কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

জে. হোবেরম্যান

 

আন্দ্রেই রুবলেভ : এক দিব্য ভাব-বিগ্রহের উদয়

 

(অনুবাদ : অদিতি ফাল্গুনী) 




আন্দ্রেই তারকোভস্কির নিষ্করুণ অন্ধকার ও চমকপ্রদ সিনেমা ‘আন্দ্রেই রুবলেভ‘ যখন প্রথম ১৯৬০-এর শেষ দশক নাগাদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র আয়োজনে প্রদর্শিত হলো (১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে এই ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হয়, তবে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য ছবিটির আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনী বন্ধ রাখে), তখন আপাত:দৃষ্টে ছবিটিকে মনে হয়েছে যেন এক মূর্তিমান অসঙ্গতি - পুনরুত্থিত স্লাভিক অতীন্দ্রিয়বাদে অভিযুক্ত এক প্রাক-সোভিয়েত নিষ্ঠুরতার মঞ্চ। আজ, তারকোভস্কির নির্মিত এই দ্বিতীয় কাহিনীচিত্র যেন সোভিয়েত ইউনিয়নে নব্বইয়ের দশকে আসন্ন সেই ঝড়েরই পূর্বাভাস জানিয়েছিল বলে মনে হয়।

সত্যি বলতে সের্গেই আইজেনস্টেইনের ‘ইভান দ্য টেরিবলে‘র বিশটি বছর পর তারকোভস্কি নির্মিত ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’ ছিল ঐতিহাসিক বিচারে সবচেয়ে  দু:সাহসী সিনেমা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের মহত্ত্বের নিরিখে এর উচ্চতা দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাশিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম আইকন বা গির্জার প্রতিমূর্তি আঁকিয়ে আন্দ্রেই রুবলেভের (১৩৬০-১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দ) জীবনী নিয়ে তারকোভস্কির এই মহাকাব্যিক সিনেমায় রুবলেভের জীবন নানা জায়গায় পরিচালক নিজেও যেন  অনেকটাই ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’ সৃষ্টি করেছেন। ‘আন্দ্রেই রুবলেভ‘ সিনেমার নির্মাণ বিচারে যতটাই সেরা, ভাবাদর্শগত দিক থেকে ততটাই যেন ‘ক্ষ্যাপাটে’। একটি সোভিয়েত সিনেমা হিসেবে সহিংস এবং এমনকি রক্তাক্ত এই ছবি ‘আন্দ্রেই রুবলে’‘ মধ্যযুগে রাশিয়ায় তাতার আক্রমণের নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত এবং গোটা সিনেমাটিই কালানুক্রমিকভাবে এক গ্রন্থনাহীন নাট্যাভিনয়ের  দৃশ্যাবলীই যেন দর্শকের সামনে মেলে ধরে। এই সিনেমার নায়ক যেন এক অপার্থিব বা দৈবী সত্ত্বার মত পরিত্যক্ত ঐশ্বর্যের এক ভূ-খন্ডে ঘুরে বেড়ান - তিনি দেখছেন যন্ত্রণা ভোগা কৃষকের দল, পবিত্র গ্রন্থরাজি তাঁর চোখের সামনে অধ্যাসের মত দেখা দিচ্ছে, তিনি কাজ করছেন নিষ্ঠুর অভিজাতদের জন্য যতদিন না ভ্লাদিমিরের শহর আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হওয়ার সময় এক নারীকে  আক্রমণে উদ্যত এক তস্করকে হত্যা করার পর রুবলেভ নীরবতার শপথ নেন এবং ছবি আঁকা ছেড়ে দেন।




একইসাথে বিনয়ী এবং মহাজাগতিক এই ছবি ‘রুবলেভ’-কে পরিচালক   তারকোভস্কি নিজেই বর্ণনা করেছেন ‘পৃথিবীর ছবি’ হিসেবে। ওয়াইড স্ক্রিনে শ্যুট করা এবং তীক্ষ সাদা-কালোয় বিন্যস্ত, সংজ্ঞায়িত এই ছবি চূড়ান্তভাবে স্পর্শকাতর - এই সিনেমায় প্রদর্শিত চারটি ধ্রুপদী উপকরণ হলো: কুয়াশা, কাদা, নিভে যেতে থাকা মোমবাতি এবং তুষার। একটি আদিম আস্তাবলকে ঘিরে ক্যামেরার ৩৬০-ডিগ্রি আবর্তন মূলত: মানব অস্তিত্বের বিস্ময়কেই প্রকাশ করে।   ক্যামেরার এই যত দীর্ঘ ও আঁকাবাঁকা টেকগুলো যেন কোন এক্সপ্রেশনিস্ট বা অভিব্যক্তিবাদী শিল্পীর হাতের ব্রাশস্ট্রোক - তুলির কাজ। এক গাঢ়, অশান্ত নদীর উপরিভাগে একটি ঘোড়ার ক্ষুরের দাগের অভিঘাতকে ক্লোজ-আপে শটে ফুটিয়ে তোলা থেকে তারকোভস্কির ক্যামেরা আবার ছুটে যায় এক বন্ধ্যা পাহাড়ের পাশ দিয়ে তাতার ঘোড়সওয়ারদের পথের ধূলো উড়িয়ে ছুটে চলার দিকে। অন্য সময়গুলোতে পরিচালকের ক্যামেরা ঠিক যেন দেবদূতের মত এক যন্ত্রণার্ত ভূ-খন্ডের বাতাসে ভাসতে থাকে। সিনেমাটির মেধাবী ও অব্যখ্যাত সূচনায় এক মধ্যযুগীয় ইকারুসকে দেখায় যে কিনা এক ক্রুদ্ধ জনতাকে স্বর্গরাজ্যে ঝড়ো  আক্রমণের জন্য সাহস যোগাচ্ছে। একটি চার্চের মিনারে আরোহণ করে এই ইকারুস একটি আদিম গরম-বাষ্পীয় বেলুনে চড়ে ওড়ার সময় - নিচে পৃথিবীর অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখানো হতে থাকে - যতক্ষণ না বেলুনে করে ওড়া ইকারুস ভূ-পৃষ্ঠে পড়ে পিষ্ট হয়ে যান।

তারকোভস্কি ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’-এর কাজ শুরু করেন।  এটি ছিল তাঁর প্রথম কাহিনীচিত্র ‘ইভানস চাইল্ডহুড’ ভেনিসে স্বর্ণ সিংহ পাবার দু‘বছর পর এবং নিকিতা ক্রুশ্চেভের ক্ষমতাচ্যূতির একমাস আগের ঘটনা। ১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে বিরূপ আবহাওয়ায় ছবিটির ফটোগ্রাফির মূল কাজ বন্ধ হয়ে যেতে না যেতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কৃতি বিষয়ক কর্তাব্যক্তিরাও তারকোভস্কির প্রতি বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬৬ সালের জুলাইয়ে রুবলেভ যখন শেষমেশ সমাপ্ত হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় ফিল্ম এজেন্সি সিনেমাটির নানা দৃশ্যের ব্যপক কাট-ছাঁট দাবি করেন। রুশ বিপ্লবের পঞ্চাশতম পূর্তির ঠিক প্রাক্কালে এই ছবিটি ছিল যেন বড় বেশি নেতিবাচক, বড় বেশি নিষ্ঠুর, বড় বেশি পরীক্ষামূলক, বড় বেশি ভীতিকর, বড় বেশি নগ্নতায় ভরা এবং রাজনৈতিকভাবেও বড্ড বেশি জটিল। মস্কোয় প্রথম একবারের মত স্ক্রিনিং হওয়ার পরে (রাশিয়ার ডম কিনো প্রেক্ষাগৃহটি এইদিন চারপাশ থেকে পুলিশে ঘেরাও ছিল), ‘দ্য প্যাশন এ্যাকোর্ডিং টু আন্দ্রেই’ শিরোনামের এই সিনেমাটি তাকবন্দী করে ফেলা হয়। সিনেমাটি থেকে প্রায় পঁচিশ মিনিটের দৃশ্যাবলী কেটে বাদ দেয়ার পর (যা অবশ্য তারকোভস্কি নিজেই পরে অনুমোদন করবেন) ১৯৬৭ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি তালিকাভুক্ত করা হয় শুধুমাত্র শেষ মুহূর্তে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাতিল  হবার জন্য। দুই বছর পরে, ফরাসী কম্যুনিস্ট পার্টিকে তাদের আন্দোলনের জন্য অংশত: ধন্যবাদ দিতেই হয়, রুবলেভ শেষপর্যন্ত কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় - তবে ছবিটি বলতে গেলে প্রতিযোগিতার বাইরে ছিল। ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনে ভোর চারটায় স্ক্রিনিং সত্ত্বেও ছবিটি ‘আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরষ্কার’ অর্জন করে। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে; লিওনিদ  ব্রেজনভে ছবিটি তাকে আলাদাভাবে একান্তে দেখানোর দাবি তোলেন বলেও পরে জানা যায় এবং সিনেমাটির মধ্য পর্যায়েই তিনি হল থেকে বের হয়ে আসেন।

ফ্রান্সে সোভিয়েত দূতাবাসের কঠোর বিরোধিতা এবং ছবিটির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরও প্যারিসে ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’  উন্মুক্ত হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালে সোভিয়েত সাংস্কৃতিক আমলাতন্ত্র খানিকটা নমনীয় হন এবং ১৯৭১ সাল নাগাদ ছবিটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে প্রদর্শিত হবার ছাড়পত্র পায়। দু’বছর পর নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘রুবলেভ’ দেখানো হয়, তবে ছবিটির মার্কিনী পরিবেশক ‘কলম্বিয়া পিকচার্স’ সিনেমাটির আরো কিছু কাট-ছাঁট করে। টাইম ছবিটি ডক্টর জিভাগো-র সাথে তুলনা করে। নিউইয়র্কের অন্য চলচ্চিত্র আলোচকেরা যারা সিনেমাটির নোট নিয়েছেন, তারা ‘রুবলেভ’-এর আপাত: ছেঁটে ফেলা অংশের কথা উল্লেখ করে ছবিটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছিলেন।

যাহোক, বিশেষ কি আর বলার আছে? শিল্পী রুবলেভকে সিনেমার শুরুতেই তাঁর দুই সন্ন্যাসী ভাইয়ের সাথে পরিচয় করানো হয় যারা ঝড়ের ভেতর একটি আস্তাবলে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে কিছু গ্রাম্য চাষী অশালীন কৌতুকাভিনয়ে  বিনোদিত হচ্ছে। পরবর্তী দৃশ্যক্রমে, দু‘জন সন্ন্যাসী পরস্পর মিলে নন্দনতত্ত্ব আলোচনা করছে যখন কিনা চার্চের বাইরে একজন কারাবন্দীকে একটি তাকের উপর রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। অবশেষে, ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে, এই দুই সন্ন্যাসীর একজন মঠ ছেড়ে বাইরে বের হবে এবং এই বলে অভিসম্পাত দিতে থাকবে যে শিল্পের প্রতি নিবেদনই তাঁর ভাইদের নষ্ট করেছে। পরবর্তী সময়ে রুবলে ‘শেষ বিচার’-এর একটি দৃশ্য এঁকে বিশ্ববাসীদের ভীত করতে অস্বীকৃতি  জানান। রুবলেভের এই নীতি তাঁর কর্মজীবনকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল; তবে নিয়তির পরিহাস হলো যে গির্জা অলঙ্করণের এই শিল্পীর মৃত্যুর এক শতাব্দী পরে রুশ অর্থোডক্স চার্চ তাঁরই নির্মিত বিগ্রহগুলোকে সর্বোচ্চ বৈধতা প্রদান করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্যও রুবলেভের কাজগুলোকে ‘চিরায়ত কাল ধরে শিল্পের প্রমিত মান হিসেবে অনুসরণ করতে হবে’ বলে নির্দেশ দেয়।  

তারকোভস্কির এই ছবিটিই বোধ করি সোভিয়েত শাসনামলে নির্মিত প্রথম এবং একমাত্র ছবি যেখানে শিল্পীকে একজন বিশ্বঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে দেখানো  হয়েছে এবং খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতিদ্বন্দী ধর্ম বা রাশিয়ার আদি প্যাগান বা পৌত্তলিক  ধর্মকে সেদেশের ঐতিহাসিক সত্ত্বার সর্বজনবিদিত শেকড় হিসেবে দেখানোও হয়েছে। মোটের উপর আন্দ্র্ইে রুবলেভ সিনেমাটি ইতিহাসের এক বিশৃঙ্খল যুগ বা সময়ে প্রোথিত যে যুগ ঐ বিশৃঙ্খলার ভেতরেই জাতীয় পুনর্জাগরণও ঘটাবে এবং রুবলেভের চিত্রকলা হবে সেই যুগের সাংস্কৃতিক প্রতীক। বরঞ্চ রুশ গির্জা অলঙ্করণে আইকন বা বিগ্রহের প্রতি শিল্পীদের ভক্তি বা নিবেদন এত বেশি  থাকত যে এটাই পরে রুশ চিত্ররীতিকে পশ্চিমা চিত্ররীতি থেকে আলাদা করে। পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ যতই তার চূড়ান্ত মাত্রা লাভ করতে থাকে, ততই খ্রিষ্ট ধর্মের পবিত্র বিগ্রহসমূহ আরো বেশি করেই যেন একধরনের ইহজাগতিক বা পার্থিব ও ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা লাভ করতে থাকে; অন্যদিকে  রুশ চিত্রকলা তবু পৃথিবীর বাস্তব প্রতিনিধিত্বের বদলে চৈতন্যের প্রতিভূ হয়ে ওঠে।

একদিক থেকে দেখলে, রুবলেভ যেন শুচিতা-সংযম ও কৃচ্ছ্রতায় কঠোর খ্রিষ্ট ধর্ম ও ইন্দ্রিয় বিলাসী পৌত্তলিকতার ভেতরে এক দ্বন্দের উপর প্রতিষ্ঠিত - সেই পৌত্তলিকেরা স্লাভ হোক আর তাতারই হোক। অন্য দিক থেকে দেখলে, এই সিনেমাটি আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও দমনের প্রেক্ষিতে শিল্পীর অবস্থানও দেখায়। সন্ত জনের পর্বের সাথে জড়িত রুশ লোকজীবনে তখনো অনবলুপ্ত পৌত্তলিকতার রহস্যময়তায় রুবলেভ নিজেও যেন হোঁচট খান - সন্ত জনের এই পর্ব এক অজানা আচার পালিত হয়, যেমনি কোমল তেমনি বিস্ময় জাগানিয়া, যেখানে নগ্ন কৃষকেরা কুয়াশার ভেতর থেকে মশাল বহন করে নিয়ে যায় - সন্ন্যাসী রুবলেভ নিজেই বন্দী হন এবং একটি ক্রশের সাথে তাঁকে বেঁধে ফেলা হয়। এখানে শিল্পী তারকোভস্কির এক অতি সূক্ষ্ম কাজের নমুনা:  অসাবধানতাবশত: আন্দ্রেই রুবলেভ নিজেই একটি ধিকি ধিকি করে জ্বলা  অগ্নিশিখায় পা দিয়ে ফেলায় তাঁর পোশাকে আগুন ধরে যায়, ক্ষণিকের জন্য তাঁর পোশাকে অগ্নিশিখা জ্বলতে দেখা যায়।



উপরোল্লিখিত এসব বিবরণ ব্যতীতও, সিনেমাটি নিজেই যেন একটি গোটা ভুবনকে মেলে দেখায়, অথবা, আমাদের সেই ভুবনের ঘ্রাণ নিতে সাহায্য করে,  যেমনটি আন্দ্রে বাঁজা তাঁর প্রবন্ধ ‘দ্য মিথ অফ টোটাল সিনেমা’-য় বলেছেন, পৃথিবী নিজেই এখানে স্ক্রিনের ভেতর তার পথ খুঁজে পেতে জোর খাটাচ্ছে। পরিচালনা করা যায় না এমন নানা প্রাণী তারকোভস্কির সিনেমার কম্পোজিশনকে জীবন্ত করে তোলে - শবদেহে একাকার একটি গির্জায় আবদ্ধ একটি বিড়াল, একটি বিধ্বস্ত শহরে বুনো হংসীরা ডানা ঝটপট করে। জল সাপ এবং সার বেয়ে বেঁধে চলা পিঁপড়েয় বার্চ গাছগুলোকে জীবন্ত দেখায়, অরণ্যের জমিন থেকে একটি পচতে থাকা রাজহংসী পাওয়া যায়। এই সিনেমার সাউন্ডট্র্যাক পাখির ডাক এবং শব্দহীন গান দিয়ে ভরা; আবহে প্রায়ই আগুন চিড়বিড় করে ফাটার শব্দ বা গির্জার ঘন্টাধ্বনি।

আন্দ্রেই রুবলেভ নিজেই যেন যতটা না সিনেমা, তার চেয়েও বেশি একটি ভাববিগ্রহ যা এক ভাববিগ্রহ শিল্পীর জীবন নিয়ে নির্মিত। এই সিনেমাটিকে আমরা ‘চলমান ভাববিগ্রহ’ হিসেবেও দেখতে পারি ঠিক যে অর্থে ল্যুমিয়ের  ভ্রাতৃদ্বয় ‘চলমান ছবি’ বানিয়েছিলেন। এই সিনেমা এমন এক শিল্পীর প্রতিকৃতি রচনা করেছে যেখানে কেউ একবারও হাতে তুলি তোলে না। কেননা গির্জা অলঙ্করণের বিন্যাস তো ঈশ্বরের কাছ থেকেই আসে, সেটি রুবলেভের তুলির ছিটকে  যাওয়া রঙ পুকুরের জলের আবর্তে ঘোরার ক্লোজ-আপ শটেই দেখা যাক  অথবা ময়লা ও মাটির যে চাঁই রুবলেভ একটি সাদা চুনকাম করা দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দেন, সেই দৃশ্যের চিত্রায়ণেই বোঝা যাক না কেন! তবে আর কোন সিনেমাই শিল্পীর ভূমিকার উপর এত বেশি গুরুত্বারোপ করেনি। যেন বা রুবলেভের উপস্থিতিই সৃষ্টিকে বৈধতা দান করে। 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন