কালিমাটি
অনলাইন / ৯৩
মানুষ তার জন্মগত স্বভাবদোষে সবকিছুরই পরিণতি আশা করে। তা সে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধার্মিক, শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিক্ষা, ব্যক্তিগত ও সামগ্রীক জীবনযাপন, যাইহোক না কেন। অন্যদিকে প্রকৃতি তার সৃষ্টিগত স্বভাবগুণে কোনো পরিণতির ধার ধারে না। প্রতিনিয়ত সে ব্যস্ত থাকে তার সৃষ্টির নিত্যনতুন লীলাখেলায়। কোনো নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছনো মানেই তো সেই সৃষ্টির সম্পূর্ণতা! আর সম্পূর্ণতা মানেই স্থবিরতা। কিন্তু প্রকৃতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট তা নয়। আর এখানেই আসল দ্বন্দ্ব মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বা সৃষ্টির। এবং বিশ্ব সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশেষত কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে, গল্প বা উপন্যাস অথবা উপন্যাসিকা পাঠের পেছনে যে চাহিদাগুলো মূলত সক্রিয় থাকে, তার মধ্যে প্রধান চাহিদা হলো, তারা পাঠশেষে একটা নির্দিষ্ট পরিণতি আশা করে। গল্পের নটে গাছটি না মুড়োনো পর্যন্ত যেন তাদের মন পরিতৃপ্ত হয় না, বরং রসভঙ্গ ঘটে। আর তাই অধিকাংশ লেখকদের তাঁদের পাঠক-পাঠিকাদের এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে, গল্পের বৃত্ত রচনায় মনোযোগী হন। এবং সেই বৃত্তরচনা অর্থাৎ গল্পের উপক্রমণিকা থেকে উপসংহার যে গল্পকার যত নিখুঁত ও নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারেন, তিনি তত পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু গল্প যেহেতু গণিত নয়, তাই কোনো নির্দিষ্ট উত্তর বা পরিণতি তার থাকতে পারে না। সচেতন গল্পকাররা একথা জানেন ও বোঝেন। কিন্তু জনপ্রিয়তা লাভের আশায় অথবা জনপ্রিয়তা হ্রাসের আশঙ্কায় তাঁরা পাঠকদের চাহিদাকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। আসলে সাহিত্যের প্রবাহমান ধারায় গা ভাসানো যতটা নিরাপদ, স্রোতের ধারা অন্য কোনো অভিমুখে বা ‘ডাইমেনশনে’ ঘুরিয়ে দেওয়া ততটাই বিপজ্জনক। এবং সেই প্রয়াস যদি যথার্থই দক্ষতার সঙ্গে যাঁরা করেন বা করেছেন, সমকালীন পাঠক-পাঠিকা তাঁদের বরণ করার জন্য আগ্রহী না হলেও ভবিষ্যতের পাঠক-পাঠিকা যে উন্মুখ থাকবেন, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে।
আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় আমি একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। উদাহরণটা অবশ্য সাহিত্যের গল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও, মূলত চলচ্চিত্রের গল্পের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত। সাহিত্যিক অমলেন্দু চক্রবর্তীর একটি গল্প ‘একদিন প্রতিদিন’ অবলম্বনে মৃণাল সেন পরিচালনা করেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’ চলচ্চিত্র। সেই গল্পে ও চলচ্চিত্রে একটি মেয়ের গল্প বলা হয়েছে, যে মেয়েটি হঠাৎই একদিন প্রতিদিনের মতো অফিস থেকে সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে আসে না। যখন ফিরে আসে, তখন রাত অতিক্রান্ত হয়ে ভোর হয়ে এসেছে। ‘একদিন প্রতিদিন’এর প্রিমিয়ার শো হয়েছিল কলকাতার মেট্রো সিনেমাহলে। মৃণাল সেনের মুখ থেকে শুনেছি, তিনি নিজেও সেদিন মেট্রোতে উপস্থিত ছিলেন। ছবির প্রদর্শন শেষ হতে মেট্রোর লাউঞ্জে একদল দর্শক ঘিরে দাঁড়ান তাঁকে। তাঁর কাছে তাঁদের আবদার ছিল, এভাবে ছবির গল্পটা শেষ কেন হয়েছে? আমরা জানতে চাই, সারারাত মেয়েটি কোথায় ছিল? কী করছিল? উত্তরে মৃণাল সেন বলেছিলেন, মেয়েটি সারারাত কোথায় ছিল, কী করছিল, তা আমিও জানি না। জানার দরকারও নেই। ছবিতে শুধু দেখাতে চেয়েছি, কোনো মেয়ে রাতে ঘরে না ফিরলে তার পরিবারে ও পাড়ায় কী বিপত্তি ঘটে। গল্পটা শুধুমাত্র এইটুকুই।
আসলে মানুষ জন্মগত কারণে, তার জন্মের রহস্য জানতে আগ্রহী হয়েছে তার জন্মমুহূর্ত থেকেই। আবার সেই একই আগ্রহে সে জানতে চেয়েছে প্রাকৃতিক সব রহস্যই। সারাজীবন ধরে তার সেই অন্বেষণ চলে। এবং এভাবেই একে একে অনেক রহস্যেরই সুলুকসন্ধান সে পেয়েও যায়। কিন্তু সেই রহস্যের ভান্ডার এতই বিপুল ও বিশাল যে, জানার থেকে অজানার দাঁড়িপাল্লা সবসময় ভারীই থেকে যায়। এবং যেহেতু সবটুকু জানা সম্ভব হয় না, অনেকটাই অজানা থেকে যায়, সেই অজানার অচেনার পৃষ্ঠভূমিতেই সৃষ্ট হয় সাহিত্যে ও শিল্পকলা।
যেহেতু আমি এখানে সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি, কোনো প্রবন্ধ বা নিবন্ধ নয়, তাই লেখাটি আর বিশদ করারও কোনো উপায় নেই। তবে যে কারণে এই লেখাটির অবতারণা, তার পেছনে একটা উদ্দেশ্যও আছে। আপনারা জানেন যে, কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনের প্রতিটি সংখ্যায় আমরা ‘ঝুরোগল্প’ প্রকাশ করি। শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ‘ঝুরোগল্প’র ফর্ম বা ফরম্যাট সম্পর্কিত ভাবনা ও ধারণা প্রথম আমরাই উপস্থাপন করি। তবে যেহেতু এখনও পর্যন্ত সাহিত্যের অনেক পাঠক-পাঠিকারা ঝুরোগল্প পর্যায়ে বিশদভাবে অবহিত হননি, তাই তাঁরা ঝুরোগল্পকে গুলিয়ে ফেলেন অণুগল্পের সঙ্গে। কিন্তু বলা বাহুল্য, এই দুটি ফরম্যাটের গল্প কখনই এক নয় এবং তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও সম্পূর্ণ আলাদা। আমার উপরোক্ত আলোচনায় ঝুরোগল্পের সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম সংক্ষেপে। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।
সবাইকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2,
Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur
831002, Jharkhand, India.
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন