স্মরণের সরণিতে - ৩
বাঘের ছানা
[এই স্মৃতিকাহিনীর লেখক শ্রীঅনিল শেঠের জন্ম ১৯২৮ সালে। তাঁর শৈশব কাটে জামশেদপুরে, সেখানে স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করে তিনি যান কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। বিজ্ঞানে স্নাতক হবার সঙ্গে সঙ্গে বিগত শতকের চল্লিশের দশকের কলকাতায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন, দাঙ্গা, দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার সেই সব ঐতিহাসিক মুহুর্তগুলো। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন আর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর ঝুলিতে জমা হয় বিচিত্র ও বর্ণময় সব অভিজ্ঞতা! গণনাট্যের প্রসারে তিনি সফর করেন অবিভক্ত বাঙলাদেশের নানা স্থানে। পরে তিনি জামশেদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম শাখা। তারপর শহরের নানা বিদ্যায়তনে শিক্ষকতার পেশায় অতিবাহিত হয় তাঁর জীবনের অনেকগুলি বছর।বিজ্ঞান-প্রদর্শনী, সায়েন্স ক্লাব ইত্যাদি নানা অভিনব কর্মধারার মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরূপে। বর্তমানে সেই পেশা থেকে অবসর নিয়েও এই বর্ষীয়ান শিক্ষাব্রতী আজও নানা ধরনের সৃষ্টিশীল মননে ও চর্চায় নিযুক্ত। তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণময় জীবন-খাতার পাতা থেকে কিছু আকর্ষণীয় কাহিনী আমরা মাঝে মাঝে এখানে পরিবেশন করব।]
টাটানগর স্টেশন থেকে টাটা-চাইবাসা রোড ধরে প্রায় ১৫ কি মি গিয়ে বাঁ দিকে ঐ রাস্তা থেকে ৪/৫ কি মি দূরে রাঙ্গাপাহাড় নামে সুন্দর একটা পাহাড় আছে। ১৯৫২ সালে যুব আন্দোলন সংগঠনের কাজে আমি ঐ পাহাড়ের কাছে একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামের লোকজন সবাই ছিল আদিবাসী। ফসল কাটার মরশুমে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা সবাই খেতে কাজ করত, ছোট ছেলেরা ঘরের গরুছাগল ও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীর দেখভাল করত। মেয়েরা দূর থেকে জল আনত, পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ আর গাছের ডাল সংগ্রহ করত ও বাড়ির সব কাজকর্ম করত।
একদিন একদল মেয়ে রাঙ্গাপাহাড়ের আশেপাশে কাঠকুটো সংগ্রহ করছিল। তারা ছিল হাসিখুশি, উচ্ছ্বল-আনন্দে তারা গান গাইছিল, নিজেদের মধ্যে খুনসুটিও করছিল। হঠাৎ তারা ছোট্ট একটা বাঘের বাচ্চাকে সেই দিকে ছুটে আসতে দেখে থমকে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল যে, বাচ্চাটা লুকোবার কোনো জায়গা খুঁজছিল। কাছাকাছি যে সব ছেলেরা গরুছাগল চড়াচ্ছিল, তারা মেয়েদের তীক্ষ্ণ চিৎকারে আকৃষ্ট হলো। তারা ও মেয়েরা মিলে বাঘের ছানাটিকে ঘিরে দাঁড়াল ও ধরে ফেললো। সংক্ষিপ্ত ও উত্তপ্ত তর্ক বিতর্কের পর তারা ঠিক করল, ছানাটিকে একটি দর্শনীয় বস্তু হিসেবে গ্রামে নিয়ে আসা হবে। তারা বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে সাহস পাচ্ছিল না।
বাঘের ছানাটিকে গলায় দড়ি বেঁধে গ্রামের মোড়লের বাড়িতে রাখা হলো। তারা ছানাটির জন্য দুধ নিয়ে এলো। কিন্তু সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করল, বাটি থেকে দুধ খেতে তো সে আর অভ্যস্ত নয়!
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীদের আনন্দের উচ্ছ্বাস মিলিয়ে যেতে লাগল, যখন তারা গ্রামের সীমানার বাইরে থেকে বাঘের গর্জন শুনতে পেল। তখুনি সে গর্জনে সাড়া দিয়ে বাঘের ছানাটি সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে, এটি নিশ্চিত তার বাঘিনী মা’রই গর্জন। বাঘিনী কোনোরকম ভাবে তার বাচ্চাকে নিয়ে আসার রাস্তা শুঁকে শুঁকে গ্রাম পর্যন্ত এসে পৌঁছছিল। গ্রামের গরুবাছুর ও অন্যান্য জন্তুরা আতঙ্কে লাফালাফি ও চিৎকার শুরু করে দিল।
গ্রামের লোকজনও ভয় পেয়েছিল। তাড়াতাড়ি তারা টিনের বাক্স, ঢাকঢোল, শিংগা ইত্যাদি নিয়ে এলো। তারা তীর-ধনুক, বল্লম, কুঠার ইত্যাদিও জোগাড় করল আর বাঁশের ডগায় কেরোসিন ভেজানো ন্যাকড়া জড়িয়ে মশাল তৈরি করল। কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে চিৎকার ও উচ্চগ্রামে আওয়াজ করতে করতে তারা গ্রামের সীমানা পাহারা দিতে বিভিন্ন দিকে রওনা দিল। শিগ্গিরিই তারা গ্রামের পরিসীমা ধরে গড়ে তুলল এক প্রতিরক্ষা-বলয়। যে দক্ষতা ও তৎপরতার সঙ্গে এ-কাজ তারা করল, তা যে কোনো সেনানায়কের মনে ঈর্ষা জন্মানোর যোগ্য।
আশেপাশের গ্রামগুলোও একইভাবে সড়া দিতে শুরু করল। বাঘিনীটাও যথেষ্ট ভয় পেয়েছিল। সে আর গ্রামে ঢোকার সাহস করল না, তার বদলে গ্রামের চারপাশে নানা দিকে ঘুরে বেড়িয়ে বাইরে থেকে গর্জন করতে লাগল।
গ্রামের বড়োরা ঠিক করল, ছানাটিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু কে সাহস করে যাবে তার মায়ের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিতে? আবার বেশি দেরি করাটাও বুদ্ধির কাজ হবে না। জোয়ান ছেলেদের একটা দল তৈরি করা হলো। তারা টাঙ্গি আর বল্লমে সুসজ্জিত হয়ে ছানাটিকে নিয়ে গাঁয়ের সীমানায় হাজির হলো। সেখানে তাকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে পিছিয়ে গিয়ে ক্যানাস্তারা আর ঢাকঢোল পেটাতে শুরু করল। বাঘের ছানা লাফ দিয়ে দৌড় লাগালো গ্রামের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে...
বাঘের ছানাটা কি খুঁজে পেয়েছিল তার মা’কে? তাদের কি সুখী পুনর্মিলন হয়েছিল? শাবক-হারানো বাঘিনী কি আগামী দিনগুলোতে তার বাচ্চা চুরি করার প্রতিশোধ নেবে? গ্রামের লোকজন এ-ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না। তারা ঠিক করল, আরও কিছুদিন পাহারাদারি চালু রাখতে হবে।
[ভাষান্তর – অলক বসুচৌধুরী]
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন