যদি নাম ধরে
বাবার বাবার
দেওয়া নাম। নিত্যকালী। বাবার মায়ের আদুরে সম্বোধনে তা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল নেত্যকালী। আবার বাবার
বউ সেই নাম সংক্ষেপিত করে নেত্য নামেই ডাকাডাকি শুরু করেছিল। এসব অনেক আগের কথা।
নেত্যর নিতান্তই শৈশবের কথা। নামকরণের সেই এপিসোড নেত্যর মনে থাকার কথা নয়, মনেও
নেই। এবং তার কোনো ভূমিকাও নেই। তবে সেই ছোটবেলা থেকে পাড়ায় বেপাড়ায় ইস্কুলে কলেজে
মানে ঘরে বাইরে সর্বত্র যখন তার নাম নিয়ে বিচিত্র হাসাহাসি শুনতে শুনতে রীতিমতো
ক্ষেপে উঠেছিল, ঠিক তখনই তার বন্ধু শুদ্ধকল্যাণ নেত্যকে বলেছিল, বুঝলি, তুই কোর্টে এফিডেভিড করে তোর
নামটা বদলে নিতে পারিস। বেশি বদলাতে হবে না, শুধুমাত্র নেত্য বা নিত্যর পরিবর্তে
নৃত্য। নৃত্যকালী। শুদ্ধকল্যাণের পরামর্শ শুনে প্রথমে হকচকিয়ে গেছিল নেত্য। তারপর
দমকা হাসিতে ভরে উঠেছিল তার সুন্দর শ্যামল মুখ। নিত্যকালী থেকে নৃত্যকালী! শুদ্ধ
তোর মাথার ঘিলু কি পুরোপুরি জমাট বেঁধে ঘুঁটে হয়ে গেছে? শুদ্ধকল্যাণ একটুও অপ্রতিভ
না হয়ে বলেছিল, কেন, তুই তো ভালো নাচতে পারিস্! ভালো গুরুর কাছে তালিম নিচ্ছিস্!
নাচের কম্পিটিশনে কত প্রাইজ পেয়েছিস্! তাহলে! তোর ঐ নিত্য বা নেত্য থেকে নৃত্য
অনেক অনেক ভালো। নেত্য এবার সংযত গলায় বলেছিল, না রে শুদ্ধ, এভাবে দুম করে নাম বদলে দেওয়া যায় না। আমার
ইস্কুল কলেজের সার্টিফিকেটে নিত্যকালী নামই আছে। সেই নাম বদলে দিলে ঐ
সার্টিফিকেটগুলো আর কোন্ কাজে লাগবে বল্? আর আমার চাকরির ক্ষেত্রে কী হবে?
নৃত্যকালী হলে নিত্যকালীর চাকরিটা থাকবে
তো? আর তুই যে চটজলদি কালীর সঙ্গে নৃত্য জুড়ে দিলি, কালীর কী ভয়ংকর নাচ, তা কি তুই জানিস? কখনও ভেবে
দেখেছিস? আর একবার কালীনৃত্য শুরু হলে তুই আমাকে সামলাতে পারবি তো তখন?
অবশ্য এসবও বেশ
কিছুদিন আগেরই কথা। যদিও শুদ্ধকল্যাণের পরামর্শ মতো নেত্য নিত্যকালী থেকে
নৃত্যকালী হয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু নৃত্যশিল্পে সে ইতিমধ্যে রীতিমতো পারদর্শিনী
হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন আসরে ও মঞ্চে ক্ল্যাসিকাল নৃত্য পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রিত হয়।
সবাই বলে, তুই কী সুন্দর নাচিস্ রে! শুদ্ধকল্যাণও একই কথা বলে। তুই খুব সুন্দর
নাচ করিস্। কিন্তু শুদ্ধকল্যাণ কি আরও কিছু বলে নেত্যকে? বলতে চায়? নেত্য কখনও
কখনও শুদ্ধকল্যাণের আঙুল নিয়ে হাতের তালু নিয়ে
খেলতে খেলতে আরও কিছু শুনতে চায়। আরও অন্য কিছু। আরও অনেক কিছু। কিন্তু নেত্য এটাও
লক্ষ্য করেছে, শুদ্ধকল্যাণ তার চোখে চোখ রেখে ঠিকভাবে যেন কথা বলতে পারে না। কেমন
যেন অস্বস্তি বোধ করে। কথা বলতে বলতে কেমন আনমনা হয়ে পড়ে। চুপচাপ হয়ে যায়। নেত্য
ভাবে, শুদ্ধকল্যাণ কেন বুঝতে পারে না, তার এই আচরণে নেত্যর বুকের ঢাকের আওয়াজ
ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসে! ধমনীতে রক্তের তুমুল প্রবাহ কেমন ভাটার টানে নির্জীব হয়ে
যায়! তার শ্যামল কোমল দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে থাকা তরল আগুন নিভে
নিভে যায়!
নেত্য বিজন ঘরে একা একা আয়নার মুখোমুখি
দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে দেহের প্রতিটি ভাঁজ, প্রতিটি খাঁজ। তার অনেক সম্পদ
আছে সারা দেহ জুড়ে। অনেক অনেক সম্পদ। আর মনে আছে ঐশ্বর্যের ভান্ডার। বিশাল
ভান্ডার। তবুও নেত্য বুঝে উঠতে পারে না, কেন সে শুদ্ধকল্যাণের এত কাছে থেকেও খুব
কাছাকাছি পায় না! নিটোল হাতে কেন টেনে নিতে পারে না শুদ্ধকল্যাণের তেজি ছড়ানো বুক!
কোথায় যেন একটা আড়াল থেকে যায়। অদৃশ্য আড়াল। কোথায় যেন একটা দূরতম দ্বীপের দূরত্ব।
নেত্যর মনে পড়ে না, শুদ্ধকল্যাণ কখনও তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল কি না! এবং নেত্য
মনে করতে পারে না, শুদ্ধকল্যাণ কোনোদিন তার নাম ধরে সম্বোধন করেছিল কি না!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন