কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২

তমাল রায়

 



কারণ, অশোককে একাই পাড়ি দিতে হয় অন্ধকার, মহাশূন্যে

 

“তখন আকাশ জুড়ে বৃষ্টি আসছে। মেঘ ডাকছে। পৃথিবীর নাভির ওপর তখন আমাদের কারো হাত নেই। ছাদের অন্ধকারের বাইরে কেউ জানল না ওর জন্মক্ষণের কথা। জুপিটারকে একা একা পাড়ি দিতে হবে অনেকদূর, অন্ধকারে, মহাশূন্যে। ওকে বৈধতা দেওয়া গেল না। কেউ শুনল না ওর কথ।

শুধু প্যাঁচাটা একবার কর্কশ শব্দে ডেকে উঠল। তারপর উড়ে গেল অন্ধকারের ফাটল বরাবর”।

(প্যাঁচা ও জুপিটার)

জুপিটারই কি ছিল অশোকের লুকনো নাম? যে জন্মাতে চায় অথচ পেরে ওঠে না? লুকনো জন্মদাগ, যেভাবে অনন্ত নক্ষত্রবীথির সাথী হয়েও লুক্কায়িত, আর তাতেই তার সৌরভ, নিদ্রিত ইতিহাস সর্বাঙ্গে মেখে যা পুড়ে ছাই হবে কেবল শেষের সে দিন, পবিত্র অগ্নিতে।

অনেক সময়ই তো এমন হয়, আর তাই শঙখ ঘোষ লিখেছিলেন,

"এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন

শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে!"

অশোক আমার বন্ধু। অশোক তাঁতী। জন্ম ১৯৬৮। আর চলে গেল ২১ এপ্রিল, ২০২১। মাত্র পঞ্চান্নতে যতিচিহ্নে শেষ এই আখ্যান মালার। মেলার মাঠে হঠাৎ করেই মাটি ফুঁড়ে হাজির, কাঁধে মৃদু টোকা। ঘুরে দেখি স্মিত হাসিতে উজ্জ্বল প্রিয় লেখক, যে একই সাথে কবিও। ব্যস্ত সম্পাদক সংগঠক এই আমি তখন  পাঠক ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত। পাশে ওই স্মিত হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে নীরব অশোক। অশোক কিছু বলুন। চুপ কেন?

- আপনাকে দেখছি বন্ধু। কত ব্যস্ত। কত কাজ করছেন। আমার ভালো লাগছে।

- এ আবার এমন কী, সবাই তো করছে।

- তবু আপনি তো আমার বন্ধু। আপনাকেই দেখছি দুচোখ ভরে।

- সে দেখুন, কিছু তো বলুন।

খানিক পর পেছনে তাকিয়ে দেখি অশোক নেই। অশোক কী বলতে চেয়েছিলেন?  বলা হল না তাঁর? না বলা কথা বুকের মধ্যে জমিয়ে অশোক পাড়ি দিলেন  দুর্গাপুর?

“তোর তলপেট উঠছে নামছে। তোর নিঃশ্বাস অন্যরকম। ঘাম শুকনোর সময় এইরকম শ্বাস প্রশ্বাস থাকে না। আমি তবু যেন স্বপ্নের মধ্যে মুছলাম তোর কপালের ঘাম। তাকালাম তোর উজ্জ্বল চোখের দিকে। তোর হাসি দেখে বুঝলাম,  তোর পেটের মধ্যে এক অদ্ভূত আকাশ। একটা লালবিন্দু। এক একটা হৃদস্পন্দনে আমার দমবন্ধ অবস্থা। ভাবলাম আমার তো আনন্দ পাওয়া উচিত। অথচ আনন্দ হচ্ছে না। হাতের তালু কেঁপে উঠছে। তোর মুখ তখনো উজ্জ্বল। বললি, কী হল? জুপিটারকে দেখলি?

জুপিটার তখন একটু একটু করে কক্ষপথ স্থির করে নিতে চাইছে”।

অশোকও কি তবে কক্ষপথ তখনও স্থির করে উঠতে পারেনি? কিছুটা সময়  পেলে পারতো?

উদ্ধৃত অংশগুলিতে জুপিটার এক না হওয়া সন্তান, হয়ত সামাজিক নিয়মে অবৈধ। তাই এই প্রেমজ সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তায় ছেলেটি ও মেয়েটি। কী হবে এই অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ।  শিল্প, সাহিত্যে আগাগোড়া নিমজ্জনের পরেও তো কত শিল্পী বা লেখক সেভাবে তেমন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন না। অশোক কি তেমনই একজন ব্যর্থ স্রষ্টা, যে নিজের ক্ষমতা ও মেধা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হয়েও ঠিক এগোতে পারছিলেন না? কোনো অমোঘ অনিশ্চয়তা তাকে আবৃত করে রেখেছিল? যেমনটা আর্তুর র‍্যাবো! কে তাকে এই অনিশ্চয়তায় আপাদমস্তক মুড়ে রেখেছিল, সে কি মৃত্যু?

অশোক কি জানতে পেরেছিলেন, কিছু দূর থেকে নিয়তি ঠাকরুন হাতছানি দিচ্ছেন প্রতি নিয়ত?

অশোক আমার প্রিয়তম লেখক। কারণ তাঁর সৃষ্টি জুড়ে এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার হাতছানি, আর অদ্ভুত বাক্য নির্মাণ কৌশল। অনেকটা স্ট্রিম অব কনসাশনেসের (পড়ুন আনকনসাশনেস) মতই। অবচেতনের লেখা লিখতে পারা খুব সোজা নয়। আর তাই কি অশোক লিখছেন,

“প্যাঁচা তোর একটুও ভাল লাগে না। অবশ্য এমন উদ্ভট প্রাণীকে ভাল লাগার কোন কারণ খুঁজে পাই না। সামনে দেখেও যে প্রাণী চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তারপর পর্যাপ্ত কারণ ছাড়াই হঠাৎ উড়ে যায় পাশের গাছে। আর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে ঘটনার পেছনের ঘটনাকে”।

কতটা নিবিড় পর্যবেক্ষণে অশোক লক্ষ্য করছেন এই রাতচরা পাখিকে!  অশোকই কি তবে প্যাঁচা? যে ঘটমান বর্তমান থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছেন, এই মর পৃথিবীকে?

“জুপিটারকে একা একা পাড়ি দিতে হবে অনেকদূর, অন্ধকারে, মহাশূন্যে। ওকে বৈধতা দেওয়া গেল না। কেউ শুনল না ওর কথা”।

হয়ত লেখক নির্মিত প্রতিটি চরিত্রই লেখক স্বয়ং। যেমন এই জুপিটার। যেমন এই আখ্যানের জনক অশোক, এক প্রকৃত স্রষ্টা এই কৃত্রিম সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেল, অভিমানের ডানায় ভর করে। কারণ ভালোবাসা পিঁড়ি পেতে রাখেনি এই মর আঙিনায়। বৈধতা দিতে যে বড়ই কৃপণ এই শহুরে আধুনিক আমরা!

তবু অশোক রয়ে গেলেন, অন্ধ চোখ থেকে বধির কানে। কারণ অবচেতনের লেখকের এ ছাড়া আর যে কোনো নিয়তিই থাকে না! 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন