কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত





দার্শনিকতা

যে অবস্থানেই থাকুক যেখানেই যাক হেরম্বকে ঘিরে রাখে, তাড়া করে ফেরে অনিবার্য কিছু গান। কালখন্ডের মতো। অদ্ভুত সুরেলা। সে হাতি মাহুতের গান মইষাল বন্ধুর গান মাঝি মাল্লার সারিগান গাড়োয়ানী গান বিবাহগান ধান কাটার গান ঢেকিপাড়ের গান বিষব্যথা নামানোর গান, যে কোনো গানই হতে পারে। গানের গায়নরীতি সুর আবহ হেরম্বকে চলাচলের উপযোগী রাস্তাঘাট খুঁজে নিতে বাধ্য করে; বাধ্যবাধকতার ভিতর সে একটা যাপিত জীবনের মহার্ঘ্যতা নিয়ে মহার্ঘ্য এক ভাবনাও ভাবতে শুরু করে। ভাবনা চিন্তার নিজস্ব গতিস্রোত বাধাপ্রাপ্ত না হলেও হেরম্ব কিন্তু আবশ্যিকতায় এক দর্শনবোধে আক্রান্ত হয়। এটা কি মহাশূন্যতার কোনো অনুভব! সে চলাচল থামিয়ে না দিয়েও চলাচলের মধ্যে আরো আরো চলাচল নিয়ে আসে। জীবন কি নদীপাড় থেকে উত্থিত নিঃশব্দ বাতাসের মতো যা গতিপ্রাপ্ত হতে গিয়ে কেন জানি সূত্রসংযোগ রীতিপদ্ধতি হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলবার ধারাবাহিক এক পদ্ধতির নিরপেক্ষ হতে চাইবার আশু প্রয়োজনীয়তাটুকু কেবল বুঝে নেবার প্রয়াস; এরপর দর্শন নিজের মতো করে দার্শনিকতা এনে দেয়, যার ভিতর গানগুলি নাচগুলি হাসিকান্নাগুলি  উংসব মুখরতায় আশ্চর্য লোকোলোকত্তরতার দার্শনিকতাই পুরোধা হয়ে পুরোভাগে এসে পড়ে। কবেকার কোনো এক হাটে সে হাতিকে নিয়ে রঙ্গরসের গান শুনেছিল, কোনো স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া চরাঞ্চলের কৃ্ষি বৌ-এর কণ্ঠনিঃসৃত ঢেকিপাড়ের গান আমূল এক বাধ্যবাধকতায় তাকে বিদ্ধ করেছিল, সেইসব তার স্মৃতিতে পুরোপুরি না  থাকলেও সে কিন্তু অনিবার্যভাবেই গান নাচের বৃত্তের মধ্যেই থাকবার দৃঢ়তা অর্জন করেই ফেলে




পাথারবাড়ি

হেরম্ব কি অতিক্রম করতে পারবে সব প্রান্তর ও প্রান্তিকতা? নাকি প্রতিহত করতে না পারার ব্যর্থতায় সে পুনর্বার প্রান্তরের জ্যোৎস্নায় ফিরে যাবে? জ্যোৎস্না বড়জোর তাকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করবে খেয়াঘাটের দিকে। একাকীত্ব অসহ্য মনে হলে সে সঙ্গী করতে পারে জলধোয়া বসুনিয়া খাটু পাইকার দুখীরাম মণ্ডলকে খেয়াঘাট শূন্যতার  বিশালাকারে বিন্দুবৎ জেগে থাকতে পারে জেনেও হেরম্ব ব্যর্থতাকে সমূহ প্রতিহত করে   খুঁজতে থাকে কবেকার সব ঘাটোয়ালকে। ঘাটোয়াল এখানে প্রাধান্য পেতে পারে না,  তবু প্রধানতম বিষয়রূপে রূপান্তরিত নদীর ঘাটে ঘাটে হেরম্ব কেবল ঘাটোয়ালদের  খুঁজতে থাকে। এটা অনস্বীকার্য তবু হেরম্ব এক ধরনের অসহায়তা অনুভব করে; তার অনুভূতির পরতে পরতে স্তরে স্তরে যেন সাজানো থাকে মেঘেরা, প্রান্তরের সবটুকুই সে বিয়োগব্যথার বিশ্লেষণযোগ্য অংশ মনে করতে থাকে। অংশ কখন যেন স্বীকৃতির দাবী জানানোর প্রাথমিক প্রয়াসটুকু শুরু করে নদীর বহমানতায় প্রবাহিত হতে হতে,  ঘাটোয়ালের আত্মকথনের পরিণতি না পাওয়া এক জন্মান্তরকথন হয়ে প্রান্তরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে যায় চিরসত্য হয়ে। তার কার্যকারণগত ভিত্তিভূমি হয়তো থাকে না, তবু   দ্বিধাগ্রস্থতার এক বাস্তবতায় কবেকার মাটিকাদা ঝড়বাদল মাখা প্রান্তরের মানুষজন প্রান্তিকতাকে স্থিরতা দেবার দায়বদ্ধতায় অশ্রুসজল এক এক পরিপার্শ্বহীনতার অসহায়তাটুকু বিবৃতির ঢঙে পরিবেশন করতে থাকে। এই বাস্তবতা হেরম্বকে স্বীকার করতে হবে, কেননা এইরকম অস্বীকার আর যাই হোক হেরম্বকে স্বাভাবিকত্ব দিতে পারে না।




ঢোলসানাই

সংকটকাল পেরিয়ে আসতে গিয়ে নতুনতর সংকটের পাকে আটকে যাওয়া। ঘটনার মধ্যবর্তীতায় মধ্যবর্তী হয়ে যাবার সাবলীলতায় সময়ই প্রকৃতপক্ষে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে, এই সম্ভাবনার সূত্রে যাবতীয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে পড়ে; সংকটকাল আর অতিক্রম করা হয় না। জীবন তো এমনই এক সংকট সংশয় ঘেরা আবর্ত। কচুর পাতের জল টলমল টলমল করেধান কাটার পরের যে শূন্য মাঠ ক্ষেত তার সাথে নদীপারের সন্ধ্যেরা রাত্রিকে সংকটকালের মধ্যে যদি নিয়ে যাওয়া যায়, তবে তো পরিত্রাণহীন এক  সংকটকালই পরিব্যপ্ত হয়ে উঠতে থাকবে। জীবনের সংশয় সংকট থেকেই তো তীব্র এক জীবনগাথা রচিত হতে পারে। রাত্রির অন্ধকার ছমছম জোনকির ঝাঁক লুকিয়ে  থাকা নদীনালা সব কিছুর মধ্যেই আবহমান এক জীবন লোকাচার গালগল্প ঢোলসানাই মানুষজন সবকিছু নিয়ে কেন্দ্র ও প্রান্তের বহুস্বরজাত এক বর্ণময় প্রান্তিকতাই যেন হয়ে ওঠে; হয়ে ওঠার প্রয়াসটুকুই অব্যাহত রাখে। যদিও প্রতিটি বাঁকে সংকটগুলি কালখন্ডের নির্ধারিত বর্ণময়তাটুকুও অগ্রাহ্য করতে থাকে, গ্রাহ্যতাকে বর্জন করবার দুঃসাধ্যটুকুও কেবলমাত্র মধ্যবর্তীতায় সংকটকালীনতার হাড়হিম অনুভূতির ভিতর তলিয়ে যায়, লিপ্ত হয়ে যায়। জীবনের ধরতাইগুলি তো আর নদী দিয়ে রচিত এক নিজস্ব নদীপথ নয় যে কেবল জায়মানতার বিস্তারে পরিব্যাপ্ত হতে হতে ছোট ছোট  মোচার খোলের দুলে ওঠা নৌকোগুলির মতো মাঝিমাল্লার পেশীবহুল প্রকৃতির শান্ততায় নাব্যতায় যেন নদীভরতি গানগুলি নিয়ে আদ্যন্ত ভেসে যাওয়া। ভেসে যাওয়ার সত্যতায় খাদহীনতা থাকলেও সংকটকাল আর পেরিয়ে আসা হয় নাগানভরা নদীগুলি তবু থেকেই যায়।









0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন