কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

০৪) অর্ক চট্টোপাধ্যায়

উপ-হারা



সকাল সকাল ওরা হাতে একটা বল ধরিয়ে দিল। লাইব্রেরির সামনে ছাতা পেতে বসে ছিল ছেলের দল। ফ্রেন্ডশিপ ডে উপলক্ষে ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে উপহার। ভালো থাকার জন্য প্লাস্টিকের ফোলা ফোলা একটা বল। রামধনু রঙে রাঙানো ভালো থাকা। নির্মেঘ আকাশের সকালটায় আমি তখন বাসস্টপের দিকে যাচ্ছি। বাস, ট্রেন, তারপর গন্তব্য। মন ভালো করার এহেন মানুষোচিত প্রয়াস কৌতুক জাগালো আর কৌতুকের ভেতরে কোথাও একটা ভালো থাকা তো থেকেই যায়, তাই না? দু’হাতে বলটা ধরে বাসস্টপের দিকে এগোতে এগোতে ভাবলাম, না, এই বলখানা নিয়ে তো আর আমার ওহেনো গুরুগম্ভীর গন্তব্যে যাওয়া যাবে না। তাই মিষ্টি রামধনু রঙের এই ভালো থাকাটাকে বিসর্জন দিয়েই বাসে উঠতে হবে। বলটার দিকে চোখ দিতে তার আদুল গা বেয়ে সূর্যের আলো ঝলসে এলো। পেছন ফিরে দেখলাম, এখনো ওদের দৃশ্যমানতার মধ্যেই রয়েছি। এখুনি উপহার ফিরিয়ে দেওয়া বা বেওয়ারিশ ফেলে দেওয়াটা খারাপ দেখাবে বলে এগোতে থাকলাম; ভাবলাম বাসস্টপে তো অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, ওখানে পৌছে বেঞ্চে বসিয়ে দেব বলটা।

বাসস্টপে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপচাপ চোরের মতো বলটাকে পাশে বসিয়ে দিলাম। অবশেষে আমার হাতের বাইরে, শরীরের বাইরে, আমার বাইরে বেরিয়ে সমান্তরালে বসতে পারল আমার নিদারুণ গোলগাল ওই ভালো থাকা। ঝকঝকে সূর্যের সেই সকালে আমি আর আমার ভালো থাকা যখন একই বেঞ্চে পাশাপাশি বাসের অপেক্ষায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছি, ঠিক এমন সময় দমকা একটা হাওয়া দিল আর বলখানা বেঞ্চি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। আমি তখন তাকিয়ে আছি আমার বিরহী অভিমানী ওই ভালো থাকার দিকে আর ভাবছি, ওকে হাওয়া বার করে দিয়ে চুপশে দেওয়া উচিৎ ছিল! তখন বেশ নেতিয়ে পড়ে থাকত বেঞ্চির ওপর আর আমি ড্যাংড্যাং করে বসে উঠে আমার ভারিক্কি গন্তব্যের দিকে রওনা দিতাম! ভেতরের হাওয়া বার করে নিলে কি আর এত সহজে বাইরের হাওয়ায় উড়ে যেতে পারত? এখন আর ভেবে কী হবে, এখন তো হাওয়ার টানে দিব্বি এগিয়ে যাচ্ছে। ঘাসের ওপর দিয়ে বড় রাস্তার দিকে, হয়তো আসন্ন গাড়ির চাকায় অসময় মৃত্যুর দিকে! আমি শুধু তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম।

কিন্তু না, এমনটা হলো না। হয়তো এত সহজে আসে না মৃত্যু কিম্বা এত তাড়াতাড়ি নয়। চাইলেই কি আর ত্যাগ করা যায় উপহার? বন্ধুত্ব? কৌতুক? ভালো থাকা? আমি তাকিয়ে দেখলাম মৃত্যুর রাস্তার দিকে যাবার পথে আমার বেওয়ারিশ উপহার নতুন ওয়ারিশ পেয়ে গেল। একটি মেয়ে, যে বাস স্টপ পেরিয়ে রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল, আর যার হাতে তখনও পর্যন্ত অমন কোনো গালফোলা বন্ধু ছিল না, কুড়িয়ে নিল বলটা। তারপর দু’দিক দেখে রাস্তা পেরিয়ে নীল একটা গাড়িতে উঠে চলে গেল। আমি বলটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তাই মেয়েটার মুখ দেখা হয়নি। তবে তাতে আপশোস নেই, আমার গোলগাল ভালো থাকা বন্ধুটিই যে পাড়ি দিয়েছে ওর সাথে! একটুখানি মেঘের পরত কাটিয়ে বাসস্টপটা তখন রোদে প্রাঞ্জল হয়ে উঠছে আবার, আর আমি গাম্ভীর্যের দোহাই দিয়ে কোট্‌টাকে টানটান করে নিচ্ছি।

1 কমেন্টস্: