সরগম
শুরুতে হয়তো এমনি এমনিই তাকিয়ে ছিলাম, যেমন আকাশ দেখি অথচ দেখি না, মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি অথবা তোমার দিকে
বা তার দিকে-- একটানা কোনো কারণ ছাড়াই। আমি যে তাকিয়ে আছি এটাই আমি বুঝি না। হঠাৎ কোনো শব্দ বা আলো বা রঙ
আমার বোধ ফিরিয়ে আনে এবং আমি এর আগের মুহূর্তের কিছুই মনে করতে পারি না। সেদিনও
এমন হয়েছিল হয়তো! শ্যন-এর ঝাঁকুনিতে যখন নিজের কাছে ফিরছি তখনই দেখতে পেলাম অক্ষরগুলো। ঠিক অক্ষর নয়, নোটেশন। বালির উপর তীরে ফিরে
যাওয়া ঢেউয়ের নোটেশন। ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম, আসলেই
দেখছি না ভাবছি? আমার রোগটা কি জমে বসছে? শ্যন-এর দিকে তাকাই আমি; শ্যন কি দেখতে পাচ্ছে?
- আর ইউয়ু ওকে?
আমি মাথা নেড়ে বোঝাই ঠিক আছি। সা রে মা পা ধা র্সা আমি
পড়ি আবার। এটা কোন রাগ? বাবা জানত। বুকের ভেতর ঢেউ আছড়ায়। হুড়মুড় করে ছেলেবেলা
মগজে বাড়ি খায়। আমি হু হু করে কাঁদতে থাকি। সতের বছরের সোমত্ত মেয়ে বুক ভেঙ্গে
কাঁদছে সাগরবেলায়, মাঝ বয়েসি শ্যন খেই
হারায়।
- ইটস ওকে প্রমা।
আমি বলি, ‘ইটস নট ওকে’, মুখে নয় মাথায়। হঠাৎ করে দু’চোখ ভরে ঘুম আসে আমার।
– রাগ দুর্গা।
কে বলল? আমি বালির লেখায় চোখ মেলি আবার। স্পষ্ট দেখতে পাই অবরোহণঃ র্সা ধা মা পা রে সা। সরগম! জলের সরগম! পুরো
একটা বন্দিশ। আমি পাগলের মতো হাত বোলাই জলের ছাপের ওপর। আমার খুশি উপচে পড়ে। রাগ
দুর্গা! আমি মনে মনে বলি। তানপুরায় বাবা। আমি
কচি গলায় বাবার সাথে মেলাচ্ছি , ‘সখি মেরি রুমা ঝুমা--। কত দিন আগে? কত দিন? শ্যন আমার পাশে উবু হয়ে বসে আমাকে বোঝার
চেষ্টা করে।
শ্যন আমার সৎ বাবা। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার আর ওর জন্মান্তরের
সম্পর্ক।
আট বছর আগে এই দিনে বাবা, মাকে ছেড়ে চলে
গিয়েছিলেন। ইহজগৎ থেকে নয়, আমার স্প্যানিশ বেবি সিটারের সাথে; মা’কে আগাম কিছু জানতে না দিয়ে। আজ মা’র একলা থাকার দিন। শ্যন সকালে ব্রেক
ফাস্ট টেবিলে যখন বলে,
- আমি আর প্রমা আজ বীচে যাব।
আমি তখন চোরা চোখে ফ্রিজের ওপর ম্যাগনেটিক
ক্যালেন্ডারটা দেখি। শ্যন-এর সব মনে থাকে।
- এটা বাবা-মেয়ের দিন। তুমি বাদ হানি!
মা পেপার থেকে চোখ তোলে না। উত্তরও দেয়
না। মাকে কখনও কাঁদতে দেখিনি আমি, এমনকি চোখ ঝাপসা হতেও দেখিনি কখনও।
শ্যনকে আমি কিছুই ডাকি না; না বাবা, না শ্যন। তবে ভালোবাসি অতল।
আমি আবার আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করি প্রতিটা
ঢেউয়ের ছাপ। আমি পড়তে পারছি জলের স্বরলিপি বাংলায়। বাবা আমাকে বাংলা পড়তে শিখিয়েছিলেন। আমি গোটা গোটা অক্ষরে
লেখা শিশুপাঠ শেষ করেছি অসংখ্যবার, মনে মনে। আমার শব্দ থমকে থাকে মগজে, জিভের
ডগায়। মুখ দিয়ে একটা কি দুটো ফস্কে যদিও বা বেরোয় কখনও সখনও, আগে পিছে অনেক কিছুই
আমার মাথাতেই রয়ে যায়। তাই বাইরের লোক এর মানে বোঝে না; মা কিম্বা শ্যনও না। অথচ মগজে ওরা কেমন
প্রজাপতির পাখায় ঝুরো ঝুরো রেণু হয়ে আলতো পায়ে উড়ে বেড়ায়!
একসময় আমাদের কী সুন্দর বিকেল ছিল। দধিমুখো বেড়াল ছিল। বিকেলে ছাদের আলসেই চুল ছড়িয়ে মা পিসিদের আড্ডা ছিল। ছুটির দিনে গান ছিল। লাল ঝোলের
পাঁঠার মাংস ছিল। উঠোন ভরতি কমলা বোঁটা শিউলি ফুল ছিল। কেন আমায় অসুখ দিল কৃষ্ণঠাকুর?
বাবা মা’র বিকেলগুলো ফিকে হতে হতে হঠাৎ
একদিন ঝলমলে হলো। পি এইচ ডি ফুলব্রাইট স্কলার। আমার বাবা। ঠাকুরমা’র কৃষ্ণঠাকুর ওই বুঝি মুখ তুললেন! বাবার পি এইচ ডি হলো ঠিকঠাক। আমার চিকিৎসা বিশেষ এগোলও না। মা’ও পড়া শুরু করলেন। কী ব্যস্ত জীবন! আমার সেশনগুলো মাঝে
মাঝে বাদ যেতে থাকল। বাড়িটা কেমন যেন ঘুমন্তপুরী; চুপচাপ চামচ বাটি,
কলের জল। মাঝে মাঝে ফোন কল। ল্যাপটপে আঙ্গুলের খেলা। তারপর একদিন মারিয়া হোসে। আমার হিস্প্যানিক
বেবি সিটার। ঝলমলে মারিয়া;
হাঁটার সময় বুক লাফায়। বাবা লাঞ্চ টাইমে চলে আসেন। আমি মারিয়াকে ভালোবাসতে থাকি, বাবাকে
ঘরে ফেরানোর জন্যে। কিন্তু বাবা আমায় ‘এরি আলি’ শোনায় না আর। হুঁকোমুখো হ্যাংলাও আবৃত্তি করে না। আমার বেবি
সিটার আর আমি ‘ম্যাটিল্ডা’ দেখি। বাবা এসে বসে পাশে। মারিয়া বলে আমিও পারি ইচ্ছে হলে ম্যাটিল্ডা হতে। আমি ম্যাটিল্ডা হই। তাকিয়ে থাকি ঘণ্টার পর
ঘন্টা আমার খেলনা প্লেনটার দিকে। প্লেনের ডানা ঘোরে না। আমি নিমেষে পৌঁছতে
পারি না চাটগাঁ’র বাড়ির উঠোনে, যেখানে
লাউলতা আর ক্যাকটাস পাশাপাশি ফিসফাস করে। বরং আমি এক দুপুরে ম্যাটিল্ডা হতে হতে
আবিষ্কার করি আমার পাশে কেউ নেই। বাবা আর মারিয়া সোফা কাম বেডে সাপ হয়ে গেছে। আমার মুখ দিয়ে ফেনা
গড়ায়। আমি বোকা টিয়ের মতো ‘ম্যাটিল্ডা’ নাম
জপি।
তারপর দিন গড়ায়। রাত নীল থেকে গাঢ়
নীল। নতুন ডাক্তার। অসুখের টার্ম পাল্টায়। একদিন সাবওয়েতে মিলে যায় শ্যন। মা সেদিন বিব্রত আমাকে নিয়ে। মগজের ভিড়ে অনেক শব্দের ঠেলাঠেলিতে
আমি অস্থির। মা বোঝে না, কেউ বোঝে না। শ্যন পাশে এসে বসে। ওর বাঁ হাতের উল্কির নীল মারমেইড
জ্যন্ত হয়। আমি ভাসতে থাকি। একদিন শ্যন আমার আমার সৎ বাবা হয়ে
যায়। আমি চাঁদ হাতে পাই যেন। শ্যন ছবি আঁকে কবিতা লেখে। আমার মতো একটা অন্য জগত ওরও আছে। ও আমাকে সময় দেয়। আমার প্রজাপতি শব্দগুলো ওর কবিতায় প্রাণ পায়। আমার অস্থির সময়ে ও পাশে বসে। আশ্বাস দেয় একদিন সব ঠিক হবে। আমি হাতের কাছে
যা পাই ছুঁড়ে ফেলি। ও রাগে না। ওর ছবি বিক্রির টাকায় মাকে নয়, আমার জন্যে পিয়ানো কিনে আনে। মা খুশি হয়ে আমার সামনেই ওকে
চুমো খায়। কিন্তু আমি পিয়ানোতে
আঙ্গুল ছোঁয়াই না। শ্যন আশা ছাড়ে না।
আমি আবার হাত বোলাই বালিতে। কী আনন্দ! বালিতে চেপে
লিখি ‘পেন্সিল’। শ্যন মুহূর্তেই হাওয়া। গাড়ি থেকে কলম আর টিস্যু
নিয়ে আসে।
- দেয়ার ওয়াস নো পেপার।
আমি লিখতে থাকি সা রে মা পা ধা সা। শ্যন কিছুই বোঝে না।
আমি শুনি সেলফোনে ওর জলজ চাপা
উচ্ছ্বাস।
- হানি, শী ইজ রাইটিং ইন
বাংলা।
আমি গুন গুন করি ‘সখি মেরি রুমা ঝুমা...’
জল গড়ায় আমারও।
চমতকার লাগল। মন-কেমনিয়া ।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।