কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

কাজী লাবণ্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


নাকছাবি

 

গোধুলির শেষ আলোটুকুও নিভে গেছে। নিভে যাওয়ার পরেও যে অদ্ভুত নরম আলোয় দিকদিগন্ত মায়াময় হয়ে থাকে, তাও আর নেই অন্ধকারে ডুবে গেছে চারপাশ শহরের এই দক্ষিণ দিকটায় ল্যাম্পপোস্ট না থাকায় অন্ধকারেই ডুবে থাকেএখানে ছুটন্ত গাড়ির হেডলাইট বা চাঁদের আলোই ভরসা। তবে অন্ধকারের নিজস্ব এক রকম আলোর আভা আছে যাতে আস্তে আস্তে চোখ সয়ে আসেতাছাড়া মানুষজনও এদিকে খুব একটা আসে নাএটি শহরের একেবারে শেষ সীমানা এর পরেই শুরু হয়েছে নিচু জলাভূমি।

আর পাশেই আছে একটি ভাঙ্গা পুরনো জমিদার বাড়ির ভগ্নাংশ যা গাছপালা আর সাপখোপের অভয়ারণ্য। ঝোপঝাড়, জঙ্গল, বাদুর, চামচিকা, বিভিন্ন পাখিতে ভরা ভাঙ্গা বাড়িটা এদিকটায় খুব কম মানুষ আসে। সামনের রাস্তা দিয়ে শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটে যায় মাঝে মাঝে শর্টকাট করতে ২/৪ জন মানুষ এদিক দিয়ে চলাফেরা করেতাছাড়া এই ভাঙ্গা বাড়ির ভেতরে চলে নানা রকম অসামাজিক কর্মকান্ডযত চোর, সন্ত্রাসী, নেশাখোরদের আস্তানা এখানেকাজেই পারতপক্ষে মানুষ এই দিকটা এড়িয়েই চলে

চাকু রাসেল বসে আছে রাস্তার পাশে, রাস্তার ভাঙ্গন রোধের জন্য যে প্রাচীর দেয়া আছে তার উপর পা ঝুলিয়ে

ওরা দুজন বসেছিল, একটু আগে কানা জুয়েল উঠে গেছে ফেন্সি আনার জন্যকানা জুয়েলের জন্য অপেক্ষা করছে চাকু রাসেল।

চাকু রাসেল সন্ত্রাসী জগতে এক জখমি নাম চাকু চালাতে সে এতই দক্ষ আর পটু যে তার নামই হয়ে গেছে চাকু রাসেল সে এতদিন ঢাকায় ছিলসেখানে হেন কাজ নেই রাসেল করেনিজানোয়ারের মত দুঃসাহস, তীক্ষ্ণতা, আর বিবেক বর্জিত হওয়ায় রাসেল বড় বড় পাতি গডফাদারের কাছে পরিচিত ছিল। কিছুটা স্নেহের আশ্রয়েও ছিলকিন্তু কিছুদিন হ, একটা কাজে কিছুটা বেকায়দা করার ফলে ওকে   আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে বলে দিয়েছে ওর ফাদারেরাআপাতত ও দেশের বাড়িতে এসে আছে। কাজ না থাকায় বসে থাকতে থাকতে হাতে একদম টাকা পয়সাও নে সঞ্চিত যা ছিল সব শেষ।

খাওয়া দাওয়া বাড়িতেই হচ্ছে কিন্তু আসল জিনিস কেনার পয়সা নেই। আসল জিনিস ছাড়া একদন্ডও চলে নাওর সাগরেদ কানা জুয়েল কিছু কিছু যোগানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সেগুলোতে পোষায় না। চাই আরো কড়া, আসল মাল - হিরুঞ্চি।

শালা হারামজাদা মুরগি খবির, মুরগি বেচা কেনার আড়ালে হেরোইনের ব্যবসা করে, আজকাল পুরো দাম ছাড়া একটা পুরিয়াও দিতে চায় না

অথচ আগে, মাগনায় রাসেলকে ডাইল, পুরিয়া, হিরুঞ্চি, গাঁজা, ইয়াবা এমনকি তাজা মাইয়াগুলোকে দিতে পারলে এখানকার সবাই ধন্য মনে করত নিজেকে  সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা হত কে সেরা জিনিস রাসেলকে ডেলিভারি দিতে পারবে।

দিন পালটে গেছেআর শালার হচ্ছে এক মোবাইল, মুহূর্তের মধ্যে সব খবর সব  জায়গামত পৌঁছে যায় রাসেলের যে এখন দিননে, তা সবার জানা হয়ে গেছে  সেই সুযোগ নিচ্ছে খবির, শালার গর্দান বেড়েছে, রুলটানা খাতার মত ঘাড়ের ভাঁজ থেকে উঁকি মারে চকচকে চেইন আর ফকফকে পাউডার। দিন আসুক, গর্দানকে দেখে নেব। চুতমারানি শালা।

রাগে, দুঃখে, হতাশায় নেশার জিনিসের অভাবে এবং আরো কিছু শারীরিক চাহিদায় রাসেল একেবারে নেড়িকুত্তা হয়ে উঠেছে এখানে বাল, সব ধরনের মাল পাওয়াও যায় না! যত সুপার মাল সব ঢাকায় পাওয়া যায়। এক ইয়ায়াবাই পাওয়া যায় তিন  ধরনেরনিজ নিজ পকেট বুঝে সুবিধা মত যার যারটা নিয়ে নেয়এক নম্বর ইয়াবার রঙ হয় সবুজ বা গোলাপিনেশা হয় ভাল, দামও বেশী। মাঝারি আছে,  আবার তিন নম্বরেরও আছে।

তার উপর গতকাল মার সাথে হয়ে গেছে একচোট একেবারে নিরুপায় হয়েই রাসেল বলেছিল-

-মা আমাকে কিছু টাকা দাও না! যদিও সে জানে মার হাতে একটা ফুটো পয়সাও  থাকে না। নানা ভাবে নানা সংগ্রাম করে কীভাবে কীভাবে যেন এই মহিলা সংসারটাকে ধরে রেখেছে তারপর একেবারে মরিয়া হয়েই সে চেয়েছিল।

মা বলেছিল-

-তুই কি কিছুই জানিস না, সংসার কীভাবে চলে? তোর বনটাকে আমি কীভাবে  খাওয়াচ্ছি, লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে যাচ্ছি, তোর বাবা মরি গেল বিনা চিকিৎসায়, কোথায় ছিলি তুই? এতগুলো বছর আমরা খেয়ে, না খেয়ে, বেঁচে আছি না মরে গেছি, খোঁজ নিছিস? আমি সেলাই করে, এ বাড়ি ও বাড়ি বাচ্চা পড়িয়ে কোন রকমে দিন গুজরান করি আর নবাবজাদা এখন আসছে টাকা চাইতেএকটা তাম্মার পয়সাও নাই আমার কাছে, থাকলেও তোরে দিতাম না। এখন জানি আমার একটাই মেয়ে, আর কোন সন্তান নাইবিধবা মানুষ মেয়েটাকে নিয়ে আছি, মরি বাঁচি তোর কোন দায় নাইতোর উপর আমার, আমাদের কোন দাবী নাই তুই দূর হয়ে যা এখান থেকে বেমান ছেলে, তোর নাম বলে চাকু রাসেল, আমার ঘেন্না হয় তোর মত ছেলে পেটে ধরছিলাম
তুই মরিস না ক্যান? তোদের কত ছেলেই তো গুলি খেয়ে, বোমা খেয়ে মরে, তুই মরিস না? মানুষ নানা কথা বলে তোকে নিয়ে। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে...

মায়ের প্যানপ্যানানি, তীক্ষ্ণবাক্যবা চলতেই থাকে, থামে নাযদিও এসবের কিছুই ঢোকে না রাসেলের কানে। তার চ্যাতভ্যাত কিছুই নেই। তার এখন একটাই চাওয়া, কিছু টাকা

টাকা ছাড়া কেউই মাল দিচ্ছে নাঅথচ ওই জিনিস ছাড়া ওর চলবে না। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা খাওয়ায় অরুচি, গা ম্যাজম্যাজ, উফ! মাল চাই, মাল

রাসেল আবার খুব অনুরোধের সুরেই বলে,
-
মা কিছু টাকা দাও, ধার হিসেবেই দাও, আমি পরে তোমাকে অনেক গু বেশী ফেরত দেব

রাসেলের মায়ের আর সহ্য হয় না মাথায় আগুন ধরে যায়-

-কুত্তার বাচ্চা, নেশাখোর হারামজাদা তোর টাকায় আমি লাত্থি মারি, থুতু দেই আবার আমাকে অনেক গু বেশী দেবার লোভ দেখাস! তোর ওই নোংরা পয়সা  আমি নিয়েছি কোনদিন? তুই বাইর হ, বাইর হ আমার বাড়ি থেকে!

বহু বছরের রাগ, ঘৃণা, দুঃখ, হতাশায় রাসেলের মা উম্মাদ হয়ে উঠে কী বলে, না বলে, হুঁশ থাকে না উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপতে থাকে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে বুক হাপড়ের মত উঠানামা করে
হাতের কাছে একটা পাখা ছিল তাই দিয়ে মারতে যায় ছেলেকে। পিঠে একটা বাড়ি দেয়ও, আর তখন রাসেল চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়এসব গালি গালাজ,   পাখার মারে রাসেলের কিছুই যায় আসে না, কোন বিকারই থাকে নাকিন্তু হঠা মায়ের মুখের দিকে চোখ পড়তেই রাসেলের মাথায় বিদ্যুত চমকে যায়আরে, তাই ত! এটা নজরে আসেনি!

রাসেল নির্বিকারভাবে মায়ের পাখা ধরা হাতটি ধরে স্থির হয়ে বলে-

-মা, তোমার নাকের ওইটা দাও

প্রথমে মাও কিছুই বোঝে না, রাসেলের চোখের দিকে চেয়ে থাকে, ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে কয়েক সেকেন্ড পর চিৎকার করে উঠে-

-শুয়োরের বাচ্চা, তুই বলিস কী? আমার আছে কী! এটা তোর বাপের দেয়া সর্বশেষ  চিহ্ন, হাজার বিপদেও এটা আগলে রাখছি, কোনভাবেই বিক্রির কথা মনেও আনি নাই, তোর নজর এখন এখানে! এ্যা! ও আল্লাহ!

মায়ের কথা রাসেলের কানে ঢুকলে তো! রাসেল নিজের কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে গেছে, সে আরো ২/১বার মাকে ব্যর্থ অনুরোধ করে...

তারপর দুর্বল মাকে এক হাতে জাপটে ধরে টান মেরে নাক থেকে খুলে নেয় ওর বাবার দেয়া শেষ স্মৃতি সেসবের নামও জানে না ওর কাছে এটা এক টুকরো সোনা, যার বিনিময়ে ও কিছুটা হেরোইন পাবে

স্তম্ভিত অসহায় মায়ের গলার সুর বদলে যায়ওর মা চিৎকার করে পেছন পেছন - রাসেল বাবা ওটা নিস না, ইটা তোর বা আমাক বিয়ার সময় দিছিলওটা নিস না বাবা! রাসেল বাপ, আমার কথা শোন, আমি তোকে কিছু টাকা দিচ্ছি... রা-সে- ল... বা-বা-বা-বা-রে...

কিন্তু রাসেল কি আর আছে? ততক্ষণে সে উধাওরাসেল এসে বসে ওদের বসার আখড়ায়, সেই জমিদার বাড়ির একদম ভিতরে একটা ছোট্ট কামরা আছে যেটি এখনও অক্ষতই আছে। ওরা সবাই ওটা ঝেড়ে মুছে নিয়েছে ওখানেই শোয়, বসে, নানাবিধ কাজ ওখানেই হয়রাসেল এসে দেখে কানা জুয়েল আগে থেকেই বসে আছেরাসেল এসেই হাত বাড়িয়ে বলে-

-এইটা বেইচা মুরগি খবিরের কাছ থেকে জিনিস লইয়া আয়।

জুয়েল বলে যে, আমি খবর লইছি পুলিশের তাড়া খেয়ে মুরগি আপাতত গা ঢাকা দিছে/১ দিন পরে আনবশুনে রাসেলের মাথা আবার নেতিয়ে পড়ে, থুতনি লেগে যায় বুকের সাথে। ওটা অতি সাবধানে পকেটে রেখে দেয়।

হঠা সে সটান শুয়ে পড়েবলে, একটা কিছু লইয়া আয়, আর তো পারছি না!  জুয়েল পকেটে হাত দিয়ে ডাইলের বোতল বের করে দেয়, রাসেল গলায় ঢেলে আহ করে তৃপ্তির শব্দ করে। এভাবেই দিন রাত পার হয়ে যায়

পরদিন সন্ধ্যায় রাসেল বসেছিল প্রাচীরের উপরেজুয়েল গেছে ডাইল আনতে রাসেল অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে

মোবাইলে কথা হয়েছে যে জুয়েল আসছে, কিছু ডাইলের বোতল এবং কিছু অন্য জিনিসও পাওয়া গেছে রাসেল কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠে আহ! কতদিন পর! জম্পেস করে আজ জিনিস খাওয়া যাবে সঙ্গে একটা তাজা মাল পেলে বেশ জমত সেও ম্যালা দিন হয়, তাজা বা প্লাস্টিক কিছুরই গন্ধ নেয়া হয়নি

হঠা একটু দূরে একটা অন্ধকার ছায়ামূর্তি দেখা যায়। রাসেল ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় দুচোখের মাঝে এনে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে ছায়া মূর্তিটি এগিয়ে আসছে

রাসেল ভাবে জুয়েল আসছে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝে, নাহ, তো কানার হাঁটা নয়! তাহলে কে? এই এলাকায় খুব কম মানুষ সন্ধ্যার পর আসে রাসেল চমকে উঠে আরে, তো মাইয়া মানুষের হাঁটা এ সময়, এই এলাকায় মাইয়া মানুষ!

একেবারে কাছে এলে সে বুঝতে পারে হ্যাঁ, খাঁটি মাইয়া মানুষই বটেরাসেল এই  অপ্রত্যাশিত পাওয়ায় যার পর নেই খলবল করে খুশী হয়ে উঠে। ওর জিহ্বা লালায়  ভরে যায়শরীর টানটান হয়ে উঠে। ভাবে, আজ সকালে কার মুখ দেখেছিল!

মনে পড়ল, রাতে তো ঘুম হয় না এপাশ ওপাশ করতেই যায়, সম্ভবত তখন ভোর, পাশ ফিরতে গিয়ে চোখের কোণে দেখেছিল, জায়নামাজে বসা মাকে

মূর্তি যখন রাসেলের সামনে দিয়ে পা করে যাচ্ছিল, চিতা যেমন শিকারের উপর নিঃশব্দে ঝাপিয়ে পড়ে, একেবারে আকস্মিক ও মূর্তির ঘাড়ের উপর লাফ দিয়ে পড়ে  প্রথমেই মুখ চেপে ধরেযাতে সামান্য টুঁ শব্দটিও করতে না পারে

রাস্তার পাশ থেকে একটা ব্যাঙের অন্যরকম আর্তনাদ ভেসে আসে, মনে হয় সাপ ব্যা ধরেছেখন সে এটা ধীরে ধীরে গলাধকরণ করবে মাথার উপর দিয়ে কিছু রাতের পাখি ডানা ঝাপ্টিয়ে উড়ে যায়

রাসেলের শক্তির কাছে ছায়ামূর্তির শক্তি কিছুই না সেটা রাসেল ভাল ভাবেই টের  পায়। খুব সহজেই রাসেল মূর্তিকে নিয়ে ওদের আস্তানায় আসে

ভিতরের ছোট্ট রুমে গিয়ে এক ধাক্কায় মূর্তিকে সে বহু ব্যবহৃত শানের উপর ফেলে দেয়অন্ধকারে, অনুমানে এবং স্পর্শ দিয়ে অভিজ্ঞ রাসেল বুঝতে পারে, এ হচ্ছে প্লাস্টিক

একটা কচি তাজা হলে ভাল হতভাবতে ভাবতে মনে করে, যাক যা পাওয়া গেছে এখন এই যথেষ্ট

রাসেল ফোন করে কানাকে সব জানায়সেও জিজ্ঞে করে-
-ও
স্তাদ, প্লাস্টিক না তাজা?

উত্তরে রাসেল বলে, খানকির পো জলদি আয়া পর, দেরি সহ্য হচ্ছে না ।

কানা খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, আইতাছি, আইতাছি, তয় তোমার কিন্তু সেঞ্চুরি করতে আর অল্প বাকি...

রাসেল ধমকে উঠে, আবে হালায় সব ভুইলা গেছিস, হিসাব পত্তর জানিস? আজই চাকু রাসেলের সেঞ্চুরি হইবপারলে আর একটা ধেনো বোতল আর কিছু খাবার আনিস। সেঞ্চুরি সেলিব্রেট করব

ওদের জগতে কম বয়সী মেয়েরা তাজা ফুল, আর একটু বয়স হলে প্লাস্টিকের ফুলরাসেল ইতিপুর্বে ৯৯টি তাজা বা প্লাস্টিক ফুলের গন্ধ শুকেছে। আজ হলে, তার ১০০ পুরো হবেসেটাই হবে ওর সেঞ্চুরি

এদিকে শানের উপরে, ঝাপসা অন্ধকারে নারী মূর্তিটি একদম নড়াচড়া বন্ধ করে  দিয়েছে ধাক্কার চোটে অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি! কে জানে! রাসেল এগিয়ে গিয়ে ঝাকিয়ে বলে,

ওই খানকি মইরা গেলা নাকি?

মূর্তি নড়াচড়াও করে না, কোন কথাও বলে না। চিৎকারও করে নাঅনেক মাইয়া  চিৎকার করে ফাটাইয়া ফেলায়, মজাই লাগে। অবশ্য চিকারেও মজা, চুপেও মজা।

কিন্তু এ প্লাস্টিক মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। ধুর বাল, অত ভাবার সময় নেই।

শেষ মুহূর্তে, নারীমূর্তি উঠে বসার চেষ্টা করে, হাত-পা দিয়ে ঠেকানোর প্রাণপ চেষ্টা করে।

কিন্তু মহা শক্তিমান চাকু রাসেলের সাথে পেরে উঠবে কে?

ঠার চেষ্টা করাতে রাসেল রেগে গিয়ে অকথ্য গালিগালাজ করে কাজ সেরে উঠে চলে যায় রাসেল, যাবার সময় একবার পেছন ফিরে দেখে, মাগী আবার আঁচল দিয়ে পুরো মুখ পেঁচিয়ে ঢেকে রেখেছে কঠিন এক বিদ্রুপের ভঙ্গি ফোটে রাসেলের  ঠোঁটেসে বিড়বিড় করে বলে, হিজাবওয়ালি আইছে! আশ্চর্য, কাজের সময় মাগী সামান্য একটু শব্দও করেনি কী জানি, মনে হয় না, জ্ঞান ছিল

রাসেল চলে যায়জুয়েলের একটা থাকার জায়গা আছে, সেখানে ওরা মাঝরাত পর্যন্ত ফুর্তি করে - সেঞ্চুরি উপলক্ষেফোনে সবাইকে জানিয়ে দেয় সেঞ্চুরির কথা সবাই জেনে যায়, আজ চাকু রাসেলের সেঞ্চুরি হল

দুজনই ঘুমুতে যায় শোয়ার পর তৃপ্ত রাসেল বলে, 
-
কানা, কাল এইটা বিক্রি কইরা পুরিয়া আনবি। পুরিয়া ছাড়া আর কিছুতেই চলছে নাকানা উত্তর দেয়, হ আনমু স্তাদ। আজ ঘুমাও

রাসেল পকেটে হাত দিয়ে সেই জিনিসের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করে, কিন্তু টের পায় না। সে ত্বরিত উঠে বসে ভাল করে পকেট হাতরায়, নে এ পকেট ও পকেট - নাহ কোথাও নে

আজব, পকেটেই তো ছিল!তোপুর্বে বার বার পকেটে হাত দিয়ে সে দেখেছে যে ওটা আছেতাছাড়া ওট তো খুব সহজে পড়ে যাওয়ার কথা নয়!

হঠা রাসেলের মনে হয় তাহলে কি, সেই সময় মন্দিরের সেই শানের উপর পড়ে গেছে? চিন্তা করে, হিসেব নিকেশ করে সে নিশ্চিত হয়, হ্যাঁ ঠিক তাই হয়েছে ওই সময় ওখানেই পড়ছে এছাড়া তো পড়ার প্রশ্নই উঠে না!

খুব দ্রুত সে কানাকে নিয়ে মন্দিরে যায়, সেই জায়গায় গিয়ে আতিপাতি করে খোঁজে, নাহ কোত্থাও নেআশ্চর্য, গেল কোথায়? পড়ল কোথায়?

রাসেল আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলে, ওই মঙ্গীই ওটা নিয়ে গেছেশালিরে, এখন পাই কই?

কাল টাকা ছাড়া তো পুরিয়া পাব না! কানা জুয়েল ওকে নানা কথা বলে কয়ে শান্ত  করে আবার ফিরে এসে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে।

তখন পথের কুকুরগুলিও ঘুমিয়ে পড়েছে, জ্যোৎস্না বিলিয়ে ক্লান্ত চাঁদও হেলে  পড়েছে গাড়ি ঘোড়ার শব্দও আর শোনা যায় না রাত গভীর থেকে গভীরতর হয় জগত চলে আপ নিয়মেপৃথিবীও চলে তার কক্ষপথে একই নিয়মে, সঠিক  নিদ্রিষ্ট গতিতে চারপাশ নিস্তব্ধ, নিঝুম।

কোথাও কোন ছন্দপতন নে

জাগতিক নিয়মেই রাত পার হয়ে ভোর হয়। পাখিরা জেগে উঠে। জেগে উঠতে থাকে জগত। চারিদিকে একের পর এক পবিত্র আজানের শব্দ ধ্বনিত হতে থাকে

সেই পবিত্র ভোরে, কাদের যেন আর্তনাদ কানা জুয়েলের দরজায় আছড়ে পড়ে ধাক্কাতে থাকে। অনেকগুলি উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়একেকজন একেক কথা বলে। অতঃপর চাকু রাসেল, কানা জুয়েলের নেশার মরঘুম ভাঙ্গে।

ঘুম ভাঙ্গার পর জানতে পারে গতরাতে রাসেলের মা গলায় ফাঁস নিয়ে মারা গেছে রাসেলের মন বা মস্তিস্কে কিছু কি আদৌ ঢোকে! কানা জুয়েল, রাসেলকে নিয়ে ওর বাড়িতে আসে

বাইরের ছোট্ট উঠানের মত জায়গাটিতে মাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে একটা পুরনো শাড়ি দিয়ে মার শরীর আপাদমস্তক ঢাকা পাড়া প্রতিবেশী সবাই এসেছে, কে একজন বলল, রাসেলের ছোটবোন ঘরের ভিতরে অজ্ঞান হয়ে আছে।

রাসেল এক ঘোরের মধ্যে আছেকী হল, মা এমন কেন করল!

জন্মের পর থেকেই রাসেল দেখেছে আজন্ম এক সংগ্রামী মাকে, কোনদিন ভেঙ্গে পড়েনি, সংসারটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে, দুই ছেলে মেয়েকে মানুষ করতে সারা জীবন টুকটুক করে শব্দহীন লড়াই করে গেছেকী এমন হল যে মা আত্মহত্যা করল!

তাহলে কি নাক থেকে টা নেয়াতে মা এমন করল?

আশ্চর্য, তা কী করে হয়! হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ আঘাত, দুঃখ, অপমান হজম করা মা, এইটার জন্য এমন করবে! কোনো হিসেব মেলাতে পারে না রাসেলএই ঘটনা মায়ের চরিত্রের সাথে ঠিক যায় না

উপস্থিত কে একজন বলল, এই রাসেলকে ওর মায়ের মুখটা দেখিয়ে দাও

পাশের বাসার এক চাচী এসে রাসেলের হাত ধরে মায়ের কাছে এনে বসিয়ে দেয়। আর একজন মায়ের মুখের কাপড় তুলতে থাকেরাসেলের কেমন যেন ভয় করে ওর ছেলেবেলাকার কথা মনে পড়ে যায়দরিদ্র বাবা মায়ের প্রথম সন্তান ও বাবা, মা খুব আদর করতেন তো আর নেশাখোর বা সন্ত্রাসী হয়েই জন্ম নেয়নিছোটবেলাটা আর দশজনের মতই স্বাভাবিক ছিল, বলা চলে, ভালই ছিল চাচী বলে উঠলেন,
-
বাবা, মায়ের মুখ শেষবারের মত দেখে নাওশুনে সম্বিত ফিরতেই রাসেলের চোখ  ছানাবড়া হয়ে যায়মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। ওর পায়ের নিচে ভূমিকম্প হয় কী! এটা কী! মায়ের মুখের ঠিক মাঝখানে ওটা কী? ওটা কোথা থেকে মায়ের কাছে  এলো?  রাসেলের মাথায় ঝড়ের গতিতে হিসেব চলে

ওটা তো কাল মন্দিরের শানের উপরতাহলে সেই নারীমূর্তি কি

মায়ের নাকে চিরদিনের বাবার স্মৃতিচিহ্ন, নাকছাবিটা জ্বলজ্বল করছে

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন