কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

বারীন ঘোষাল

নির্মিতি


                                     
ছেলেবেলা থেকেই আমরা জামশেদপুর শহরটাকে গড়ে উঠতে দেখেছি। স্বাধীনতার পরে কারখানা বাড়ছে, নতুন পথ, নতুন বাঁধ, নতুন করে পরিশ্রুত জলের আর বিদ্যুতের ব্যবস্থা – এসব ছাপিয়ে যেত নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরি হতে হতে শহরের ছড়িয়ে পড়ার মজা শিশুর চোখে, কিশোরের চোখে। সে কয়েকটা বাড়ি নয়, একবারে পাঁচশো কোয়ার্টার্স উঠছে পরের পর অঞ্চলে – এই মহাকান্ড একযোগে পাশাপাশি লাইন দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শুনেছি কারখানা বাড়ছে। টিস্কোতে নতুন ফার্নেস, কোক ওভেন, আরো কী কী যেন! নতুন কারখানাও বসছে আমাদের পাড়ায়। তখন আমরা যা   দেখেছি বুঝেছি তা থেকে দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, গ্রোথ ইজ লাইফ। চাই নির্মাণ।
  
যাক গে, কিশোরবেলায় ফিরে যাই। মিডল স্কুলের পথে এভাবে একটা গোটা কলোনি গড়ে উঠতে দেখলাম। শেষে যখন সব একরকম হয়ে গেল তখন আবার অন্য জায়গায় একই হট্টগোল, হাজার বাড়ির কান্ড। এভাবে সিদগোড়া এরিয়া, টেলকো এরিয়া, এক্স টাইপ, এক্স এন টাইপ এরিয়া ইত্যাদি। তখন কী আর ছাই জানতাম যে  ঐ সিদগোড়া এরিয়ায় একদিন কমলের সঙ্গে নাড়া বাঁধবো, ঐ এক্স এন টাইপে একদিন কৌরবের প্রথম আড্ডা বসবে কৌরবের প্রথম সম্পাদক সুভাষ ভট্টাচার্যের বাড়িতে, ঐ টেলকো এরিয়ায় একদিন আমার পি/১৪ ফ্ল্যাট বিখ্যাত হবে কবিতা ক্যাম্পাসের বন্ধুদের কবিতার পাগলামিতে!

জামশেদপুরের চারপাশে সবুজ গাছপালা, নদীনালা, পাহাড় টিলা – এই সব ছোটদের চোখে অপরিবর্তনশীল নিসর্গের চেয়ে হাতের কাছে নিত্য পরিবর্তনশীলতায় বেশি আগ্রহ পাই তখন। স্কুলে যাবার পথে আর স্কুল থেকে ফেরার পথে নির্মীয়মান এক্স টাইপ   এরিয়াতে ভিত, প্লিন্থ, আধো দেয়াল, পুরো দেয়াল, শাটারিং, ছাদ -- এই সব  রোজ একটু একটু করে বদলে যাবার মধ্য দিয়ে ছোটাছুটি, লুকোচুরি খেলা, ছুঁয়ে দেখা, এখানের ইট ওখানে রেখে দেবার দুষ্টুমি - এভাবে খেলতে খেলতে অসম্পূর্ণ  নির্মিতির মধ্যে যে আকর্ষণ বোধ করেছিলাম, সেটাই ছিল কবিতার ডাক। তখন সেটা ছিল অস্পষ্ট অনুভূতি। বয়স্ক হবার পর টের পেলাম সেই অনুভূতি কখন যেন   অভিজ্ঞতায় বদলে গেছে। তখন কত লোক কাজ করছে, নানারকমের কাজ, ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে চালচিত্র। প্ল্যান না বুঝলেও দেখতে পাচ্ছি, এলিভেশন অস্পষ্ট, রোজ বেড়ে যাচ্ছে এখানে সেখানে চোখের সামনে, একদিন সেখানে কত লোক থাকবে, আমরা যেমন খেলি তেমনি ওদের বাচ্চারা খেলে বেড়াবে -- এই সব হাবিজাবি  যারা হাত লাগিয়ে এই বদলগুলো করছে তাদের জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছিলাম তারাও আমাদের মতো আনন্দ পাচ্ছিল কিনা।



আজ জেনেছি, ছেলেবেলার সেই ক্ষণগুলো ছিল কন্সট্রাক্টিভ মোমেন্টস্‌ -- নির্মাণের মুহূর্ত বা নির্মিতির ক্ষণ। এই যে আগেই পুরো ছকলেস অলীক মানচিত্র খুলে দিয়ে  ধীরে ধীরে কাঠামো তৈরি করা -- এর মধ্যে আমি এক বিচিত্র পরশ পাই, এক অতীন্দ্রিয় শিহরণ। যে নির্মাণে সম্পূর্ণ হবার অপেক্ষা নেই, সম্পূর্ণ ছবিও দেখা যায় না, শুধু গড়ে উঠতে জানে, সেই সব ক্ষণের আনন্দ উত্তেজনার অনুভব -- তারা সবাই আমার ভাবনার সাক্ষী -- আমি জড়িয়ে ধরি তাদের। কবিতার এই ধর্ম আমার চাইআমার চাই সাদা পাতার সামনে বসা সেই লোকটাকে যে প্রথমে ভেবেছিল কিছু গড়ার কথা আর কোনো ছক ছাড়াই গড়তে শুরু ক’রে একটু একটু  করে এগোয় আর পিছিয়ে চেয়ে থাকে আঁকের দিকে, আর ভাবে, আর মনের ছবির সাথে মেলায়। থ্রিল বোধ করে, নির্মিতির সেই ক্ষণগুলো তার আর ফুরোয় না আহা! সেই অফুরাণ মুহূর্তগুলো একটা একটা করে গড়ে তুলছি আমি আর চেয়ে আছি  নির্নিমেষ! সেটাই আমার চাই। কোনো প্রতিমা নয়, সচেতন পরতগুলির মধ্যান্তরে  বিলম্বিত লয়ের শিহরণ আমার চাই। আজ যখন কোনো কবিকে দেখি কন্টিনিউইটি  নয়, বক্তব্য নয়, স্মৃতি নয়, নন্দন নয়, সেই নির্মিতির ক্ষণগুলোও আলাদা আলাদা ভাবে কবিতায় উপস্থিত করছে, আমার মন আনন্দে ভরে যায়। ভাবি আমিই যেন,  আমিই যেন!
এভাবে থেমে থেমে একটা কবিতা লিখেছিলাম, আর এনজয় করেছিলাম এর প্রতিটি লেফট রাইট থাম।

চাই দেখতে সেই স্বপ্ন বিছানাটা আর সেই মেয়েটা কে কাকে পাতে ... ... ... ...
আরও চাই সোনা দিননিশা আর নিশাদিন পদ্যে পোড়া সাপ ও অবাক ... ... ...
মেয়েছেলেটির চাই ওলোট পালোট শরীরে হাতে মুখ আর মুখে হাত-এর অমিল ... ...
ধরো ফুলটুল আছে চাই প্রজাপতি-নেই দৃশ্যে আমাকে বাজালো স্বকাল ... ... ... ...
আবার করে মনে পড়তে চাই আমার অলীক গল্পরা কেউ পড়ুক ... ... ... ... ...
আর দ্যাখো উম্‌ম্‌ না দাঁড়াতে চাই আঁকো মেমারি স্টেশন নামের গজবগুলো ... ...
টেন টেন টায়োস্কোপে কাঁপা বন্দীশে চাই জল শহরের আরো আয়ু ... ... ... ... ...
সে আমার জন্য মারুক আমাকে মরতে চাই হাড় গোড় জিরো জিরোতে ... ... ...

আমার সময়ের বেগুনটারি থেকে দিনবাজারের দিকে দাহিন গণিকাপথের দরজাগুলিতে চাই চাই চাই নক করছে যে যুবক এতো বোবায় পড়া এত পাখি এত হাঁস এত কিসের কবিতা দুসরা কবিতা যদি লু বয় যদি শব্দের ভেজা যায় শুকিয়ে ঝরে পড়ে এই নাউনেরা প্রোনাউন বেশে এত আমি
                 স্বপ্ন বিছানা                  মেয়েটা
                               দিননিশা                   পদ্যেপোড়া                 সাপ
মেয়েছেলেটি                শরীর      মুখ                  হাত
            ফুল         প্রজাপতি                                    আমাকের
                                              মেমারি স্টেশন
                    টায়োস্কোপ                জলশহর
সে                                                                           আবার আমাকে       হাড়গোড়
                                                                 আমার      বেগুনটারি      দিন     বাজার
গণিকাপথ             দরজা         পাখি          হাঁস
                              যুবক
                                           দুসরা কবিতা             লু                শব্দের ভেজা

এই খসা ছবিটা পলক ফুরায় দুসরা কবিতা হয়ে নিঃশব্দে ... ... ... এই শব্দে থাক

    কবিতাটার নাম দিই দুসরা কবিতা, আর কান পেতে রই।


  

                

1 কমেন্টস্:

  1. নির্মাণের প্রক্রিয়া আজও শেষ হয়নি, আত্মসন্ধানের সঙ্গে আত্মনির্মাণও এক গতিময় প্রজ্ঞা থেকেই উঠে এসেছে । সমাজ রাষ্ট্র সভ্যতা একই নিয়মে পরিচালিত । খুব সুন্দর এক এক ব্যাপ্তিময় ক্রিয়ার ভেতর নিয়ে গেলেন আমাদের প্রিয় বারীনদা ।

    উত্তরমুছুন