উৎসমুখ
পৃথিবী নড়ে ওঠার সময়ে আমি কী করছিলাম? মনে নেই এখন আর। হয়তো গৃহস্থালির টুকিটাকি নিয়ে
কলরব চলছিল ভেতরে ভেতরে। রোজকার মতো। এ জন্মে গৃহস্থের পিপাসার শেষ নেই বোধহয়। তাই বারেবারে ফিরে আসে গৃহস্থ
হতে। বৈরাগ্য আসে দু’দিনের অতিথি হয়ে তার ঘরে। আর এই ভূমিকম্প এলে তার ঘরে
কি ফাটল ধরে? উৎসমুখ থেকে
অনেক দূরে বসে থাকা গৃহের দেওয়ালে ঠিক কতটা কাঁপন লাগলে ফাট ধরে? এসব বিলাসী ব্যসনে গৃহস্থের কী সুখ! নেই তো। সে তার গৃহের ঝুল পরিষ্কার
নিয়ে, মাকড়শার
হাত-পা নিয়ে চিন্তিত। পিঁপড়ের বাসা খুঁজতে
ব্যস্ত। টিকটিকির হাঁচিকাশি নিয়ে পর্যদুস্ত। আর রয়েছে তার ক্ষিদে, তার পেট
না-ভরার অসুখ, তার ঘিনঘিনে ঘা, তার শপিং মলের এসক্যালেটর, বদহজমের চোঁওয়া ঢেকুর,
পিত্তির কালচে সবুজ।
আর ভূস্তরের ১৫মিটার নিচে যেখানে উৎসমুখ তৈরি হয়েছিল, সেখানকার
কী খবর? টেকটোনিক
প্লেটের ঠোকাঠুকি, একে অপরের গায়ে চেপে গিয়ে কোন্দল, নাকি আলিঙ্গন-সুখ, তার খবরে গৃহস্থের
কী যায় আসে! কোন পাখিটা যেন বলে গেছিল, গৃহস্থের খোকা হোক! তাকেও এখন আর দেখা যায় না। পাখিরা চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও, গৃহস্থের
ঘরবাড়ি থেকে দূরে। খোকা জন্মায় এখনও, সুস্থ-সিজারিয়ান খোকা
নার্সিংহোম থেকে বাড়ি এসে মাপে মাপে, খোপে খোপে বড় হয়। খুকিদেরও জন্ম হয়, এখন
খুকিদের আর অত দূরছাই নেই, বরং একটু বেশি বেশি আহ্লাদই জোটে। স্কুলে যাওয়া, নাচ
শেখা, গান শেখা, আঁকার ক্লাস, জুডো-ক্যারাটে কিংবা সাঁতার।
ফুটবলে দিওনা বাপু, বড় বেশি গাজোয়ারির খেলা, খুকিদের শোভা কমে যাবে। খোকাদের পড়াশোনা হবে না, ডিক্লাসড্ বলবে লোকে। তার চেয়ে টাই-ঠাই বেঁধে ইংরিজি স্কুলে যাওয়া ঢের ভালো, মানাবে
ওদের। টিফিনের বৈচিত্রে ভেসে যাক লাঞ্চবক্স, পিঠের ব্যাগে ভরা থাক জ্ঞানের ভান্ড,
টাকার থলে উপুড় করে দিক গৃহস্থ খোকাখুকিদের টিউশনে। ক’টা টিউটর, আঙুলে গোনা
যায়? হিসেব রাখা যায় দিন ও
সময়ের? ম্যানেজ করতে পারো তো বাপু? ওটিই আসল উৎসমুখ গৃহস্থের।
তোমার বাথরুমের কল থেকে টপটপ করে জল পড়ে? খুব অলুক্ষণে জিনিস এই জল পড়ে
যাওয়া, এভাবেই জলের মতো ভেসে যাবে তোমার সংসারের
অর্থ-সম্পদ। ফেনসুই মানো না মানো, এটা মানো। কলের মিস্তিরিকে ডেকে কল
বদলে নাও এখুনি। আর যদি রাতে শুয়ে শুয়ে টপটপ শব্দ শুনতে তোমার ভালো লেগে থাকে, তাহলে থাক। জল পড়ুক। ভূস্তরে এখনও অনেক জল জমে
আছে। শ্যালো, ডিপটিউবওয়েল, পাম্পের সাধ্য কী সব ফুরোয়!
তোমার কল চুঁইয়ে ওইটুকু জল পড়া বা না-পড়ায় কিচ্ছু
যায় আসে না পৃথিবীর। কর্পোরেশনের জল, মিউনিসিপ্যালিটির
জল তো আর তোমার পাম্প বেয়ে ওঠে না, তোমার ইলেকট্রিক বিলে কোনো সাইডএফেক্ট পড়ে না। তো পড়তে থাক ওই জল। প্রথম কল খুললে কেমন আওয়াজ হয়, সে তুমি জানো। ফ্যাচফ্যাচ, খ্যাচখ্যাচ
কিছুক্ষণ, তারপর মিনিট দু’একের নিস্তব্ধতা, আবার
সোঁসোঁ, আবার ফ্যাচফ্যাচ, খ্যাচখ্যাচ, ব্যাস- এবার জল পড়বে তার স্পিড লিমিট মেনে। গলির গলি, তস্য
গলিতে সরু সুতো আর মেন রোডের ধারে খরস্রোতা নদী। আবার যেন উৎসমুখ নিয়ে ভেবো না, কম্পনের তারতম্য তো
আছেই। কোথাও জল সরু হয়ে পড়বে, কোথাও জোরে। তেমনি কোথাও
বাড়িঘর একটু কাঁপবে, কোথাও ধূলিসাৎ হবে, সোজা হিসেব। তুমি এত কিছু না ভেবে
জল খরচ করে যাও যেমন খুশি।
নেপালে এত ধ্বংস হলো কেন? কেন আবার সিম্পল
হিসেব। তুমি তেড়ে গাছটাছ কেটে উড়িয়ে দিয়ে হোটেলেমোটেল বানালে ইয়া লম্বা লম্বা।
তোমার পকেটে ডলার থিকথিক করতে লাগল, আর তোমার পায়ের তলার মাটিতে যে উৎসমুখ, তুমি
বেবাক ভুলে গেলে। এখন আর ধ্বংস নিয়ে কোনো কথা শুনতে তোমার ভালো লাগে না জানি, মৃত্যু নিয়েও না। এই মৃত্যু উপত্যকায় জীবন
এখন ধুঁকে ধুঁকে শ্বাস ফেলছে। এখনও মাটি কাঁপছে তুমি টের পাচ্ছ। হ্যাঁ, মানছি লড়াই
করতে পারে বটে ওই দেশের লোকগুলো। সামলে উঠছে, ওই যাকে বলে ঠিকমতো ম্যানেজ করে নিচ্ছে সব। আসলে
বিপদে পড়লেই বোধহয় ম্যানেজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায় মানুষের। আচ্ছা, এবার ঘরের কথা
বলি, এই যে এইটুকুন কেঁপেই আমরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছি ভয়ে, আমাদেরও তো
লম্বু বিল্ডিং আছে, নড়বড়ে পোড়ো বাড়ি আছে। ভয় লাগবে না? ভয় পেয়েছ বেশি, নাকি এনজয়
করেছ কিছু ওই দুলুনি? কেমন ঘুম ঘুম ঘোর ঘোর, কেমন সেই মায়ের হাতের দোলনার কথা মনে
আসে নি! এই অবেলায় মনে হয় নি, একটু ঘুমিয়ে নিই আগে!
মায়ের কথা মনে এলেই জানবে তুমি
প্রায় পৌঁছে গেছ উৎসমুখে।
হ্যাঁ, এবার নিজের কথায় আসি। সেই যে মাটি যেদিন কাঁপল, আমি তখন একবার ওপেন
কিচেনের থেকে খোলা ডাইনং-এ, আর একবার ডাইনিং পেরিয়ে সিঁড়ি ভাঙার চেষ্টায় রত। মানে কোনদিকে কি করছি, এগোচ্ছি
না পিছোচ্ছি, দ্বন্দে ছিলাম নিশ্চিত। যাই হোক, হঠাৎ মনে হলো মাথাটা ঘুরে উঠলো। ভাবলাম প্রেসার বেড়েছে নির্ঘাত।
রানাঘরের স্ল্যাব ধরে সে যাত্রা সামলালাম। ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে আবার
বোঁবোঁ। তখনো মাথা ঘুরছে ভাবছি। সিঁড়ি ভাঙছি, নাকি সিঁড়ি আমাকে ভাঙছে, বুঝছি না।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল আসলে, মনে হচ্ছিল এমন ঘুম আসুক দু’চোখ জুড়ে, যেন আর আলো না
দেখি। মৃত্যু চাই নি, মৃত্যুর কাছাকাছি কিছু দেশে চলে গেছি এক মিনিটেই। আমি আর আমি
নেই, এক হালকা পালক হয়ে ভাসছি মহাশূন্যে। মাটিতে আর পা রাখতে পারবো না কোনোদিন। এভাবেই ভাসতে ভাসতে
একদিন টুপ করে ডুবে যাব হয়তো কো্নো পুকুরে, নদীর জলে, সমুদ্রে বা নালা-নর্দমায়। হয়তো রাস্তাতেই পড়ে গড়াগড়ি খাব কিছু সময়।
এসব ভাবনা ছিল অচেতন মনের, কয়েক
মুহূর্তের ঘোর।
সচেতন হলে দেখি, মাটি স্থির হয়েছে আবার। আমি আমিই আছি। শুধু মনে হচ্ছে ছুটে গিয়ে
দেখে নিই সব প্রিয় মুখ। সবাই ভালো আছে তো! আমার সামনের, পিছনের, কিছুটা দূরের খবর
আমি নিতে পারি ইচ্ছে হলেই। জানতে পারি না উৎসের কোনো খবরাখবর। সে আমার পিছুটান নয়, ফিরে আসা নয়, সে আমার শিকড়ের মতো নষ্ট এক বাঁধন।
তোমার কোনো বাঁধন নেই, জানি। না
থাকাই ভালো। বেশ ডালে ডালে উড়ে উড়ে বেড়াও প্রজাপতি হয়ে। আনন্দে তিরতির করে কেঁপে ওঠে
তোমার ডানা। আমি তোমায় দেখি, আর খুশিতে ভরে উঠি। তোমার সুখেই আমার সুখ গো! কী হলো, থামলে কেন? ও, বুঝেছি, হাঁফিয়ে যাচ্ছ। কী আর করা যাবে
বল... বয়স হলে অমন একটুআধটু হাঁফ
ধরে। একটু জিরিয়ে নাও, বোস এই মাটিতে থেবড়ে। লজ্জা কী! একটু না
হয় ধুলো মাখলে।
এই হলো গিয়ে শ্রেষ্ঠ আসন। শাস্ত্রে বলেছে। দেখ, কেমন ফুরফুরে হাওয়া এসে তোমার সমস্ত ক্লান্তি শুষে
নিচ্ছে! তুমি চনমনে হয়ে উঠছ আবার। যাও, এবার যেখানে খুশি যাও। এই মাটি তোমার থেকে
কোনো ভ্যাট চাইবে না। ওর সব ফ্রি। যেমন তুমি ফ্রি ফ্লোয়িং।
আর তাই তোমাদের এত জমে! ও বাঁধে
না, তুমিও বাঁধো না। আর আমি দূর থেকে মিটমিট করে হাসি। তুমি যে ফিরে এসেছিলে তোমার
উৎসমুখে, বুঝলেও না! এভাবেই বুঝি বারেবারে ফিরে আসতে হয়!
মাটিও ফিরে গেছিল সেদিন তার উৎসে, কী এক অমোঘ
টানে। যাচাই করেছিল পরতের পর পরত। জিভে জল ছুঁয়ে দেখে নিচ্ছিল, কতটা শুদ্ধ এখনও এই
জল। কিছু আর্সেনিক গেছে, কিছু এখনও আছে। ধুয়ে যাবে, এ আশা রাখে এখনও মাটি। মাটি
চলেছে আরও গভীরে, তার উৎসমুখের খোঁজে। সে খুঁড়ছে নিজেকে
আপ্রাণ, যত গভীরে যাচ্ছে, নিজেই
চাপা পড়ে যাচ্ছে নিজের ভারে। আবার খুঁড়ছে, আবার, আবার, বারবার। তার এই লড়াই সফল
হয়েছিল কিনা এখনও জানা যায় নি। আমরা অপেক্ষা করছি ওর জন্য। তার উৎসের সেই যে
টেকটোনিক প্লেট দুটো, যারা একে অন্যের ঘাড় চেপে ধরেছিল, তারা এখন কী অবস্থায়, সেই
কৌতূহল রয়ে গেল, মাটি জানতে পারবে সব, এই আশা রাখি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন