কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

ভ্রম

খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস আইরিন নাহারেরঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে দুই মগ পানি পান করেএটা তাঁর রোজকার রুটিনএরপর হাঁটতে  বেরোবার জন্যে রেডি হওয়ারেডি হতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগে নাব্লাডে সুগার ধরা পড়েছে বছর দুয়েক হলো। আর সুগার লেবেল হাই হলে যা হয়! ক্রিয়েটিনিন  বেড়ে যায়, হার্টের ব্লকসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারেএ কারণে ডাক্তার বেশি করে হাঁটতে বলেছেনআলোকদিয়া অমরেশ বসু কলেজের বাংলার অধ্যাপক আইরিন নাহার। চাকরির মেয়াদও শেষের দিকে। এ বছরই অবসরে যাবেন

বাইরে তখন শিশির বৃষ্টি। কদিন থেকেই হচ্ছেএকটা ফোল্ডিং ছাতা নিয়ে হাঁটতে বের হলেন আইরিন নাহার মাঝি পাড়া থেকে নবগঙ্গা নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে   হাঁটতে বিনোদপুর বাজার পযর্ন্ত চলে যান

এত সকালে একলা হাঁটতে কোনো ভয় করে না আইরিন নাহারের এখানে জন্ম,  এখানে বেড়ে ওঠা, এখানকার কলেজে চাকরি করেন; ভয় করবেন কাকে? সবাই তো  চেনা মানুষএখানকার সবাই তাঁকে খুব সম্মান করে

আকাশটা মেঘলা বলে তখনও অন্ধকার পুরোটা কাটেনিছাতা মাথায় দিয়ে গুটি পায়ে হাঁটতে থাকেন আইরিন নাহার। হাঁটতে হাঁটতে ফেলে আসা দিনের কথা ভাবতে থাকেনএ কথাগুলো ভাবতে চান না। কিন্তু ভাবনা তো কারো বাধা মানে না! না চাইলেও মনের অগোচরে এসে হাজির হয়

চুয়াল্লিশ বছর আগের কথা তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই এক আল বদরের ছেলের সাথে তাঁর বিয়ে ঠিক হয় এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না আইরিন  নাহারআর তাই রাতের অন্ধকারে নিজের পছন্দের ছেলে সৈকতের হাত ধরে বাড়ি ছাড়েন। গিয়ে ওঠেন সৈকতের বাড়ি। সেখানেই ওদের বিয়ে হয়কিন্তু ওদের দাম্পত্য জীবনটা ভালো কাটেনিরাজাকাররা রোজ সৈকতকে খুঁজতে আসতরাজাকারদের ভয়ে একদিন বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলো সৈকত। যোগ দিল মুক্তিযুদ্ধে প্রথম দিকে মাঝে মাঝে লুকিয়ে এসে স্ত্রীর সাথে দেখা করে যেত। রাতে থাকতও। কাকডাকা ভোরে চলে যেতএমনি এক নভেম্বরে শেষবার যখন সৈকত চলে গেল সেদিনও এমন শিশির বৃষ্টি ছিল বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে সেই যে সৈকত চলে গেল আর ফিরল নাষোলই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো, একে একে সবাই বাড়ি ফিরল, কিন্তু সৈকত ফিরল না আইরিন নাহার আজো জানেন না, তার স্বামী বেঁচে আছেন, না... এখনও স্বামীর জন্যে নিরন্তর অপেক্ষা

দেশ স্বাধীনের পর আইরিন নাহারের কোল আলো করে একটি ফুটফুটে ছেলে আসে ছেলের নাম রাখেন স্বাধীন নিজে আবার পড়াশোনা শুরু করেন নিজের চেষ্টায় ছেলেকে মানুষ করেন ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেন ছেলে-বৌ আর নাতি-নাতনি নিয়ে আলোকিত সংসার আইরিন নাহারের

এ সব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন আইরিন নাহার হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে তাকালেনদেখলেন, দূরে একটা মানুষ তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেআস্তে আস্তে লোকটা তাঁর সামনে চলে এলো তাঁর সামনে এসে হঠাৎ লোকটা থমকে দাঁড়ালোচোখ তুলে তাকালেন আইরিন নাহারলোকটাকে দেখে চমকে উঠলেনএ কী! কে  এই লোকটা? একমুখ পাকা দাড়ি-গোঁফে ভরা! তারপর লোকটাকে চিনতে এতটুকু কষ্ট হলো না 
হ্যাঁ, সৈকতই তো! সৈকত, এতদিন পর! ও কী তাহলে বেঁচে আছে

এ সব ভাবতে ভাবতে লোকটা স্বাভাবিকভাবেই ওর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না আইরিন নাহার নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলেন একটু একটু করে ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল লোকটার শেষ চিহৃটুকুও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আইরিন নাহার আবার হাঁটতে শুরু করলেন   



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন