আগাছার দিনলিপি
কিছু একটা সে প্রাণপণে জোড়ার চেষ্টা করছিল কিংবা বলা যায় একটা বিয়োগফল থেকে যোগফলে অথবা যোগাযোগে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছিল। সেটা কী? সাপ, ব্যাঙ, ছেঁড়া রুটির টুকরো, তেলেভাজা, পুলিশ বা চোর অথবা আমজনতা কবিসাহিত্যিক সব যেন মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে, সে আসলে বুঝেই উঠতে পারছিল না।
আসলে ‘সে’ মানে সেয়ানা। দেখেছে তাকে সবাই এই নামেই ডাকে তাই এই নাম বা শব্দটা সে চেনে। ধুলোয় ভরা গোটা শরীরে খোস পাঁচড়া,কাঁধে শতচ্ছিন্ন ঝোলায় ভরা দাঁতভাঙা চিরুণী, ভোঁতা নরুণ, ছেঁড়া কানি, টুকরো করা মাথাভাঙা পুতুল, এমনকি ফেলে দেওয়া শিশি বোতলের অংশ, এসবই সে জুড়তে চেষ্টা করে। যোজন বা যো্জক বলা যায় তাকে। তবে রাজযোটক বলতে যা বোঝায় সেটা তার সাথে ছিল ওপাড়ার নেড়ির।
সেও মাঝে মাঝে এমন অর্থহীন হাসিতে মুখচোখ ভরে ওর দিকে এগিয়ে আসতো, নোংরা ধুলোর শরীরে ঢলঢলে ছেঁড়া সেমিজ ও কাঁধে একটা ততোধিক পুরনো ঝোলা। এক সময় তারা মিলতে মিলতে ও নেড়ির কোনো এক না মেলার দেশে পাড়ি দেয় সেখানেই সে বাড়িটা যেখানে সেয়ানা দেখেছিল শেষবার নেড়িকে। সেই বাড়ির দরজায় সে ‘খোঁজ’ শব্দটা দেওয়ালের গায়ে আটকানো নিয়নের আলোয়, পথের ধারের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ও আবছা দেখতে পায়।
বারবার শুধু এই খোঁজ শব্দটায় এসে সে থমকে দাঁড়ায়। নি’শব্দটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে কিনা সে মাথা ঘামায় না। ভালো করে দেখলে হয়ত একটা আবছা অবয়ব ফুটে ওঠা দেখতে পেত, কিন্তু তার চোখ বারংবার ঐ শব্দটাতেই…
পথের ল্যাম্পপোস্ট, পার্কের রেলিং, বেওয়ারিশ কুকুর, কর্দমাক্ত জলাভূমি আনমনে পেরিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে পথেই বসে প’ড়ে দেওয়ালের গায়ে নোংরা করে ফেলে। পাড়ার ছেলে ছোকরার দল কেউ কেউ ইঁট পাটকেল ছোঁড়ে, কেউ ভয় পায়। কখোনো পুলিশের লাঠি তার এই আবিষ্কারের পথে হঠাৎ বাধা দেয়।
সে এত সবরকম মন খারাপের দঙ্গল পেরিয়ে শুধু দেখে নেড়ির হারিয়ে যাওয়া। একমনে মাথা নেড়ে যেন নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায়। চাপ চাপ অন্ধকার তুলে এনে ছুঁড়ে দেয় ঐ দিকটায় যেখানে তার সবটুকু হিসেব নিকেশ শেষ হয়ে গেছে।
যে পথে জমা জলের ওপর ধুলোর সর সেই পথেই সে শুধু দেখতে পায় একটা বাড়ি কিংবা একটা বন্ধ দরজা। যেখানে খোঁজ থেকে নি’শব্দটা মুছে গিয়েও ফুটি ফুটি হয়ে মিশে আছে।
(শ্রদ্ধেয় অশোক তাঁতীরই গ্রন্থ ‘ঝড় ও ষাঁড়’ থেকে নেওয়া একটি চরিত্র অবলম্বনে লেখা। শুধুমাত্র লেখালেখিই নয়, সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনেক বড় মাপের সম্ভ্রম জাগানো মানুষ। ‘নি-খোঁজ’ নামের আমার একটি কবিতা ভাবনা থেকেই এই লেখাটি তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন