একজন মননশীল লেখক অশোক তাঁতী
অশোক তাঁতীকে নিয়ে স্মৃতিকথা কেন লিখতে এলাম? সেকি শুধু আমার ছোট ভায়ের মতো ছিল, একটা সামাজিক সম্পর্ক ছিল বলে? নাকি সম্পাদকের অনুরোধে? সেটা বোঝা যাবে অশোককে নিয়ে কিছু বলার আগে নিজের ও দুর্গাপুরের কিছু কথা বলে নিলে।
আশৈশব আছি দুর্গাপুরে। আমাদের পৈতৃকবাড়ি পূর্ব বর্ধমানে। সেখান থেকে আমার বাবা একসময় একপ্রকার উদ্বাস্তু হয়ে দুর্গাপুরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাঝে কয়েক বছর পারিবারিক কারণে এখানে ছিলাম না। আবার পাকাপাকিভাবে ফিরে আসি ৭৮ সালে। দুর্গাপুর বলতে তখন বুঝতাম স্টিল টাউনশিপের এ-জোন, বি-জোন অঞ্চলটুকুকেই। অন্যরা কে কেমন বুঝতেন টের পাইনি। এখানকার স্থায়ীলোক বলতে পাশাপাশি শ'খানেক গ্রামের মানুষরা। এমনকি বাঁকুড়া জেলার বহু গ্রামকেও বৃহত্তর দুর্গাপুর হিসাবে ধরা যেতে পারে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নৈকট্য, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও ভাষা সাংস্কৃতিক মিলের কথা বিবেচনা করলে। গ্রামগুলোর মানুষগুলো নিজেদের মতো করে সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাবনাচিন্তা এবং অপুষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দুর্বল অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড নিয়ে ছিলেন একপ্রকার। অন্য অন্য এলাকার গ্রামগুলোতেও এমনই ছিল। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগতশিক্ষা তা সে যতই ধর্মাশ্রিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হোক না কেন, সুযোগসন্ধানী, অসৎ, অভিসন্ধিমূলক শিক্ষার কলঙ্কে কলুষিত ছিল না বলেই আমার ধারণা। অবশ্যই আমি কখনো এসব নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করিনি।
আমি দুর্গাপুরে পাকাপাকিভাবে আসার আগেই এ শহর শিল্প-শহর হিসাবে সুপরিচিত হয়ে গেছে। আমার আসার কয়েকবছর পর থেকেই এর আবার ভাঙন-পর্ব শুরু হবে। এর আগে এখানে দীর্ঘ শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। সেই শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ, এর টাউনশিপ এলাকায় ছড়িয়েছে। বাড়ির মহিলারা হাতাখুন্তি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে। রাজনৈতিক চেতনার আপাত পরিবর্তন ও বিস্তার হয়েছে। এসবের ফলে এবং এইসব ঘটনাবলীর দ্বারা জারিত শ্রমিক মানুষগুলোর চিন্তাচেতনা অল্প হলেও, ক্ষণস্থায়ী হলেও আলোড়িত হয়েছে। এ শহরের প্রত্যেকেই শ্রমিক। এ শহরের প্রত্যেকেই উদ্বাস্তু। কলকারখানাগুলো গড়ে ওঠার সময়ে এই এলাকার স্থায়ী বসবাসকারী জনগণও তাদের বাস্তু থেকে উত্খাত হয়েছিলেন। তারাও সে কারণে উদ্বাস্তু ছিলেন। যদিও রাষ্ট্রের চোখে, রাজনীতির কম পাওয়ারের চোখে এরা উদ্বাস্তু হিসাবে বিবেচিত হননি। কোনোরকম সুযোগ সহানুভূতি পাননি।
সে যাইহোক, এইসব বাহ্যিক পরিবর্তনের জেরে এখানে যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের লেখক জীবনেও কমবেশি প্রভাব পড়ল। আমি এই শহরে পাকাপাকিভাবে আসার আগেই নিম-আন্দোলন হয়ে গেছে। মাঠময়দান কারখানা তথা স্বগত সাহিত্য পরিষদ ও পত্রিকার কর্মকাণ্ড সাড়া জাগানোর পালা শেষ করে প্রায় নীরব হয়ে পড়েছে। নাটকের দলগুলো তখনো ছোটো ছোটো গণ্ডির মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো আলোড়ন, পরিবর্তন বা চেতনাই এই শহরের সকাল স্তরের মানুষকে স্পর্শ করেনি। এমনকি এই কারখানা-শ্রমিকদের মনোজগতে ও পারিবারিক চিন্তাচেতনার জগতে প্রভাব বিস্তার করেনি। এসব কথা বলার কারণ অশোক তাঁতীর আসার বেশ কিছুটা আগের দুর্গাপুর কেমন ছিল। পরবর্তীকালের অশোক বা অন্য গদ্য লেখকদের মধ্যে তার কতটা প্রভাব বা উত্তরণ পড়েছে বা আদৌ পড়েনি তার অনুসন্ধান করার অবকাশ তৈরি করা।
আমার ধারণা এইসব প্রভাব, পরিবর্তন সবই ছিল সাময়িক। বিস্তার ছিল কম। গভীরতা ছিল আরও কম। অশোক তাঁর প্রবন্ধ 'শিল্প, কারখানা ও নিমসাহিত্য' প্রবন্ধে সেটা কতটা ধরেছেন তা মিলিয়ে নেবার অপেক্ষা রাখে। সেই সময়ে 'দুনিয়ার মজদূর এক হও' বলে যখন কিছু মানুষ রক্ত পতাকার নিচে সমবেত হতেন, নেতৃত্ব দিতেন তাঁরা সকলেই প্রায় কারখানার শ্রমিক ছিলেন। সে দলে যেমন থাকতেন না সরকারি অফিসের নিচুতলার কর্মীরা তেমনই থাকতেন না অসংগঠিত, পথে ঘাটে কাজ করা শ্রমিকরা । থাকতেন না রিকশাওয়ালা, কাঠ, ঘুঁটে, কয়লা বিক্রেতারা। ডাক পড়ত না এই বৃহত্তর এলাকার গ্রামের কৃষকদের, ভূমিহীন কৃষকদের। অর্থাৎ মজদূর শব্দটিরও অর্থের বিস্তার ঘটেনি। শব্দটি নিজেও নিজেকে ঠিকমতো চিনে ওঠার সুযোগ পায়নি। ইতোমধ্যে কারখানার শ্রমিকদের সুদীর্ঘ, ন্যায্য, ধারাবাহিক লড়াইয়ের ফল স্বরূপ তাদের বেতন কাঠামো, কাজের পরিবেশ, অন্যান্য সামাজিক সুযোগ ও সুরক্ষার ব্যবস্থা সমূহ আদায় হলো। শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান উন্নত হলো। এই উন্নয়ন একদিকে তাদের জীবনযাত্রা সহজ করল, সমৃদ্ধ করার সুযোগ দিল, অন্যদিকে শহরের অন্যান্য মানুষদের থেকে শ্রেণীগতভাবে বিচ্ছিন্ন করেও দিয়েছিল। এইজন্যই এত বড় এক শিল্পময় কর্মযজ্ঞ পঞ্চাশ বছর যেতে না যেতেই ভেঙে পড়তে শুরু করল। এই ভেঙে পড়ায় স্থানীয় অন্যান্য পেশার জনজীবনকে তৎক্ষণাৎ প্রভাবিত করেনি। কর্মরত শ্রমিকদেরও চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে যাওয়ায় তারা গোল্ডেন-হ্যান্ডশেক জাতীয় বিভিন্ন এককালীন সুযোগসুবিধায় ডুবে গেলেন। রাষ্ট্র তথা কর্পোরেট পুঁজি সেই সুযোগে তাদের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিল। যার কুফল ভোগ করছে বর্তমান প্রজন্ম।
অশোক তাঁতীকে লিখতে এসে এইসব কথাবার্তা হয়তো ধান ভাঙার কাজে ফাঁকি দিয়ে শিবের কীর্তন করার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু যেটুকু রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোড়ন একসময় পড়েছিল তা শ্রমিকদের কারখানাভিত্তিক ব্যক্তিগত জীবনকে অতিক্রম করে বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে এসে পৌঁছায়নি। এর আরও একটা বড় কারণ ছিল এইসব মানুষরা কেউই স্থায়ীলোক নন, স্থায়ী হননিও। এ মাটিকে তারা চিনতেন না। চেনার তাগিদও অনুভব করতেন না। পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা বাঙালিদের বাদ দিলেও শ্রমিকদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিলেন অবাঙালি। বলা যায় মিনি ভারত। অতএব একটা মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠতে খানিকটা সময় লাগার কথা। সে সুযোগ এই শহর পেল না। অন্যদিকে সেসময় বাইরে থেকে আসা মানুষেরা শ্রমিকের কাজ পেলেন, আবাস পেলেন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ পেলেন, পরিবারের সকলের চিকিত্সার সুযোগ পেলেন। অথচ এলাকার স্থায়ী মানুষেরা প্রায় সকলেই এসব থেকে বঞ্চিত রইলেন। আজও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের উত্তরসূরিরা অনাহারে বা উন্ছবৃত্তিতে জীবন যাপন করছেন। এটা একটা উদাহরণ মাত্র।
অশোক তাঁতী কাজ করতেন ডিপিএল কারখানায়। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে তিনি একজন ইঞ্জিনিয়র হলেও কর্মক্ষেত্র এবং কাজের চরিত্র অনুযায়ী তিনিও একজন শ্রমিক মাত্র। তাই একজন শ্রমজীবী মানুষ, তিনি যখন একজন সচেতন লেখক তাঁর লেখায় এই পশ্চাতপট কাজ করারই কথা। তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক তথ্য আমার জানা নেই। সহজভাবে জানার উপায়ও ছিল না। বহু রকমের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমি একজন কুয়োর ব্যাঙ আর বহুরকমের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মিতভাষি, লাজুক স্বভাবের অশোক ছিলেন গণ্ডির মধ্যে। দুর্গাপুরে এবং বৃহত্তর দুর্গাপুরে যে হাজার একটা সাহিত্য কেন্দ্রিক ছোটো বড় অনুষ্ঠান হয় সারাবছরে, সেখানে সাংঠনিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে অশোককে প্রায়ই দেখতে পেতাম না। অন্তত ওর উপস্থিতি আমার চোখে পড়ত না। 'আরবিকা' বলে একটি সংগঠনের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। যেটুকু মেলামেশা সেইটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কখনোই তিনি উচ্চকিত ছিলেন না। তাঁর উপস্থিতি তাঁর সংস্থার আয়োজিত অনুষ্ঠানেও তেমন উপলব্ধি করা যেত না। অন্তত আমরা যারা বাইরে থেকে দর্শক শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত থাকতাম।
অশোক তাঁর এইসব খামতি পূরণ করে নিয়েছিলেন তাঁর লেখালেখির মধ্যে। লেখালেখির সেই ফসলগুলোর দিকেও অপরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা বা রুচি তাঁর তেমন ছিল না। আচরণে ফলাও ছিল না কখনো। অথচ তাঁর লেখালেখি নিয়ে যে আমরা ওয়াকিবহাল নই এ নিয়ে তাঁর অভিমান একবার তিনি কথাপ্রসঙ্গে আমার কাছে মৃদুভাবে ব্যক্ত করেছিলেন। বছর ২৫/৩০ আগের কথা বলছি, নিমসাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তি, প্রখ্যাত গদ্য সাহিত্যিক বিমান চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে একসময় কিছুদিনের জন্য একটা সাহিত্য মজলিস বসত। নাম দিয়েছিলেন - মসিঘর। বারদুয়েক সে সভায় আমি গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম পরিচয় অশোক তাঁতীর সঙ্গে। তখন তাঁর বয়স আনুমানিক ২০/২১। পার্থজিৎ ভক্ত, কিছুটা বড় বয়সে, দুজনে একসঙ্গে আসতেন। পার্থজিতের সঙ্গে আমার আগে থাকতেই আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই মসিঘরে অশোক একটা গল্প পড়লেন। গল্পের নাম রিফিউজি। আমি আর প্রদীপ দাস উপস্থিত ছিলাম সেখানে। দুর্গাপুরে তখন আমাদের পত্রিকা ঝিল্লি নিয়মিত বার হতো। আমরা ঝিল্লির জন্য গল্পটা চাইলাম। দেবেন কী দেবেন না তা তিনি পরিষ্কার বললেন না। কিন্তু হাবভাবে বুঝলাম গল্পটা তিনি ঝিল্লিতে দিতে চান না। কোনো বড় পত্রিকায় দিতে চান। সে চাওয়ায় কোনো অন্যায় ছিল না। যাইহোক, পরবর্তীকালে বেশ কয়েক বছর পরে ১৪০১ সালের ঝিল্লির শারদ সংখ্যায় আমরা সে গল্পটা ছাপলাম।
সেই বয়সের এক যুবকের লেখায় শুরুতেই দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট দেখা গেল। শুরুর কয়েকটা লাইন এরকম -
"রোদের
তাপ এখন ক্ষুধার্ত বনবেড়ালের চোখ।
অনেকদিন
ঠাণ্ডা থাকার পর ক্ষেপার মতো নিজেকেই তাড়া করে ফিরছে। ধুঁকতে থাকা রাস্তার কুকুরটা
ছায়ার পিছনে ছুটন্ত।
মাটি
থেকে ছায়া তুলে নিয়ে গাছেরা গুটিয়ে রেখেছে পাতার ঠিক নিচটাতে।
রাস্তার একমাত্র সাইকেলটা ধুঁকতে ধুঁকতে গোঁয়াচ্ছে।"
এই সাইকেলের সওয়ারি রতন। বুড়ো বাবা আর নাবালিকা স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। মাথার উপর একটা আস্তানা নেই। বুড়োবাবাকে রাখা আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকার জন্য সামান্য একটু ছাদ দরকার। ভোটের আগে পার্টির হয়ে অনেক কাজ করেছে। পার্টির আশ্বাস ছিল ঘর করার জন্য একটুকরো জমি সে পাবে। কিন্তু ভোট মিটে যাবার পর সে তা পায় না। কেউ তার আবেদন কানেও তোলে না। আজ নয় কাল, কাল নয় পরে, এই করে করে বার বার ঘোরায়। এরপর -
"একদিন সে রেগে চিত্কার করে, কাজ করিয়ে নেবার সময় রতন, ভালো করে চুন লাগা, রতন আজ রাতে দুশো পোস্টার সাঁটাতে হবে কিন্তু । আর কাজ শেষ হয়ে গেলে আমাদের ঘোরানো। আমরা কি মানুষ না? আমাদের পেটটা পেট না? পা’টা পা নয়?
সেদিন পার্টি অফিসে খোদ মেয়র উপস্থিত। তিনি সব শুনে জিজ্ঞেস করেন, - তোমরা কি রিফিউজি? রিফিউজিদের জন্য শহীদ প্রফুল্ল চাকী কলোনিতে জায়গা দেওয়া হবে ঠিক হয়েছে।
রতন
বুঝতে না পেরে বলল- রিফুজি কী?
-
রিফিউজি মানে উদ্বাস্তু। তোমরা জমি, বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছ?
রতন
বলল- হ্যাঁ, আমরা তাই।
-
তোমাদের কাছে রিফিউজি সার্টিফিকেট আছে?
-
না, ওসব কিছু নেই।
তাহলে
কীভাবে দেওয়া সম্ভব? আচ্ছা, তোমার কোন জেলা?
পাবনা, বগুড়া, খুলনা?
-
আমারা বাবু মেদনীপুর।
-
মেদিনীপুর? তাহলে তো তুমি রিফিউজি হতে পারো না। মেদিনীপুর তো আমাদের দেশ।
-
তোমাদের তো আজব নিয়ম! পাবনা বগুড়া রিফুজি হতে পারে, মেদিনীপুর পারে না?
রতন
জায়গা পায় না।"
রিফিউজি কনসেপ্টটিকে সেদিন সে যেভাবে ধাক্কা মেরেছিল সে ধাক্কা আজও এক অনিবার্য প্রশ্ন তোলে। সেই প্রশ্নের চোরা স্রোতের ধাক্কায় সরকার পড়ে যায়। অথচ সরকার, প্রসাশন, পার্টি কারো কাছেই আজও এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। অথচ প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যেতেও পারে না। তাই ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে এখন দেশীয় গৃহহীনদের জন্য বাড়ি করার টাকা জায়গা সরকার দিতে বাধ্য হচ্ছে। শত অস্বচ্ছতা নিয়েও সম্মুখীন হতে হচ্ছে সে প্রশ্নের। সেদিনের রিফিউজিরা আজ স্থায়ী নাগরিক। ঘরবাড়ি,গাড়ি, শিক্ষা, চাকরি সবই তারা পেয়েছে। অথচ দেশেরই স্থায়ী ভূমিহীন, গৃহহীনরা আজও (কোথাও, কখনো সামান্য দয়ার দান পেলেও) নাগরিকের পূর্ণ অধিকার পায়নি। জঙ্গল থেকে বনবাসীদের উত্খাত করে তাদের জঙ্গলের অধিকার হরণ করা হচ্ছে।
অশোকের একটি গল্প সংকলন 'ঝড় ও ষাঁড়'। সে বইটি আমার সংগ্রহে ছিল। বেশ কিছুদিন সেটি আমার কাছে নেই। হয়তো পড়বার জন্য কেউ নিয়েছিলেন। তাঁর বই ও লেখালেখি স্থানীয়ভাবে পাওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিল। কোন কোন পত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প বা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে সেগুলোর খবর সে ফেসবুক পোস্টে দিত কিন্তু সেগুলো স্থানীয় দোকানে পাওয়া যেত না। যায় না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহু পত্রিকাতে বহু লেখা ছাপা হতো, সেসব সংগ্রহ করা ব্যক্তিগতভাবে সবসময় সম্ভব হয় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে গদ্যচর্চা করি না। আমার মেধাগত সামর্থ ততদূর নয়। যাঁরা গদ্য চর্চা করেন তাদের সংগ্রহে নিশ্চয়ই অশোকের সব কাজ না হলেও, কিছু কিছু কাজের নমুনা আছে। তাঁরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ আলোকপাত করতে পারবেন। গুছিয়ে প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতাও আমার নেই। এ লেখা শুধুমাত্র স্মৃতিচারণ।
যতদূর জানি ওর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা তিনটি। 'দ্বিতীয় জীবন', 'দালির বালিঘড়ি' ও 'ভার্চুয়াল পৃথিবী'। তিনটির কোনোটিই বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। তাই সংগ্রহে আসেনি। আমার শহরের লেখকদের বই আমি সংগ্রহ করি সাগ্রহে।
এ ছাড়া অশোক প্রচুর ঝুরোগল্প ও অণুগল্প লিখতেন। তার কিছু কিছু আমি এখানে ওখানে পড়েছি। ফেসবুক পোস্ট থেকেও পড়েছি কখনো কখনো। এখানে তার কিছু নমুনা দিলাম। সেগুলো এরকম -
দীপাবলি
বাবা আজও ফেরেনি।
রেশানের
বিনি পয়সার চাল আর মাঠের নানান শাক খেয়ে তাদের চলে যাচ্ছে। আজ আর আলাদা করে চোদ্দশাক
রান্না হয়নি।
ঘরের
এক কোণে লম্বালম্বি সুতোর টানা উদাস পড়ে আছে। ধুলোতে সুতোর আসল রং বোঝা যায় না। আজকাল
মা অমনি উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যে দেখে সে জানে না। চুলগুলো শনের দড়ি হয়ে
আছে। পোড়েনের বাঁধন ঢিলে। নয়া বাজারের সকাল এখন চুপচাপ, শান্ত। মাকুর খটাখট শব্দ থেমে
গেছে।
লকডাউনের সব্জি
যেমন জানতে পারতাম না সব্জি কখনো এমন সস্তা হতে পারে! কদিন আগে যা চল্লিশ ছিল এখন তা পনেরো কুড়ি। আর এখন পাইকারি বাজার উঠে বাড়ির অনেকটা কাছের মাঠে। বেশী কিনতে হয় তবে দাম অনেক কম, দশেও পাওয়া যাচ্ছে। বউ একটু দূরে বসে ডিরেক্সান দিচ্ছে। গোটা সাড়ে তিন কিলো কুমড়োটা বালতির ডিটারজেন্টের জলে তখন সাঁতার কাটছে।
আহা
কী দৃশ্য! এর পর একে একে আড়াই কেজি পটল, তিনটে এঁচোর, আড়াই কেজি নধর সজনে ডাঁটা, গোটা
পনেরো ঝিঙে, তিনটে তরমুজ ইত্যাদি প্রভৃতির পালা। দশ কেজি আলু এক কোণে তিনদিন পড়ে থাকবে।
হাত না দিলেও চলবে। সব মিলিয়ে বেশ খুশী খুশী পরিবেশ। বউ জিগেস করল, সব একশোতে হয়ে গেল?
আমি
বললাম, মামার বাড়ি!
তবে
একথা শোনার পরেও ঘরে কোনও উত্তেজনা নেই।
শেষ চিঠি
আমাদের কোনো পোষা টিয়াপাখি ছিল না। টিয়ার গল্প লিখে সেই অভাব মিটিয়েছি। আমাদের কোনো পোষা বেড়াল ছিল না। বেড়াল ছিল না তাই বেড়ালের গল্প লিখেছি। তুমি ন’মাসে ছ’মাসে এলে গল্পটা হাতে নিয়ে তোমার পায়ে পায়ে ঘুরেছি। রান্নাঘর থেকে বসার ঘর। বসার ঘর থেকে বিছানা।
বিছানার
ওপর আধপড়া বই, বাসি খবরের কাগজের টুকরো, পেনের ঢাকনা, শীষ ভাঙা পেন্সিল, একপাটি মোজা,
না লেখা গল্পের খসড়া।
-এতো
নোংরা করে থাকো কী করে?
কাঁচুমাচু
মুখে দাঁড়িয়ে থাকলাম। - একটু ওঘরে গিয়ে বসো। এখুনি তো হাঁচি শুরু করবে। পরিষ্কার করে
নি। তারপর...
গল্পের শেষের দিকে বলছেন- একটা জ্যান্ত পাহাড় আর গল্পের পাহাড় কখনো এক হতে পারে না।
অংশু মারা গেছে
অংশু মারা গেছে।
এখন
ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে। আবার এতোটা পরিশ্রম ভেবে খুব বিরক্ত লাগল।
গত
কয়েক মাস অংশু ঘরে একাই ছিল। অংশুকে কারো কোনও প্রয়োজন হয় নি। অংশুর কাউকে প্রয়োজন
হয়েছে কিনা সেটাও জানা নেই।
......
অংশুকে
কীভাবে আমরা মুছে ফেলি অত্যন্ত অল্প কথায় নির্মোহভাবে লিখেছেন ....
ঘরে
ঝাড়ু লাগাই। ধুলো পরিষ্কার করি। কিছু মাকড়সার জাল। সারা ঘরে শুধু অংশুর গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তার জীবন তাকে ঘিরে এখানেই ছিল। শরীর থেকে কিছু ধুলো খসে হাওয়াতে ভেসে বেড়াচ্ছে এখনও।
জীবনটা গেলেও ধুলোগুলো থেকে গেছে এখনও। ঘরে ফিনাইল ছিটিয়ে দিই। অংশুর গন্ধ ছেড়ে হাওয়াতে
ফিনাইলের গন্ধ ম ম করে।
শরীর
গেলেও বিছানার তোষকের ওপর অংশুর শরীরের বায়বীয় ছাপ থেকে গেছে। বিছানার চাদর পাল্টে
নতুন ধবধবে একটা চাদর পাতলে সব নতুন। হাওয়ায়, ঘরে বা বিছানায় অংশু বলে কারো কোনো অস্ত্বিত্ব
থাকে না।
কাজল সেন সম্পাদিত ‘ঝুরোগল্প দ্বিতীয় পর্যায়’ ২৮ জনের ১৪০টি গল্পের মধ্যে অন্য ২৭ জনের সঙ্গে ছিলেন অশোক তাঁতী।
‘কালিমাটি’
পত্রিকার ১০৬ ভূত সংখ্যায় রয়েছে অশোকের প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন কাজল সেন ও সাধন চট্টোপাধ্যায়।
আরও
বিভিন্ন সংকলনে অশোক হাজির থাকতেন তাঁর কলম নিয়ে।
এছাড়াও
অণুগল্প নামেও তাঁর ছোটো ছোটো গল্প ছিল। ঘর সিরিজের কয়েকটি গল্প পড়েছিলাম।
'দালির ঘড়ি' উপন্যাসের অংশ বিশেষ অশোক কোথাও লিখেছিল। পড়েছিলাম। আমার কাছে ওর কাজ নিয়ে কেউ খোঁজ রাখে না বলে যখন অভিমান করেছিলেন তখন এই অংশটুকু কীভাবে যেন আমার নজরে আসে। লিখে রেখেছিলাম মেলবডিতে ড্রাফট করে। সেখান থেকে সামান্য কিছু অংশ তুলে ধরছি, উপন্যাসের ভাষায় চলন কেমন ছিল তা বুঝতে হয়তো সাহায্য করবে। যাদের কাছে সম্পূর্ণ উপন্যাসটি আছে তারা সম্পূর্ণ ছবিটা দিতে পারবেন। সে অংশটুকু এরকম -
উপন্যাস
'দালির বালিঘড়ি' থেকে অংশবিশেষ-
“অন্ধকার হলেই তার মনে হয় কাকতাড়ুয়া, ছুটন্ত ট্রেনের পাশে জ্যোৎস্নামাখা পার্থেনিয়াম, দেওয়াল লিখনের সময় তুলির নীচ থেকে লাল রক্ত ঝরা, বারান্দায় লোকটার গোঙানির আওয়াজ, ভয়। নিজেকে এই অন্ধকারে অসহায় মনে হয়। রাগে সে ডিব্বার অর্ধেক তেল ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মেট্রোর টিনে ভর দেওয়া মানুষটার মতো অন্ধকারের চৌহদ্দির মধ্যে যেন সে আটকে গেছে। আগুন চাই, আগুন। আলো চাই। সে বিড়বিড় করে – খতম করতে হবে সব কটাকে। কালো আর রক্ত সব একসাথে মিলে মিশে যায়। কেরোসিন মেশে মাটিতে রাখা জামা কাপড়ে, চালের বস্তায়, বিছানার পায়াতে।
অন্ধকার
ছাড়া শরীরের বাইরে আরো কত কি যে থাকে! যা তৈরি হয় অভ্যাসে, যন্ত্রণায়, চর্চায়, ব্যবহারে।
সেটাই অস্তিত্ব। এটা ভাবলে কষ্ট হয়। অদ্বই ভাবে সারা জীবন হামা টেনেই গেল। সারা জীবন
ভয়, তাড়া খাওয়া। শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে কাউকে ভয় দেখাতে পারল না। এই ভেবে রাগ হয়।
পা দিয়ে কেরোসিনের টিনে ধাক্কা দেয়। কেরোসিন গড়িয়ে চলে মরুভুমি পর্যন্ত। তন্দ্রা একটা
দেশলাইকাঠি জ্বালাতেই একটা ধোঁয়াশাভরা উপকথার জন্ম হয়। যে উপকথা বিস্মৃতির পোঁতায় চাপা
থাকে কবরের মতো।
দালি
ভাবে একদিন আঁকিয়েদের একনায়কতন্ত্র চালু হবে। তাই তুলিটাকে তরোয়ালের মতো তুলে নিয়ে
ক্যানভাসে টানে এক আঁচড়। আকাশের দিকে উড়ে যায় ক্ষেপণাস্ত্র। তার পেছনের আগুনে ক্যানভাসে
দাউদাউ আগুন। সব পুড়তে থাকে। পুড়তে থাকে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতে আসা তার মা। যে জন্মদাত্রীর
শরীর বা শারীরিক আভার অস্তিত্ব, কোনোটাই সে অনুভব করতে পারেনি। চারদিক থেকে বাতাস বইছে।
বাঁচার জন্যে হাওয়া দরকার, দরকার আগুন জ্বালার জন্যেও। হাওয়া পেলে কালোরক্ত পলাশের
মতো আগুনরাঙা হয়ে ওঠে। হাওয়ার মধ্যে মায়ের বুক আর কাঁধ দুবার লাফিয়ে ওঠে। গলে গলে পড়ে
অ্যালুমিনিয়াম ক্যানভাস। মায়ের শরীর থেকে সে কুমারী গন্ধ পায়। গলতে গলতে আকাশপ্রদীপের
মতো আগুন উঠে যায় নীল আকাশে, তারাদের কাছাকাছি। অনেকটা পুড়ে যাবার পরও মায়ের মুখে স্মিত
হাসি। তার অস্ত্বিত্বহীন, আধাশতাব্দীর পরিচয়হীন, স্নেহ ভালবাসাহীন মায়ের গন্ধে বাতাস
ভারী হয়ে ওঠে। মায়ের শরীরের কুমারী গন্ধ ঢাকা পড়ে যায়। দালি হাত বাড়িয়ে ধরতে যায়।
মেয়েলি
গলায় কেউ চেঁচিয়ে ওঠে – ধরিস না, নিখোঁজ হবার চেয়ে মারা যাওয়া ভালো”।
[চন্দ্রগ্রহণ
পত্রিকাতে প্রকাশিত উপন্যাস ‘দালির বালিঘড়ি’ থেকে]
একজন লেখক শুধু নিজের লেখা এবং পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলে একজন দায়িত্বশীল লেখক হিসাবে আমি তাকে অতটা উঁচু নজরে দেখি না। অন্যদের, বিশেষত অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের উত্সাহ দেওয়া একজন সিনিয়ার লেখকের কর্তব্য বলে মনে করি। অশোক এই দায়িত্ব পালন করতেন তার কিছু কিছু প্রমাণ পেয়েছি তাঁর ফেসবুক ওয়াল থেকে।
মণিশঙ্করের
'কালুডোমের উপাখ্যান'এর উপর নিরপেক্ষ আলোচনা করেছেন।
নিখিল
পান্ডের 'স্বল্প কথার গল্প' বইটি নিয়ে স্বল্প কথায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
সণ্মাত্রানন্দের
'ছায়া চরাচর' বইটির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন- "পদার্থবিদ্যা ও দর্শনকে মিলিয়ে দেবার
চেষ্টার জন্য এই আখ্যানমঞ্জরী অনন্য।"
বিভাস
রায় চৌধুরীর 'ভালবাসার মাটি' কবির লেখা গদ্যের উপর সামান্য হলেও আলোকপাত করেছেন।
নাতিদীর্ঘ
আলোচনা লিখেছেন আফসার আমেদের 'বিবির মিথ্যা তালাক ও তালাকের বিবি এবং হলুদ পাখির কিসসা'
নিয়ে।
নিয়মিত
লেখালেখি করতেন মনকলম, মধ্যবর্তী, কালিকলম, একুশ শতক এসব পত্রিকায়। সব খবর আমি জানি
না।
এছাড়াও অশোকের ফেসবুকে পোস্ট ফলো করে আমি মানুষটির মনোজগতের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। দেখছি কাক নিয়ে অনেক পোস্ট। কাকের প্রতি ঔৎসুক্য বা দুর্বলতা ছিল। কাকের একাধিক ছবি ও ফটোগ্রাফি পোস্ট করেছেন। মরা কাকের ছবিও পোস্ট করেছেন #কাক ১৮তে। নিশ্চয়ই এসবের পিছনে তাঁর কোনো বক্তব্য ছিল। কাক নিয়ে বিভিন্ন জনের লেখার উপর নজর ছিল। #কাক ১৭তে শ্রীরামচরিত মানস, অরণ্য কাণ্ডের তৃতীয় সোপান থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
#
কাক ১৩তে অভিজিত সেনের গল্প কাক। # কাক১১তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অনুবাদ রয়েছে-
"পচা
ডাল,
একটা
কাক,
শরৎকাল"
ইত্যাদি
ইত্যাদি রকমের কাক-প্রসঙ্গ।
দুর্গা
প্রতিমার প্রতিও তাঁর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য বিষয়ের ফটোগ্রাফিতেও আগ্রহ ছিল।
অশোক তাঁতী তাঁর এই লেখালেখি এবং সমৃদ্ধ মনন জগতের জন্য কোথা কোথা থেকে পুরস্কৃত বা সম্বর্দ্ধিত হয়েছেন জানি না। কেবল একটি খবর জানি। সেই সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে 'রাইকমল' পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০১৯এ। অশোক তাঁতীর কাজের মূল্যায়ন সঠিক হাতে সঠিক সময়ে হবে, আশা রাখি।
অত্যন্ত নিরপেক্ষ একটা ভাবনা থেকে সাবলীল একটা লেখা, দিশারীদা শুধু এইজন্যই আপনি অনন্য।
উত্তরমুছুন