুম কর, জুম কর! আসছে, এসেছে? এই
যাহ, পোডিয়ামে আবার এখুনি কে যেন মেডেল পরতে চলে এল... ঘোরা ঘোরা, ক্যামেরা
ঘোরা... সুন্দরী কী করছে এখন কে জানে!’ পদার বিষণ্ণতা তবুও কাটলো না। বলল, ‘না হয়
চলেই যাই। তোর না হয় ডানা শারদ পত্রিকা আছে। আমার কী আছে বল?' 'ডানা
শারদ পত্রিকা আবার কী? কী করে লেখা পাঠায়, মানে কোন আইডিতে? কারা
লেখে? নামী দামীরা তো? সেই বুঝে পাঠাব’।
ও বলল, 'দেখ সত্যি সত্যিই কিন্তু আজ আমার শেষদিন। পদা
ফিনিশ! ডানা গজাবে যেদিন তোর, সেদিনই ওই পত্রিকায় অটোমেটিক লেখা পৌঁছে যাবে। সো, ওয়েট!
আমি যাই।' এই বলে পদা চিরতরে ভ্যানিশ হইল।
কেহই উহার জন্য
একফোঁটা চক্ষের জলও ফেলিল না। আমিও না! মাদাম তুঁভোর নিকট ওই রূপ ধারাবর্ষণের আশাও
করি না। তদ্যপি তাঁহার আগমণের প্রতীক্ষায় রহিলাম। অন্য দিনে তাঁহাকে স্মরণ করিবার
উপক্রম হইবার অগ্রেই তাঁহার লাঠির শব্দ নিকটে চলিয়া আসে। আজ সেরূপ কোন ‘সিন’ নাই।
সিনিক বিউটির দিকে তাকাইতে মন চাহিল আজ। পদা চলিয়া গিয়াছে। ইহা বড়ই চিত্তসুখকর
ঘটনা হইতেই পারিত আমার নিকট। কিন্তু হইতে হইতেও মোর চিত্ত বেজার হইয়া গিয়াছে।
মাদাম তুঁভোও কেন আজ অনুপস্থিত? আমি এই প্রকার একেলা, তায় বিশ্বকাপ শেষ, কী লইয়া
বাঁচিব? পদা গেছে, যাক। মাদামের ইহা কি উচিত কর্ম হইল? এইপ্রকার ভাবনার মধিখানে
আমি আরও এক প্রস্থ অশ্রু বর্ষণের প্রয়াস করিতে উদ্যত হইতে যাইতেছিলাম। আকাশও বুঝি
আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়া তাঁহার বারি উগরাইতে চাহিতেছিল। এই সময়েই কাকের ন্যায়
ভিজিয়া মাদাম তুঁভোর আগমন হইল। তাঁহার ভেজা লাঠিরও সাউন্ড সিস্টেম খারাব হইয়াছে।
নিজেরটি তো প্রায় বন্ধ। আমি বিগলিত চিত্তে তাঁহার জন্য কফি বানাইতে চলিলাম। কফি
পান করিয়া হৃষ্ট চিত্তে মাদাম আমার কানটি টানিয়া তাঁহার মুখের সম্মুখে আনিলেন।
তাহার পরে যাহা বলিলেন—শোন বাছা, কেউ কখনও একেবারে চলে যায় না, মৃত্যু না হলে
অন্তত। যদি চলে যাচ্ছি বলে যায়, তাহলে জানবে নিজের দর বাড়ানোর জন্যই এই চলে যাওয়া।
এই বৃষ্টিও চলে যাবে। তখন তো তুমিই বাছা হা বৃষ্টি করে কাঁদবে। ফলে অত সন্তোষের
কিছু হয়নি। ডানা গজানোর আগে পিঁপড়ের অবস্থানের কথা মনে কর। শ্রমই তোমার একমাত্র
অর্জন হতে পারে। আর পদারও। এই বলিয়া তিনিও ভ্যানিশ হইলেন।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন