কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

হে নেপথ্যচারিণী




 (৫)  

 

অর্থাপত্তি

 

শহরের ঘুম ভাঙলে লালবাজার চত্বর যেন আরও নজরদারি হয়ে ওঠে। সেখানে আনাচেকানাচে কর্মব্যস্ততা। স্টিফেন হাউজের পিছনের গলির ফুটপাতে তেরপলে ঘেরা চায়ের দোকানে এক অল্পবয়সী মহিলা দোকানি তার বরের সঙ্গে যন্ত্রের মতো চা বন্টন করছে। সকালে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে এ তল্লাটে। আজকাল বৃষ্টি হয় পাড়ায় পাড়ায়। হয়তো সেই কারণেই চালতাবাগানে অত্রির বাড়িতে থাকতে ভোরসকালে বৃষ্টির আঁচ তেমন পাইনি। এ তল্লাটে গাড়ি পার্ক করা আইনস্টাইনের তত্ত্ব ক্র্যাক করার থেকেও কঠিন কাজ। তাই 'ওলা' করে চলে এসেছি দুজন। গাড়ি পড়ে আছে অত্রিদের বাড়ির সামনেই। আশুদা সেই দোকানির দোকানে দাঁড়িয়ে চা নিল দুই ভাঁড়। তারপর সরে এসে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে বলল।

-মেয়েটার মনে অসম্ভব জোর।

-কার কথা বলছ? সুচন্দ্রার?

-সে তো অবশ্যই। কিন্তু এখন আমি এই কথাটা বললাম ওই চা-দোকানের মেয়েটার কথা ভেবে। নাম সম্ভবত লছমি।

-কী করে বুঝলে? ওহ। নামটা বোধহয় হাতে ট্যাটু করা ছিল। মিস করে গেছি। কী? তাই তো?

-ঠিক তাই। মগজের কোষগুলোকে একটু এইবার খাটাও অর্কবাবু। নাহলে তো ওরা জঙ পড়ে অচল হয়ে যাবে।

আমি মাথা চুলকে বললাম।

-সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মনের জোরের ব্যাপারটা?

আশুদা লালবাজারের গেটের দিকে তাকিয়ে বলল।

-মেয়েটার চোখগুলো হলুদ। পেট সামান্য ফোলা। সম্ভবত অ্যাসাইটিস আছে। হাতে কম্পন ছিল সামান্য। তুই হয়তো খেয়াল করিসনি। আমি দেখেছি। ওই কম্পনে বোঝা যায় মেয়েটার উইলসনস ডিজিজ আছে। আপাতত ওর লিভার জবান দিয়ে দিয়েছে। শরীরে বিলিরুবিন খুব বেশি মাত্রায়।

উইলসন ডিজিজ কাকে বলে আমি জানি। আমাদের শরীরে সামান্য মাত্রায় তামা থাকে। সেই তামা এক কোষ থেকে আরেক কোষে বহন করে নিয়ে যায় 'সেরুলোপ্লাজমিন' নামের এক প্রোটিন। সেই প্রোটিনের তারতম্যে অসাঞ্জস্যতা হলে শরীরের নানান অংশে তামা জমতে থাকে। কখনও কখনও তা স্নায়ুকে আক্রান্ত করলে কাঁপুনি আসে। তবে সবার আগে সেই তামা মানুষের যকৃতকে বিকল করে দেয়। এই রোগ আশুদার দক্ষ চিকিৎসকে ধরা পড়ে যাওয়ার ঘটনা আমার কাছে আশ্চর্যের নয়। কিন্তু সেই তথ্যর সঙ্গে ওই মেয়েটির মনের জোরের সংযোগস্থলটি কোথায়, বারবার মেলাবার চেষ্টা করছিলাম আর বিফল হচ্ছিলাম। তাই সেই কথা আশুদাকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।

-কিন্তু আশুদা? এর সঙ্গে মনের জোরের সংযোগ কোথায় পেলে তুমি?

-পেলাম। খেয়াল করে দেখলাম, মেয়েটি যখন চা-টা দিচ্ছে, প্রথম কিছু মাইক্রোসেকেণ্ড অসুখের প্রভাবে তার আঙুল কেঁপে উঠছে। পরক্ষণেই সচেতনভাবে মেয়েটি তার অসুখের প্রবণতার উর্ধ্বে উঠে ভাঁড় থেকে যাতে চা না পড়ে যায়, সেই কারণে সেই কম্পন থামিয়ে দিচ্ছে। হাত কাঁপছে না আর। এতো স্বল্পসময়ে এইসব ঘটছে যে সাধারণ মানুষ এইসব খেয়ালই করছে না। ঠিক যেমন তুই করিসনি।

আশুদার বকুনি আমার জীবনে যষ্ঠিমধুর মতো। যতো তার প্রহার, ততো দ্রুত তার কার্যকারিতা। মগজকোষ সঞ্চালিত হতেই মিলিয়ে দেখলাম দূর থেকে। সচেতনভাবে দেখতেই আশুদার দেখা পর্যবেক্ষণ হুবহু মিলে গেল। চা শেষ করে আশুদা বলে চলল।

-মানুষের মনের ভিতরটাও ঠিক ওইরকম। তার অবচেতনে যে কম্পন শুরু হয়, তা যদি অস্বস্থিকর বা সামাজিক রীতিবহির্ভূত হয়, তাহলে মনের রক্ষণপ্রক্রিয়া বা ডিফেন্স মেকানিজম, ওই লছমি মেয়েটির মনের জোরের মতোই তাকে তার অজান্তে কয়েক মুহূর্তের ভিতর প্রশমিত করতে পারে। মনকে পড়তে শেখ অর্ক। কে বলে মন নেই। যেমন আমাদের ওই কালার স্ফিয়ারে রঙগুলো। আগে ভাবা হতো রঙ আবার মাপা যায় নাকি! এখন তা যায় কম্পাঙ্কে। ঠিক সেইরকম ব্রেইনম্যাপিং করে একদিন দেখবি কেউ মানুষের মনের আবেগেরও কম্পাঙ্ক কোনও যন্ত্রে ধরে ফেলবে। আপাতত আমাদের কাজ অত্রির অবচেতনের কম্পাঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছোনো।

-যাই বলো আর তাই বলো, অত্রির বৌ সুচন্দ্রাই যদি তোমার বলা সেই ঘটনার  আট বছরের মেয়েটি হয়, তাহলে তার মনের জোরও কিন্তু কম কিছু নয়।

-সে তো অবশ্যই। তবে অনুমানটি ঠিক হলে আমার মন বলছে আট বছর আগেকার সেই ভয়ানক স্মৃতি সুচন্দ্রার অবচেতন লুকিয়ে ফেলেছে।

আমি অবাক হলাম খানিকটা। লালবাজারের গেটের কাছে পৌছে গিয়েছিলাম দুজন। স্মৃতিকে যে লুকিয়ে ফেলা যায় এইভাবে, এমন কথা আমার জানা ছিল না। একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাবলাম এই ফাঁকে আশুদাকে জিজ্ঞেস করে ফেলি।

-তুমি বলেছিলে ষোলো বছর আগে তোমাকে এই লালকাজার ডেকেছিল অলোককৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের রহস্যজনক মৃত্যুরহস্য ভেদ করার জন্য। তুমি বলেছিলে তিনি স্বাভাবিক ভাবে নয়, বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন। তোমার মনে আছে সেই বিষটা কী?

আশুদা ভাবতে থাকে।

-মনে আছে স্পষ্টতই। তবে রহস্যটা পুরোপুরি সমাধান করার আগেই ওরা ফাইলটা বন্ধ করে দিল। তাই ওর শেষ দেখা হল না। তবে এটুকু বের করেই ফেলেছিলাম যে মৃতের শরীরে কনভালশানের পরেও 'স্ট্রিকনিন' বিষের চিহ্ন ছিল।

স্ট্রিকনিন। মানুষের স্নায়ুর ভিতর ঢুকে সেই বিষ মৃগীরোগের পরিস্থিতি ঘটায়। আশুদা বলছিল মৃতর মৃত্যুর সময় কানে ইয়ারফোন লাগানো ছিল। যদি বিষপ্রয়োগের সঙ্গেই কোনও উত্তেজক আওয়াজ কারোকে শোনানো হয়, তাহলে সেই মৃগী হবার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে। সেই সম্ভাবনার কথা আশুদাকে বলতেই তার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল।

-এই তো তোর মগজের কোষ ডানা মেলছে অর্ক। এখন আমার অসমাপ্ত তদন্তে দুটি প্রশ্নর উত্তর আমি আজও পাইনি। প্রথম হল। মানসিক চিকিৎসাধীন অলোককৃষ্ণকে পুলিশের হেফাজতের ভিতরেও স্ট্রিকনিনের মতো বিষ পৌছে দিত কে?

-বিষ হিসেবে নাও পাঠাতে পারে। হয়তো গাছের শিকড় হিসেবে পাঠানো হতো। কোনও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার অজুহাতে।

-ব্রাভো। দারুণ বলেছিস। হতেই পারে। স্ট্রিকনিন খুব বরণীয় বিষ। বিখ্যাত গোয়েন্দাগল্প লেখকদের চোখের মণি। স্ট্রিকনিন থাকে কৃমিকাঠের ভিতর। পোষাকী গাছের নাম তো তুই জানিস।

-নাক্স ভমিকা। তার শুকনো বীজের থেকে এই বিষ তৈরি করা যায়। ১৮১৮ সালে এক ফরাসী বিজ্ঞানী প্রথম এই তথ্য আবিষ্কার করেন।

-ঠিক তাই। এমন হতেই পারে সেই তরল কেউ পৌছে দিত ঘেরাটোপ পেরিয়ে।

-আর তোমার দ্বিতীয় সমাধান না হওয়া প্রশ্ন?

-ইয়ারফোন। কী বাজছিল সেখানে। তখন এটাকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু যদি সত্যিই সেই ফোনে এমন কিছু বাজানো হয়ে থাকে যাতে অলোককৃষ্ণ ভয়ানক আবেকপ্রবণ হয়ে মৃগীগ্রস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে সেদিন কী বাজানো হচ্ছিল, সেটা জানাটা তদন্তের স্বার্থে খুবই জরুরি।

কথা বলতে বলতে আমরা লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে পৌছে গেলাম। সেখানে সর্বানন্দ ঝা তথাগত অধিকারী নামের এক অফিসারকে আমাদের কথা বলে রেখেছিলেন। তথাগতকে দেখে আমার বয়সীই মনে হল। যাওয়ামাত্র আশুদাকে সে রীতিমতো স্যালিউট করে বলল।

-আপনার কথা অনেক শুনেছি আশুদা। সর্বানন্দ স্যার আপনার ওড়িষ্যা সাহেববাঁধের অভিযানের কথা আমাদের প্রায়ই বলতেন। বহুদিনের ইচ্ছে ছিল আপনার সঙ্গে দেখা করব। এতোদিনে আমার সেই ইচ্ছে পূর্ণ হলো।

লালবাজারের পুরু দেওয়ালে পিঠ ঠেঁকে যাওয়া আলমারির ভিতরে ঠেসে রাখা ফাইলে মানুষের মনের কত গোপন প্রবৃত্তি লুকিয়ে রয়েছে ভাবছিলাম। কত ভয়ানক অপরাধী, তার ততোধিক ভয়াবহ অপরাধবোধ সেই ফাইলের আড়ালে ঘাপটি মেরে রয়েছে কে জানে। কোনও মনোবিজ্ঞানী সেই গোপন বোধগুলির খোলস যদি খুলে ফেলতে পারত, তাহলে হয়তো মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের বহু ঘটনার অন্তরালে মিথ হয়ে লুকিয়ে থাকা ম্যাজিকগুলো আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত। তথাগত আমাদের করিডরের ভিতর দিয়ে এক গোপন ঘোরানো সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেল। সেই সিঁড়ি অবগাহনের মতোই আমাদের নিয়ে চলল বেসমেন্টের কাছে। 'ক্লোজড ফাইল সেকশন' এ আপাতত অলোককৃষ্ণ আর স্ত্রীর অকালমৃত্যুর রহস্য মলাটবন্দী হয়ে রয়েছে। আমরা প্রকাণ্ড ঘরের এক আলমারি পেরিয়ে অন্য আলমারির দিকে চলেছি। এক একটা আলমারি এক এক বছরের নথি। কত সহজ হতো মানুষের জীবনও ঠিক এই ঘরটার মতো হলে। সেখানেও যদি সত্যিই এক একটি ফাইল এক একটি বছরের মতো হতো। অবশেষে আমরা ২০০৬ লেখা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তথাগত আমাদের এক্জিবিট আর কেস ফাইল, দুটোই দেখিয়ে চলে গেল। ঘরের এক কোণে একটি স্টাডি টেবিল ও আলো। আমরা ফাইল আর সেই তথ্য প্রমাণ নিয়ে সেখানেই বসলাম। আশুদা ফাইল খুলে অলোককৃষ্ণকে বের করে আনল।

দুই ভারী মলাট খুলতেই একরাশ ধুলো যেন পুঞ্জীভূত অভিমানের মতো আমাদের দুজনকে ঘিরে ধরল। যেন বন্ধ ফাটকের ভিতর থঃকে এতোবছর বাদে কেউ স্বাধীন মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ পেয়ে আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে। ফাইলে শকুন্তলা মুখোপাধ্যায়ের উপর ঘটে যাওয়া ক্রাইমসিনের বর্ণনা ছিল। সে বর্ণনা পড়লে প্রশ্ন ওঠে মানবতা নিয়ে। এতো নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ? কীভাবে পারে! তাঁর অনাবৃত শরীরে পরপর আঠাশবার ছুরিকাঘাত করেছে আততায়ীরা। সেই আঘাতের বেশির ভাগই জঠরে। আশুদা মন দিয়ে সেই পরীক্ষার পর পাওয়া তথ্যগুলি দেখছিল। আমার মনে প্রশ্ন এল। গণধর্ষণ হলে একজন অপরাধীর নাম অভিনন্দন শিকদার। তাকে তার পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী সম্ভবত অলোককৃষ্ণ। কিন্তু দ্বিতীয় জন? তার কোনও উল্লেখ নেই সেখানে। এটা বেশ আশ্চর্য লাগল আমার। তবু সিমেন অ্যানালিসিসের পর পুলিশ নিশ্চিত। শকুন্তলাদেবীর অত্যাচারী একাধিক ছিল। এইসব আশুদা দেখছিল হয়তো। ঝাঁঝরি সরিয়ে মনের ভিতরের অন্দরমহলে উঁকি দিয়ে আলো ফেলে সত্য উদ্ঘাটন করাই তার কাজ। অন্বেষণ নয়। ব্যবচ্ছেদ।

ফাইলের সঙ্গে একটি বাক্সে কিছু এডিডেন্স রাখা ছিল। এইসব এভিডেন্স শুধুই সেই গণধর্ষণের ক্রাইমসিনের নয়। সেখানে অলোককৃষ্ণর মৃত্যু বা অভিনন্দন শিকদারের হত্যার এভিডেন্সও আলাদা করে লেবেল সেঁটে রাখা আছে। আশুদা সেইসব দেখতে দেখতে মুখে শুধুই বলল,"ইন্টারেস্টিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং।" এরপর পকেট থেকে একটা সাদা চিরকুট বের করে বড় করে জিজ্ঞাসার চিহ্ন এঁকে এক দুই করে লিখতে থাকল। বাক্সে একটা কম্পিউটার ফ্লপি আর কয়েকটা হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠিও পাওয়া গেল। আমাকে আশুদা সেগুলোর ছবি তুলে রাখতে বলল। তারপর বাক্স গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শুধু কম্পিউটার ফ্লপি প্যাকেটটা তার হাতে ধরা রইল। কী আছে ওই ফ্লপিত? কোনও ক্রিপ্টোবিম? নাকি ফ্লাডিং। সব রহস্য কী ওখানেই ধরা? কে জানে।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তথাগত অধিকারীর চেম্বারে এসে আশুদা বলল।

-তোমাকে ধন্যবাদের ভাষা নেই।

তথাগত আবার যারপরনাই লজ্জিত হয়ে বলল, "এ আপনি কী বলছেন দাদা। ওই কেসটা 'আনসল্ভড মিস্ট্রি' হিসেবে এখনও আমাদের পড়ানো হয়। তবে নতুন করে ফাইলটা কি ওপেন করব? তাহলে কী অনুসন্ধানের সুবিধা হবে?

আশুদা একটু ভেবে বলল, "ফাইল খুলতে গেলে নির্দিষ্ট একটা এফআইআর বা অভিযোগনামা থাকে। এই ক্ষেত্রে তদন্তটা মনে করো আমি স্বেচ্ছায়ই করছি। অভিযোগ দায়ের করবার কেউ নেই তেমন। সুতরাং টেকনিক্যালি এই ফাইল এখন ওপেন করা যাবে না। তবে কোনও জোরালো সূত্র পেলেই আমি সর্বানন্দকে জানাবো। ফাইল ওপেন করবে তখন।

তথাগত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, "আর? পেলেন কিছু?"

-অনেক কিছু। এই ফাইলগুলো হলো এক একটা না বলা কথার মতো। থিয়েটারের আলোয় এক রঙের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তার পরিপূরক কমপ্লিমেন্টারি রঙের মতো। আরও একটা সাহায্য অবশ্য তোমাকে করতে হবে।

-বলুন না।

-এই ফ্লপিটা একবার কম্পিউটারে চালিয়ে দেখো তো। কী আছে ওতে। কনটেন্ট লেখা নেই কোনও।

তথাগত মাথা চুলকায়। এর সম্ভাব্য কারণ আমি বুঝতে পারি। প্রযুক্তির গতি এই ষোলো বছরে মানুষের চিন্তার গতিকে অতিক্রম করে গেছে। ষোলো বছর আগের ফ্লপি চালানোর মতো যন্ত্র তথাগতর ডেস্কে নেই। কিন্তু সে নিরাশ করল না।

-আমাদের মাদার কম্পিউটার, যেখানে সবরকম তথ্য জমা থাকে, সেখানে ফ্লপি চালাবার ব্যবস্থা আছে। আমি আপনাকে আজ রাতের ভিতরেই জানিয়ে দিচ্ছি ওই ফ্লপিতে কী আছে।

আমরা প্রতিনমস্কার ও নম্বর বিনিময় করে লালবিজার থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়েই মনের রিফ্লেক্সে চোখ চলে গেল চা দোকানের দিকে। লছমি তার ছেলেকে খাওয়াচ্ছে। তার হাত কাঁপছে থরথর করে। এখন তার দোকানে কাস্টোমার নেই। সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর দিকে হাঁটা লাগিয়ে আশুদা বলল, "চল।"

আমি উৎকণ্ঠায় মরি। এই সেন্ট্রাল মেট্রো পেরিয়ে মেডিক্যাল কলেজ আর কলেজস্ট্রিট ঘিরে নাট্যসম্রাজ্ঞী কুসুমকুমারী দাসীর রহস্যমৃত্যু নিয়ে কত কাহিনী লুকিয়ে আছে আমার। ক্রসিং-এর আগে শশার দোকানে দাঁড়িয়ে শশা কিনতে  কিনতে আশুদা বলল, "এখন যা যা বলব, সব শুনতে গেলে তোর মাথা ঠাণ্ডা করতে হবে। আর মাথা ঠাণ্ডা করার ক্ষেত্রে শশার জুড়ি নেই”।

অগত্যা শশা খেতে খেতে আমরা ভারতসভা ভবন আর ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির দিকে চললাম। ভারতসভা হলের দরজা খোলা ছিল। আশুদা সটান আমাকে নিয়ে প্রায় দেড়শো বছর পুরনো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল। দোতলায় সন্ধ্যাবেলার কোনও অনুষ্ঠানের তোড়জোড় করছে। অধিকাংশই ডেকরেটরের লোক। আমাদের তেমন কেউ খেয়াল করল না। হলের এক কোণে দুটো চেয়ার পেতে আশুদা একটায় বসে অন্যটায় আমাকে বসতে বলল। তারপর বলল।

-ঠিক যেমন আলোর উৎস থেকে আলোর প্রতিফলন একটা পথ দিয়ে চিহ্ন রেখে চলে, ঠিক তেমনই অপরাধজগতে এই যে সূত্র থেকে আমরা মূল অপরাধীর কাছে পৌছোব, তার অপরাধবিজ্ঞানের বাহারি নাম 'ট্রেসোলজি'। এখন সবার আগে বলি এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নর উত্তরটি। আমার অনুমান নিরানব্বই শতাংশ সঠিক। সেই অষ্টমবর্ষীয়া, যে তার মাকে ধর্ষিত হতে দেখেছিল, ফাইলে তার নাম সুচন্দ্রা মুখোপাধ্যায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, তখন ওই কেসের তত্ত্বাবধানে যে পুলিশি ডাক্তার ছিলেন, যিনি পরবর্তীতে অলোককৃষ্ণর জেলের ডাক্তারও হন, ও পরবর্তীতে এই ফাইলের মেডিক্যাল এভিডেন্স তৈরি করেন, তার নাম ডাঃ মুরারী পালচৌধুরী। তার বাবার নাম ডাঃ এম আর পাল চৌধুরী। তিনিও একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন।

-বলো কি! ডাঃ মুরারী পালচৌধুরী তো অত্রির বাবা। বেশ ভয়ানক কাকতালীয় ব্যাপার।

-কাকতালীয় হতেও পারে। নাও হতে পারে। সেটা সময় বলবে। এবার এই কেসে কয়েকটা খটকার জায়গায় আসি।

প্রথম। যে চিঠিগুলোর ছবি তোকে তুলতে বললাম, সেগুলো শকুন্তলা দেবীর ধর্ষণের ক্রাইম সিনে পাওয়া গিয়েছিল। চিঠির বয়ান দেখে বোঝা যায়, চিঠিগুলি শকুন্তলাদেবীকেই লেখা। শুধু তাই নয়। সেই চিঠির হাতের লেখা আর অলোককৃষ্ণর জবানবন্দির হাতের লেখা অন্তত গ্রাফোলজি তত্ত্ব মানলে কোনওভাবেই মিলছে না। এর অর্থ, চিঠিগুলি তার স্বামী অলোককৃষ্ণর লেখা নয়। প্রশ্ন আসে স্বাভাবিকভাবেই। তবে কি শকুন্তলা মুখোপাধ্যায়ের কোনও গোপন প্রেমিক ছিল? যে তাকে নিয়মিত চিঠি লিখত? এর ভিতরে শেষ চিঠিটি এসেছে ঘটনার দুদিন আগে। সেই চিঠির সঙ্গে এই ঘটনার কি কোনও যোগ আছে?

দুই। ক্রাইমসিন থেকে পাওয়া ফুটপ্রিন্ট অ্যানালিসিস। যেখানে গণধর্ষণের নিদর্শন স্পষ্ট, সেখানে অন্য ব্যক্তিদের সম্ভাব্য তালিকা নেই কেন? এই ধোঁয়াশা কাটাতে আমি থিয়েটারে ব্যবহার হওয়া গোবো লাগিয়ে দিলাম স্পটে। ফুটপ্রিন্টের সেরামিক মোল্ড নিতে ভোলেনি কলকাতা পুলিশের ফরেন্সিক বিভাগ। এর ভিতর মোল্ড দেখে বোঝা যায় একজন আছে যে ডানপায়ে অতিরিক্ত জোর দিয়ে হাঁটে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

তিন। শকুন্তলাদেবীর দেহ থেকে পাওয়া রক্তের রিপোর্ট। আঠাশবার ছুরিকাঘাত জঠর লক্ষ্য করে হয়েছিল। কেন? প্রমাণ লোপাট করতে? নাকি কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ? কৌতূহল বাড়িয়ে দিল সেই রিপোর্ট। ধর্ষিত হবার সময় শকুন্তলাদেবী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তার জঠরে যে ভ্রুণ ছিল তার প্রমাণ রক্তে 'ওয়াই পেপটাইড'এর অস্তিত্ব। এখন প্রশ্ন। এই ভ্রুণ কার? এখানেই কী রহস্যের জড়?

কথা বলতে বলতে দুপুর গড়িয়ে গেল। অত্রি ফোন করছে বারবার। তার ঘরে দ্বিপ্রাহরিক আয়োজন সম্পূর্ণ। সুচন্দ্রা তাড়া দিচ্ছে। ইলিশ মাছ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আমরা ফিরিঙ্গি কালীমন্দিরে প্রণাম ঠুকে আবার অত্রির চালতাবাগানের পড়ন্ত বনেদি নিবাসের দিকে চললাম। বাসে উঠে আশুদাকে বললাম।

-এখন কী করবে?

-খাবো। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তারপর গল্প শুনব।

-সুচন্দ্রার?

-হ্যাঁ।

-আর তারপর?

-তারপর দুটো কাজ সারতে হবে। দেখি সর্বানন্দকে ফোন করে।

-কী?

-ধর্ষণে মূল অভিযুক্ত অভিনন্দন শিকদার সম্পর্কে আমাদের আরও জানা দরকার। সেটা জানতে আমাদের একবার মহিষাদল যেতে হবে।

-তার বিখ্যাত গায়ক দাদা মনোরঞ্জন শিকদারের বাড়ি। তাই তো?

-দুরন্ত অর্ক। তোর মস্তিষ্ককোষ তো দেখছি তেজস্ক্রিয় হয়ে উঠেছে।

আসলে এতে আমার তেমন কিছু করণীয় নেই। আমি টপ্পা গানের ভক্ত। মনোরঞ্জনবাবু টপ্পাবিশারদ। তার গান প্রায়ই শুনি। গুগুলে তার কথা পড়তে পড়তে জেনেছিলাম তার বাড়ি মহিষাদল। আর তিনি যে অভিনন্দনের বড় ভাই,  একথা তো আশুদা আগেই বলেছিল। অর্থাৎ দুইয়ে দুইয়ে চার। কথা ঘোরাতে বললাম।

-আর?

-আর ক্রাইমসিন। শম্ভুবাবু লেনে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক অলোককৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। ওখানে না গেলে রহস্যের কেন্দ্রে পৌছোন অসম্ভব। এর জন্য সর্বানন্দর সাহায্য দরকার।

-আর ওই ফ্লপি?

-ওটাও জরুরি। তবে ওটা জেনে যাব। তথাগত ছেলেটাকে খুব সিনসিয়ার আর বুদ্ধিদীপ্ত লাগল। ওদের মতো অফিসাররা আজ লালবাজারে আছে বলেই আমাদের কলকাতার পুলিশ এশিয় মহাদেশের স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড। কী বলিস?

-একদম।

কথা বলতে বলতে চালতাবাগান পৌঁছে গেলাম আমরা। লক্ষ্য করলাম আমার পেটের ভিতর ক্ষিদের উৎকণ্ঠা মনের উৎকণ্ঠাকে ছাপিয়ে গেছে ততক্ষণে।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন