হাইকু কবিতা ও কিছু কথা
আরশাদ উল্লাহ
ক্ষুদ্রতম কবিতা বলতে হাইকু কবিতাকেই বোঝায়। ক্ষুদ্র হলেও হাইকু কবিতার মাঝে বড় একটি কাহিনী লুক্কায়িত থাকে, আর সে কাহিনীটির মধ্যে থাকে সময়ের উল্লেখ। একটি ঋতুকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দেখিয়ে হাইকু লেখা হয় শুধু একটি মাত্র বিষয় বা ক্ষণকে কেন্দ্র করে। হাইকুটি অর্থবোধক হতে হবে, তাতে থাকতে হবে চমক, নইলে তা প্রকৃত হাইকু হবে না। বাংলাদেশে কিছু সাহিত্যিক হাইকু নিয়ে গবেষণা করেছেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'কালি ও কলম' সাহিত্য পত্রিকাতে হাইকু সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পড়েছি। তাতে বিভিন্ন জনের লেখা বেশ সুন্দর কিছু হাইকু ছিল। হাইকু কবিতা ৫-৭-৫ অর্থাৎ ১৭ টি অক্ষরে তিনটি ক্ষুদ্র লাইনে লেখা হয়। জাপানী ভাষার আদি 'হিরাগানা' অক্ষর মোট ৪৮টি এবং এই হিরাগানা অক্ষর গণনায় হাইকু লেখা হয়। আবার, বাংলাতে ৪৮টি ব্যাঞ্জন বর্ণ জাপানি হিরাগানা বর্ণের সমান বলে হাইকু একই পন্থায় বাংলাতে লেখা যায়।
হাইকু কবিতার প্রবর্তক হলেন জাপানের বিখ্যাত কবি মাৎচুও বাশো। তাঁর হাইকুতে নাটকীয় ভাবাবেশ, মানসিক বিভ্রান্তি, বিষণ্নতা ও হতাশা লক্ষ্য করা যায়। বাশোর সাহিত্যকর্মে যতই মানুষের কৃতিত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে, তার বিপরীতে মানবজাতির ক্ষুদ্র অবস্থান ও অস্তিত্ব ব্যক্ত করার মাধ্যমে তিনি প্রকৃতির ক্ষমতা ও মহত্বকে আরও ঊর্ধে দেখিয়েছেন। নিচে বাশোর হাইকুটিতে তা বোধগম্য হবে।
“ভ্রমণ ক্লান্ত
অসম্পূর্ণ স্বপন
শুকনো মাঠ…”
বাশো একজন পরিব্রাজক ছিলেন। তিনি জাপানের দক্ষিণ থেকে উত্তরে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেছেন। স্থানে স্থানে বাসা করে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে থাকতেন ও হাইকু লিখতেন। এক সময় ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। তিনি বুঝতে পারেন যে, বেশিদিন আর বাঁচবেন না। তখনকার পরিস্থিতির ভাব হাইকুটিতে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর জীবনের যে স্বপ্ন পূর্ণ হবে না, তা তিনি বুঝতে পারেন। বিশাল শুক্নো মাঠের কথায় তিনি ঋতু ও বিশাল শক্তিধর প্রকৃতির কথা ব্যক্ত করেছেন। শীতকালে মাঠ শুষ্ক থাকে।
কবি বাশো ১৭ অক্ষরে লেখা কবিতাকে 'হাইকা' নামকরণ করেছিলেন। পরে তাঁর উত্তরসূরি কবি মাসাওকা শিকি (১৮৬৭ – ১৯০২) ‘হাইকা’ নাম বাদ দিয়ে 'হাইকু' নামকরণ করেন। হাইকু সম্পর্কে অনেকে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। কারণ, বাঙালিরা ইংরেজিতে যতটুকু পারদর্শী, জাপানীতে ততটা নয়, বিধায় ইংরেজি হাইকু অনুকরণ করতে গিয়ে এই অসুবিধায় পড়েন। ইংরেজ সাহিত্যিকগণ 'হাইকু' কবিতাকে মূল্যায়ন করেছেন। হাইকুর রহস্যটুকু অনুধাবন করে তাঁরা ইংরেজিতে লিখতে থাকেন। কিন্তু ইংরেজিতে ৫-৭-৫ অক্ষরে বা বর্ণতে হাইকু লেখা যায় না। তাই তাঁরা সিলেবল্-এর মাধ্যমে হাইকু কবিতার চর্চা করেন। জাপানী হাইকুতে সিলেবল্ নেই। তাঁরা ধ্বনিকে প্রাধাণ্য দিয়েছেন, তাকে 'অন্জি' বলে। উদাহরণ, 'কা কি কু কে ক'-এর মতো হিরাগানা ৪৮টি বর্ণের ধ্বনিকে 'অন্জি' বলে। একই ভাবে বাংলা ব্যাঞ্জনবর্ণকে 'অনজি' বলা যেতে পারে। তাই বাংলায় জাপানী হাইকুর সাথে মিলিয়ে বাংলাতে হাইকু লেখা যায়।
নিচে আমার লেখা তিনটি হাইকু উদ্ধৃত করলাম
“উজ্জ্বল-রূপ
লন্ডন-অলিম্পিক
পদকযুদ্ধ...”
“আম্র কানন
স্নিগ্ধমুকুল-গন্ধ
বসন্ত রূপ...”
“রজনীগন্ধা
দিয়ে গেল তরুণী
সুরভি মাখা…”
এছাড়া প্রাসঙ্গিক ভাবে তিনটি হাইকুর অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করলাম।
Rinka Ono-এর তিনটি হাইকু
“ডিনার সেরে
লোকটি যুদ্ধে যাবে
কোষে জোনাকি...”
“বর্ষা বরষণ
মনে হয় গৃহিণী
পিছনে দাঁড়ানো...”
“বরফ পথ
কৃত্রিম পায়ে হেঁটে
গির্জাতে কুঠো...”
সহজ হাইকু, কিন্তু ভাবটুকু গভীর। প্রথম হাইকুটিতে ভুরিভোজন শেষে লোকটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে। 'কোষে জোনাকি' কথাটিতে লোকটির ভবিষৎ পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। কবি যুদ্ধ বিরোধী ছিলেন। দ্বিতীয়টিতে, একনাগাড়ে বৃষ্টির কারণে গৃহস্বামী কাজকর্ম ফেলে বাইরে চোখ রেখে ভাবছেন। ঠিক সেই সময়ে তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর স্ত্রীও পিছনে দাঁড়িয়ে একই ভাবনা ভাবছেন। সার্থক দম্পতির ক্ষেত্রেই এমনটি ভাবা যায়! তৃতীয় হাইকুটিতে কুষ্ঠ রোগীর কথা ব্যক্ত করেছেন। রোগীটির পা ক্ষয় হয়ে গেছে, প্রভু তার জীবনের সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছেন। নির্দিষ্ট স্থানটিতে জীবনভর সে কারাগারের বন্দিদের মতোই থাকবে। অথচ সে কৃত্রিম পা লাগিয়ে গির্জাতে গিয়ে তার সেই প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে এসেছে, শীতের দিনে বরফপথে হেঁটে!
আশাকরি, হাইকু সম্পর্কে মোটামুটি কিছু ধারণা পাঠকদের দিতে পেরেছি। হাইকুর রীতিনীতি ঠিক রেখে লেখা গেলেও, তাতে কিন্তু চমক থাকতে হবে। কোনো একটি বিশেষ দৃশ্যকে হাইকুতে ফুটিয়ে তোলা হয়। তাতে একটি কাহিনী লুপ্ত থাকে মাত্র সতেরটি বর্ণের মিনি কবিতায়।
হাইকুর ওপর আপনার লেখা পড়ে ভালো লাগল । অল্প কথায় অনেকটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন ।
উত্তরমুছুনহাইকুর অনুবাদ কি মূল জাপানী থেকে, অথবা ইংরাজীর অনুবাদ ?