কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২

গীতালি সেন

 





শোক থেকে


আমাদের আরবিকার সদস্য সুলেখক অশোক তাঁতীর স্মৃতিকথা লিখতে হবে এমন কখনও ভাবিনি। আরবিকাতে এসেই তার সাথে পরিচয়। সাহিত্য সংস্থায় আমরা সবাই যেন একটি পরিবারের মত ছিলাম। অশোকের সাথে পরিচিত হবার পর সে তার লেখা ‘ঝড় ও ষাঁড়’ বইটি আমাকে পড়তে দিয়েছিল। বইটি পড়ে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সে কথা তাকে বলেওছিলাম এবং পরেও যেখানেই তার যত লেখা পড়েছি অথবা শুনেছি, সমস্ত লেখাতেই মুন্সীয়ানার ছাপ স্পষ্ট। একটা অভিনব রচনাশৈলী ছিল তার। কোন একটা বক্তব্যকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে থেকে বিভিন্ন দিক থেকে তাকে ফুটিয়ে তোলা, যা অত্যন্ত পরিণত লেখনীর পরিচয় বহন করে। মেয়েকে গল্প বলার জন্য লেখা একটি গল্প একদিন শুনিয়েছিল আরবিকার সাহিত্য আড্ডায়। সে এক গ্রহান্তরের প্রাণীদের গল্প। যাদের লাল চেহারা ছিল, আর লাল খাবারও তারা খেত। এমনভাবে অশোক সেই বিষয়টিকে উপস্থাপনা করেছিল যে, শুধু ছোটরা কেন আমরা বড়রাও সেই গল্পটিকে পুরোমাত্রায় উপভোগ করেছিলাম। গল্পের মধ্যে ঢুকে গিয়ে অনুধাবন করেছিলাম তার কল্পনাশক্তির বহুমাত্রিকতাকে। এমনই ছিল তার গল্পের বুনন।

শুধু লেখাই বা বলি কেন, অশোকের গানও ছিল অনবদ্য। আরবিকাতে প্রতি বছর রবীন্দ্র নজরুল স্মরণে একটি অনুষ্ঠান হয়। তাতে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ একটি দিককে নিয়ে সে সম্পর্কিত বিভিন্ন রচনার সমাহারে একটি আলেখ্য সাজিয়ে আমরা তা পাঠ এবং গানের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করি। সেবছর ‘অতিপ্রাকৃত রবীন্দ্রনাথ ‘ নামে যে আলেখ্যটি উপস্থাপিত হয়েছিল তাতে অশোক পাঠের সাথে সাথে গানও করেছিল। এবং তা সকলেরই ভালো লেগেছিল।

অশোক চলে গেল। রইলো তার স্ত্রী, তার কন্যা। আমাদের অনুষ্ঠানকে প্রতিবার সুন্দর করে তুলত সেই মেয়েটির গান। আমার বাড়িতে যে কোন অনুষ্ঠান ও সাহিত্যসভায় অশোককে পেয়েছি বরাবর। কখনও হয়ত সেভাবে বলতে পরিনি, আবার হয়ত ফোন করে বলেছি – অশোক, আসছ তো? সাথে সাথেই উত্তর - আসছি দিদি। তবে যেদিন নারকোলের সিঙাড়া এনে আমাদের খাইয়েছিল, ভেবেছিলাম দোকানের নামটা ওর কাছে জেনে নেব। তা আর হয়ে উঠল না।

এতদিন ধরে কত কথা, কত আলোচনা, কত লেখা। সে সব ভোলার নয়। এই রবীন্দ্র-আলেখ্যর প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল, অনুষ্ঠানে প্রতি বছর মালা নিয়ে আসত অশোক। কবি-প্রতিকৃতিগুলির জন্য দুটি গোড়মালা এবং সদস্যাদের মাথায় দেবার জন্য ছোটমালা অনেকগুলি। আমরা মালা হাতে পাবার আগে পর্যন্ত  ভাবতাম না, মালা কোথা থেকে আনা হবে বা কে, কখন  আনবে! শুধু জানতাম মালা আসবে এবং আমরা মাথায় লাগাবো। এই কাজটি যেন অশোকের একচেটিয়া দায়িত্ব ছিল। দুবছর আগে যখন ‘অন্ধকারের রবীন্দ্রনাথ’ আলেখ্যটি তৈরী করি এবং সবাই মিলে উপস্থাপনা করি তখন অশোক আমার পাঠ এবং রচনার প্রশংসা করে পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করে। এরপরই দেশে এসে পড়ে কোভিড পরিস্থিতি। ভয়াবহ এই অবস্থার কারণে দীর্ঘদিন আমাদের সাহিত্য  আড্ডা বন্ধ থাকে। এবং এই পরিস্থিতির ভিতরেই আমরা হারিয়ে ফেলি অশোককে। কিন্তু অশোকের সেই ঘোষণাটিই আমার কাছে বড় পুরস্কার হয়ে রইলো। এবারে যখন আলেখ্য রচনা করছি তখন সাহিত্য আড্ডায় পড়ে শোনানোর পর অশোক বলল, দিদি, এভাবেই পুরোটা সংলাপ দিয়ে লিখুন না! সেই অশোকের সাথে আমার শেষ কথা।

‘দিদি’ বলত আমাকে। তাই…


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন