দড়ি
ঘরে একটা দড়ি ছিল। দুদিকের দেওয়ালে পেরেক দিয়ে বাঁধা। বেশি ওজন সহ্য
করতে পারে না। গামছা জামা ছোটজামা এক জোড়া মোজা ... ব্যস্ এর বেশি হলেই মাধ্যাকর্ষণ
জিতে যাবে।
ক্ষুদিরামের দড়িটায় মাধ্যাকর্ষণ জিততে পারেনি। ওটা
ক্ষুদিরামের শরীর শুদ্ধ ওপর থেকে ঝুলেছিল।
তিন গজ মাপের সুতো নানান প্রসেসিং-এর পর্ব পার হয়ে একফালি
লাছি তৈরি হয়। এই রকম চারলাছি জুড়ে নিলে এক একটা দড়ি। দড়ির মাপ
নির্ভর করে সুতোর রেডিয়াসের ওপর। রেডিয়াস কম হলে সুতোর প্রস্থও কম হবে। কম প্রস্থের
সুতো দিয়ে খুব লম্বা দৈর্ঘ্যের দড়ি তৈরি করা যায় না। মাঝখান থেকে ছিঁড়ে যাওয়ার
চান্স।
এই দড়িটার দৈর্ঘ্য ঠিক কত, জানা নেই। রোজ নিয়ম মতো সকাল
বিকেল দেওয়াল থেকে যখন তখন খুলে যায় বলে ঘরের অন্য দেওয়ালে আজ আরও একটা বড় দড়ি
টাঙিয়ে দিয়েছি। দুই
দেওয়ালে দুটো দড়ি। এরপর ঘরের
রূপরেখা / সৌন্দর্য/ ফিজিক/ চেহারা এমন হলো যে তোকে লিখলাম – জানিস আজ অনেকদিন পর আমার তোর জন্য মন খারাপ হচ্ছে না ।
মন খারাপ জিনিষটা ঐ দড়ির মতো। বেশি চাপ সহ্য
করতে পারে না। সেজন্য
আজকাল ওষুধের মাত্রা বেড়ে গেছে। সকাল সকাল ঘুম ভাঙে না। দুপুরের
রোদ্দুরে রিলায়েন্সের টাওয়ারে বসে থাকা পায়রাদের দিকে চেয়ে থাকি।
লড়াইটা লড়তে হবে, যে করেই হোক!
ঘরের দড়িটা আজ খালি। এই দড়িটা খুব বেশিক্ষণ আমার বডির ওজন
ধরে রাখতে পারবে না। সুতরাং
এটা নিয়ে অন্য কিছু ভাবাই ঠিক।
পাড়ায় শখের থিয়েটার হবে। সে জন্য স্টেজ বাঁধা হচ্ছে। এই কাজে যিনি ব্যস্ত,
তাঁকে সাহায্য করতে পেরে লেখক ধন্য। সারাদিন তাই
নাওয়া নেই, খাওয়া নেই ... ‘ইতিপূর্বে যাত্রা অনেকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু থিয়েটারের
মতো জিনিষ পাড়াগাঁয়ে এই প্রথম’। যিনি রাম সাজবেন, স্টেজ বাঁধার সময় শ্রীকান্ত
তাঁকে শুধু এই আশাতেই সাহায্য করছিল, যদি ওবেলা অ্যাক্টোর সময় শ্রীকান্তর ওপর শ্রীরামের কৃপা বর্ষিত হয়। যখন অন্যান্য ছেলেপুলেরা
ছেঁড়া কানাতের ফাঁক ফোকর দিয়ে অনবরত গ্রীনরুমে উঁকিঝুকি মারবে, লেখকের সেখানে তখন
অবারিত দ্বার। ‘কিন্তু
সন্ধ্যাকালে জড়ির সাজ পোষাক পরিহিত রামচন্দ্র অনেকবার পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করিলেন,
অথচ ...
অকৃতজ্ঞ শ্রীরামচন্দ্রের দড়ির প্রয়োজন কি একেবারেই ফুরাইয়াছে?’
এ ছিল লেখকের আক্ষেপ। এখন সে রামও নেই। দড়িও বা কোথায়?
দুষ্টুমির জন্য যশোদা মা গোপালকে হামেশাই দড়ি দিয়ে বেঁধে
রাখতেন। বেড়া
বাঁধবার সময় মা জগদম্বা কমলাকান্তকে ওপাশ থেকে দড়ি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর
মেয়ের রূপ ধরে এসেছিলেন।
দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান। হীরক রাজার দেশে। পরিচালক –
সত্যজিত রায়।
অতি চালাকের গলায় দড়ি। গরু ছাগল বাঁধার দড়ি। নারকেল দড়ি,
সুতলি দড়ি। মা
কাকিমার ঘরে পরার পুরনো শাড়ির পার ছিঁড়েও দড়ির মতো ব্যবহার করা হয়। হয়, এখনও। গেল
গরমে মিয়ামি থেকে সপরিবারে সুজিত এল। গোটা দিন বেকড চিকেন উইথ বেবি কর্ন, পেঁয়াজ পোস্ত, শুশুনিয়া,
স্বদেশ পর্যায় হ্যানা ত্যানায় কাটিয়ে রাত দুপুরে শুতে যাবার সময় অনিবার্য কারণ বশত
যখন মশারি টাঙানো হচ্ছে, দেখা গেল দেওয়াল আছে, পেরেক আছে, বিছানায় মশারির চারপাশ
গুঁজে দেবার লোকও রেডী, কিন্তু ...
পুরনো শাড়ির পাড় ছিঁড়ে দড়ি বানাল মামন, সুজিতের বউ। মশারির
নিচে বাবি, পুতুল, পিন্টু, মেজ ননদ , নাড়ুর ছোটছেলে। ফুল স্পীডে ফ্যান আর চরম এসি সত্ত্বেও রিহানার তখনো গরমে গা
চুলকুচ্ছে। দরজা ফাঁক
করে সুজিত একবার মুখ বাড়াতেই, ‘ড্যাডা লুকস দ্যাট ডোরি ... হাউ ফানি!’
চার বছরের রিহানার এই প্রথম এমন অভিজ্ঞতা। ঘড়িতে রাত প্রায়
একটা এবং সঙ্গে সমবেত হিহি হাসি ... আবারও ভেজানো দরজায় কাকিমার ঘুমন্ত মুখ ও করুণ
আর্তনাদ ... ওগো মাগো! আমার আকো কাপড়টা কে এমন ছিঁড়ে মশারি টানালে?
আকো কাপড়, শব্দটা সেই প্রথম শুনি।
নৌকর গুন, সেটাও দড়ি। জাহাজ ঘাটায় এখন দড়ির স্তুপ চোখে পড়ে।
সব শুনে বললি, দীর্ঘ
বিরহে কোথাও থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরতে ইচ্ছে হচ্ছে। অফিসটা সতের তলা নয়,
নেহাতই একতলা, আর একটাই মাত্র জানালা যেটা নাকি দড়ি দিয়ে গ্রীলের সঙ্গে
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। নইলে
...
আমার ঘরের দড়িটার এত কৌ্লীন্য
নেই। আয় আমরা দড়ি ইন্টারচেঞ্জ করি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন