কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)


(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)




 

*অধ্যায় - ২ / ৫*

 

*উৎস (Origin):*

অথর্ববেদ-এর প্রথমদিককার অংশগুলিতে শূদ্ররা যে একটি উপজাতি হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে, সেটি তৃতীয় উল্লেখেও বর্ণিত হয়েছে, যেখানে জ্বর (fever) স্বরূপ তকমানকে (takman) বলা হয়েছিল একজন রঙ্গপ্রিয় শূদ্র নারীকে আক্রমণ করতে, যার সাথে ছিল মুজাভান্তাস (Mujavantas), বালহিকাশ (Balhokas) এবং মহাভরাসাস (Mahavrasas)। এরা সকলেই মনে হয় দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের বাসিন্দা ছিল, যেখানে 'মহাভারতে', শূদ্র উপজাতিদের বর্ণিত করা হয়েছে অভিরা-দের (Abhiras) সাথে বসবাসকারী হিসেবে। আরেকটি শ্লোকও এই ইচ্ছার পুনরাবৃত্তি করেছে যে জ্বর (fever) বিষয়টি বিদেশি মানুষদের কাছে চলে যাক। এই সমস্ত কিছুই সুপারিশ করে যে, শূদ্র নারীদের যে অনুষঙ্গে উল্লেখিত করা হয়েছে, সেটি ঋক-বৈদিক পর্যায়ে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের ভিনদেশী উপজাতিদের প্রতি আর্যদের যে প্রতিকূল মনোভাব ছিল, তার সাথে সম্পর্কিত। এবং সেই কারণে, এক্ষেত্রে শূদ্র (sudra) শব্দটি সম্ভবত শূদ্র উপজাতির রমনীদের বুঝিয়েছে। পাইপ্পলদা'র (paippalada) একটি সমান্তরাল পাঠ্যাংশের একটি সংশোধনে, 'শূদ্র' শব্দটিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে 'দাসী' শব্দ দিয়ে, যেটি দেখিয়ে দেয় যে, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শব্দদুটি বিনিময়যোগ্য। সেইজন্য, যাকে বহুপ্রচীন ও সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলা হয়েছে, তার নিরিখে 'শূদ্র' শব্দটির ঋগবেদে বারংবার উল্লেখের (occurrence) বিষয়টিকে বুঝতে হবে, বর্ণ অর্থে নয় বরং উপজাতি অর্থে, যেটি বিষয়বস্তুর সাথে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ।

অভিরা-দের সাথে যৌথভাবে শূদ্রেরা একটি উপজাতি হিসেবে বারংবার উল্লেখিত হয়েছে মহাভারতে, যেটি এমন একটি পরম্পরা ধারণ করে, যার উৎস নিহিত রয়েছে খৃষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে। এই মহাকাব্য শূদ্র কুল (kula) (যার উল্লেখ করা হয়েছে ক্ষত্রিয় কুল ও বৈশ্য কুলের সাথে) এবং শূদ্র উপজাতির (tribe) মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশিত করেছে, যা উল্লেখিত হয়েছে আভিরা (Abhira), দারাদাস (Daradas), তুখারাস (Tukharas), পাহলাভাস (Pahlavas) প্রভৃতিতে। নকুল (Nakula) দ্বারা শূদ্রেরা একটি উপজাতি স্বরূপ স্থান পেয়েছিল পরাজিত মানুষদের তালিকায়, তাঁর সার্বিক দিগ্বিজয় অভিযান এবং যুধিষ্ঠিরকে তাঁর মহান রাজ্যাভিষেক (rajsuya) উপলক্ষে উপহার সমূহ প্রদান সংক্রান্ত পর্যায়ে। বিভিন্ন উল্লেখে তারা অভিরা-দের সাথে একই বন্ধনীতে উল্লেখিত হয়েছে এবং মনেহয় ভারতে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল, সাকা (Sakas), তুখারা (Tukharas), পাহলাভা (Pahlavas), রোমাকা (Romakas), চীনা (Chinas) এবং হুন-দের (Hunas) আগেই, এবং তাদের নাম সভ্য পাহলাভাদের (Sabhya Pahlavas) নামের তালিকায প্রক্ষিপ্ত হয়েছে পরের দিকে। খৃষ্টান যুগের পূর্ববর্তী বা পদানুবর্তী প্রথম কয়েকটি শতাব্দীর অ-ভারতীয় সূত্র সমূহ, শূদ্রদের বৈদেশিক যোগাযোগের কোনো সূচনা দেয় না। খৃষ্টান যুগের প্রথম দিকের শতাব্দীগুলিতে আভারা-রা ভারতে এসেছিল, এমন অভিমতের সমর্থনে  কষ্টকরভাবেও কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এটি মনে হয় যে, একটি উপজাতি হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল ভারত যুদ্ধ'র (Bharata War) কালে এবং সেই মহাযুদ্ধের পরবর্তী পরিণাম স্বরূপ চরম বিশৃঙ্খল পর্যায়ে তারা নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছিল পাঞ্জাবে। আভারাদের সাথে শূদ্রদের ক্রমাগত উল্লেখ সুপারিশ করে যে, একটি পুরাতন উপজাতি হিসেবে যুদ্ধের সময় তাদের উদয় হয়েছিল।  অথর্ববেদের প্রথমদিকের উল্লেখসমূহে শূদ্রদের একটি উপজাতি হিসেবে ব্যাখ্যার সাথে এটি সুন্দর ভাবে মিলে যায়।

পরবর্তী প্রশ্ন হল, শূদ্রেরা কি আর্য ছিল অথবা প্রাক-আর্য, এবং যদি আর্য হয়, তবে কবে তারা ভারতে এসেছিল? শূদ্র উপজাতির জাতিতাত্ত্বিক শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে নানান পরস্পরবিরোধী অভিমত রয়েছে। প্রথমদিকে এই অভিমত বজায় রাখা হয়েছিল যে, শূদ্রেরা ছিল আর্যদের আগমনের প্রথম তরঙ্গ ; পরে এটি তুলে ধরা হয়েছিল যে, তারা প্রাক-আর্য মানুষের একটি বৃন্ত (stem) ছিল। উভয় মতের সপক্ষেই কোনো প্রমাণ পেশ করা হয়নি, কিন্ত প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে, কেউ এমন একটি চিন্তার দিকে আনত হতে পারে যে আর্যদের সাথে শূদ্র উপজাতির কিছু বংশগত মিল ছিল। এটি কৌতুহলোদ্দীপক যে, শূদ্রদের সর্বদা আভিরা-দের সাথে এক বন্ধনীতে রাখা হয়েছে, যারা আর্যদের 'আভিরি' নামক একটি কথ্য ভাষায় কথা বলতো। এই সত্য যে ব্রাহ্মণদের সময়কালে  শূদ্র শ্রেণীর লোকেরা আর্য জবান (speech) বুঝতে পারতো, সেটিও হয়ত নির্দেশিত করে যে, যদিও দূরবর্তী অবস্থান থেকে (remotely), যে শূদ্র উপজাতিরা আর্য ভাষার সাথে পরিচিত ছিল। উপরন্তু, দ্রাবিড়, পুলিনদাস, সাবারা প্রভৃতি প্রাক-আর্য মানুষদের তালিকায় শূদ্রেরা কোনো কালেই উল্লেখিত হয়নি। তারা সর্বদা অবস্থিত থাকতো উত্তর-পশ্চিমে, যা পরবর্তী কালে প্রধাণত আর্যদের দ্বারা অধিকৃত একটি অঞ্চল ছিল। আভিরা-রা এবং শূদ্ররা নিবদ্ধ (settled) হয়েছিল সরস্বতীর (Sarasvati) কাছে। বলা হয়ে থাকে যে, তাদের প্রতি শত্রুতার কারণে, সরস্বতী মরুভূমিতে উধাও হয় গিয়েছিলেন। এই সমস্ত উল্লেখসমূহ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ দ্রসবতী'র সঙ্গে সরস্বতী, আর্য-দেশ নামে পরিচিত অঞ্চলটির একটি অন্যতম সীমানাকে চিহ্নিত করেছিলেন।

দাহার (dahar), অর্থাৎ ভারতের দাসেদের ইরানীয় সমগোত্রীয়দের  কথা ইতিপূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে, কিন্ত শূদ্রদের ক্ষেত্রে এমন একটি সমীকরণ স্থাপিত করা কষ্টকর। এটি সন্দেহজনক ভাবে প্রস্তাবিত করা হয়েছে যে, শূদ্রদের (sudres) সমান গণ্য করা হয়েছে গ্রীক শব্দ কুদ্রাস (kudras)-এর সঙ্গে, যেটি হোমার (Homer) দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে (অনুমানিক খৃষ্টপৃর্ব দশম শতাব্দী থেকে নবম শতাব্দী-তে) মহান অর্থে, এবং একটি গুণবাচক সংজ্ঞা হিসেবে প্রযুক্ত হয়, সাধারণত ঐশ্বরিক কোনো সত্তার ক্ষেত্রে তথা কদাচিৎ মানবীয় সত্তার ক্ষেত্রে। পরের দিকে ভারতে, শূদ্র একটি নিন্দনীয় (opprobrium) শব্দ হয়ে উঠেছিল, যেটি প্রযুক্ত হতো সেইসব মানুষদের ক্ষেত্রে, যারা ব্রাহ্মণদের অপছন্দের লোক ছিল ; বিপরীতপক্ষে, হোমেরীয় গ্রীস-এ, এটি একটি সম্মতিসূচক শব্দ ছিল। এটিকে অত্যন্ত অনুমান নির্ভর (tentatively) পরামর্শের মাধ্যমে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, প্রকল্পিত ইন্দো-ইউরোপিয়ান কুন্দ্রা (Kundra) উপজাতির সদস্যরা, যারা উপজাতির নেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, পরবর্তীতে তারা যখন গ্রীস আক্রমণ করেছিল, সেই সময় তাদের মধ্যে যারা ভারতে প্রবেশ করেছিল, তারা তাদের সহকর্মী-আক্রমণকারীদের দ্বারা অবদমিত হয়েছিল। একই শব্দ যে ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অন্তর্নিহিত অর্থ বহন করে, সেটি অসুরের (asura) উদাহরণ থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। অসুর যখন ভারতে অশুভ শক্তির সাথে সম্মিলিত ছিল, তখন ইরানে তার আদিরূপ আহুরা ছিল ঈশ্বর। উপমাটি প্রযুক্ত হতে পারে ভারত ও গ্রীসে শূদ্র শব্দটির ব্যবহারের ক্ষেত্রে, কিন্ত চূড়ান্ত নিশ্চিত হিসেবে গণ্য হতে পারে না, যদি না  এটি প্রমাণিত হয় যে কুদ্রাইরা (kudrai) গ্রিসের একটি উপজাতি ছিল। যাইহোক, উপরোক্ত বিবরণের ভিত্তিতে, এটি সম্ভব যে, দাসেদের মতোই শূদ্রেরা, ইন্দো-আর্য বংশের সাথে সংযুক্ত ছিল।

যদি তারা ইন্দো-আর্যদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকতো, তাহলে কখন তারা ভারতে এসেছিল? এটি প্রস্তাবিত হয়েছে যে তারা আর্য অভিবাসনের প্রথমদিকের প্রবাহ-তরঙ্গ ছিল। কিন্ত যেহেতু সেটি ঋগবেদে উল্লেখিত হয়নি, সুতরাং এমন হতে পারে যে ঋক-বৈদিক পর্যায়ের কাছাকাছি সময়ে, দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে বিদেশী উপজাতি প্রবাহ-তরঙ্গের এক অভিঘাতের তারা প্রতিনিধিত্ব করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে জানা গেছে যে, খৃষ্টপূর্ব ২০০০-এর পর থেকে ভারতের দিকে ধেয়ে আসা জন-প্রবাহ, প্রায় এক সহস্রাব্দ কাল যাবত ধারাবাহিক ভাবে জারি ছিল, যেটি ভাষাবিদ্যাগত প্রমাণ দ্বারাও সমর্থিত হয়েছে। সেইজন্য এটি সম্ভবপর যে, খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে শূদ্ররা ভারতে এসেছিল, যখন বৈদিক আর্যদের দ্বারা তারা পরাভূত হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তাদের, পরের দিকের বৈদিক সমাজে চতুর্থ বর্ণ হিসেবে অভিনিবিষ্ট (absorb) করে নেওয়া হয়েছিল। যথেষ্ট মজার ব্যাপার যে, সরস্বতী দ্বারা পরিবেষ্টিত অঞ্চলটি, যার সাথে শূদ্র মানুষজনেরা সংযুক্ত ছিল, খৃষ্টপূর্ব ১০০০-এর কাছাকাছি সেটি ছিল ধুসর রঙের পণ্যসম্ভারে পরিপূর্ণ একটি স্থান।

এটি জোরের সাথে দাবি করা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণদের সাথে সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফলস্বরূপ ক্ষত্রিয়রা শূদ্রদের অবস্থানে হ্রস্বীকৃত (reduced) হয়েছিল, যারা শেষপর্যন্ত, তাদের প্রতিপক্ষ দ্বারা, উপনয়ন (upanayana) বা পৈতে'র অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। শান্তি পার্বনের (Santi Parvan) মহাব্রত (Mahabrata) অনুযায়ী একান্তে বাস করার একটি পরম্পরাগত আচারানুষ্ঠানের ভিত্তিতে, শূদ্রদের রাজা পাইজাভানা (Paijavana) দাবি করেছিলেন যে, শূদ্রেরা শুরুতে ক্ষত্রিয় ছিল। এমন একটি অভিমত, বাস্তবিক পক্ষে ভিত্তিহীন বলেই মনে হয়। প্রথমত, ঋক-বৈদিক পর্যায়ে, যাবতীয় অধিকার ও কর্তব্য সহ, সুন্দর ভাবে সঙ্গায়িত একটি বর্ণ হিসেবে ক্ষত্রিয়দের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। যুদ্ধ এবং সাধারণ দৈনন্দিন ঘটনাসমৃহের পরিচালন ব্যবস্থা ছিল সমগ্র উপজাতির অথবা খুব বেশি হলে গোষ্ঠী-সর্দারের বিচার্য বিষয়, কিন্ত কোনোভাবেই সেটি কোনো মনোনীত শ্রেণী যোদ্ধার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। একেবারে শুরু থেকেই, ধীর লয়ে গড়ে ওঠা উদীয়মান যোদ্ধা ও পুরোহিতদের গোষ্ঠীগুলি আর্য তথা অনার্য মানুষদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভিস-দের (vis) নেতৃত্ব প্রদানে সহযোগিতা করেছিল। শান্তির সময় গোষ্ঠীদুটি একযোগে চেষ্টা করেছিল ভিস-দের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায় করতে, এবং সুতরাং রাজাকে 'ভিসামট্ট' (visamatta) বলা হয়েছে। যেমন যেমন সময় অতিক্রম করেছে, যোদ্ধারা পুরোহিতদের অকৃপন উপহার অর্পন করেছে এবং ধর্মানুষ্ঠানগুলিকে যথেষ্ট প্রসারিত করেছে যাতে পুরোহিতরা, যারা তাদের প্রতিপাদিত করেছে (performed) এবং যোদ্ধারা, যারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তারা সাধারণ জনতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, পরের দিকের বৈদিক পর্যায়ে, পুরোহিত ও যোদ্ধাদের মধ্যেকার সংগ্রামের অনুরণন সমূহে, যা পরশুরাম (parasurama) ও বিশ্বামিত্রের গল্পসমূহের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তাতে এমন কিছু ছিলো না যাতে দেখানো যায় যে, উপনয়ন সমস্যাটি তৈরি করেছিল এবং সেটি স্থিরিকৃত হয়েছিল  ক্ষত্রিয়দের বিরুদ্ধে। সম্ভবত সংগ্রামটি আবর্তিত হয়েছিল উপহার ও শ্রদ্ধাসমূহের উদ্বৃত্তের ভাগ-দখলের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে, যেগুলি 'ভিস' নামক উপজাতীয় কৃষকদের কাছ থেকে কখনো সখনো সংগ্রহ করা হতো এবং সামাজিক আধিপত্য উপভোগ করা হতো, যেটি তাদের দ্বারা ভোগ করা বিশেষাধিকারসমূহের প্রকৃতি নির্ধারিত করেছিল। বিদ্যাবত্তা'র (knowledge)ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদী একাধিকার-এর বিষয়টি নিয়ে কিছু বিতর্ক ছিল, যেটিকে ক্ষত্রিয়রা সফলতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। এটি মনে হয় যে, অশ্বপতি কৈকেয়ী (Asvapati Kaikeya) এবং প্রবাহনা জৈভালি (Pravahana Jaivali) ব্রাহ্মণদের অসঙ্গত কোনো শিক্ষক ছিলেন না।  মিথিলার জনক-এর মতো ক্ষত্রিয় রাজপুত্র, উপনিষদীয় চিন্তাধারা বিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিলেন এবং ক্ষত্রিয় শাসক বিশ্বামিত্র (Visvamitra) যাযকগিরি করার দাবি করেছিলেন। পূর্ব-উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে, ক্ষত্রিয় বিদ্রোহ, তার চরম সীমায় পৌঁছেছিল, গৌতম বুদ্ধ ও বর্ধমানা মহাবীরের শিক্ষার আলোকে, যাঁরা দাবি করেছিলেন ক্ষত্রিয়দের সামাজিক প্রাথম্য (Social primacy) এবং ব্রাহ্মণদের তার পরবর্তী স্থান অর্পণ করার। মুখ্য বিষয়টি ছিল, সমাজে কারা প্রথম স্থান পাবে, ব্রাহ্মণেরা অথবা ক্ষত্রিয়রা ? কিন্ত এটি, উপহার সামগ্রী, শ্রদ্ধাসমূহ এবং শ্রম ক্ষমতার ভাগ-দখলের বিষয়টির সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত ছিল। না বেদ পরবর্তী পর্যায়ের সাহিত্যে, না মৌর্য-পূর্ব পর্যায়ের সাহিত্যে, এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না, যার দ্বারা দেখানো যায় যে, ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ণে হ্রস্বীকৃত করতে চেয়েছিল এবং ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে একই জিনিস করতে চেয়েছিল।

তৃতীয়ত, এমন চিন্তা করা ভুল যে, শুরুতেই উপনয়ন-এর অধিকার  হারানোর বিষয়টি শূদ্র হওয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্ণায়ক পরীক্ষা ছিল। এক্ষেত্রে আধুনিক আদালতের সিদ্ধান্তসমৃহ একটি পথ প্রদর্শক হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না, কারণ শূদ্র শ্রেণী যখন অস্তিত্বে এসেছিল, তখনকার অবস্থা ও পরিবেশ ছিল ভিন্ন। শূদ্রদের ক্ষেত্রে উপনয়নের অধিকার হারানোর বিষয়টি, যেমনটি পরে দেখানো হবে, দেখা গিয়েছিল পরেরদিকের বৈদিক পর্যায়ের শেষে এবং তা সত্ত্বেও, এটি তাদের ক্রীতদাসতুল্য জীবনের কারণ স্বরূপ তাদের ওপর প্রযুক্ত একমাত্র অক্ষমতা ছিল না, বরং অনেকগুলি অক্ষমতার মধ্যে একটি ছিল। যেমন পরে নির্দেশিত করা হবে, উপনয়ন-এর অধিকার হারানোর বিষয়টি আর্যদের শূদ্রে রূপান্তরিত করার কারণে ঘটেনি, বরং সেটি ঘটেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে তাদের নিম্নতর বর্গে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে।

চতুর্থত, শান্তি পার্বন-এর (Santi Parvan) এই পরম্পরা যে পাইজাভানা (Paijavana) একজন শূদ্র ছিল, তার প্রামাণিকতার সাক্ষী হওয়া কঠিন। তিনি ভরত (Bharata) উপজাতির প্রধান সুদাস-এর সাথে চিহ্নিত হয়েছেন এবং এটি বিতর্কিত যে, দশরাজাদের যুদ্ধের এই বীর একজন শূদ্র ছিলেন। বৈদিক সাহিত্যে এই মতের সমর্থনে কিছুই নেই এবং শান্তি পার্বন পরম্পরা, মহাকাব্য বা পুরাণের মতো অন্য কোনো উৎস দ্বারা প্রতিপাদিত হয়নি। পরম্পরা বয়ান করেছে যে, শূদ্র পাইজাভানা বলিদান সম্পাদিত করেছে, এবং মহাভারতে খুব সামান্য কয়েকটি অংশে উল্লেখিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, শূদ্রেরা পাঁচটি বৃহৎ বলিদান সম্পাদিত করতে পারে এবং উপহারসমূহ প্রদান করতে পারে। এটি নির্ধারণ করা কঠিন যে পরম্পরাটি সঠিক অথবা ভুল, কিন্ত একথা স্পষ্ট যে, এটি একটি নজির হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে যে শূদ্রেরা বলিদান সম্পাদিত করতো এবং উপহারসমূহ প্রদান করতো, এবং পরবর্তীতে যেমন দেখানো হবে যে, সেটি 'শান্তি পার্বন'-এর উদার মনোভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। এটিও ইঙ্গিত করা হতে পারে যে পরের দিকে শূদ্র অথব ভ্রসালা (vrsala) শব্দটি ব্রাহ্মণদের দ্বারা নির্বিচারে সেই সমস্ত লোকেদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হতো, যারা তাদের বিরুদ্ধে গেছে। আমরা জানিনা শূদ্র পাইজাভানাদের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছে কি না। অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের বিবৃতি একথা বোঝায় না যে ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণেরা শূদ্রদের পদমর্যাদায় হ্রস্বীকৃত হয়েছিল, কিন্ত সেগুলি নিছক এইসব মহিমময় ব্যক্তিদের শূদ্র পরম্পরাকে সুপারিশ করে, বিশেষ করে তাদের মাতৃক্রমের দিক থেকে।

(ক্রমশ)

  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন