কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

জহর আলি

 

সমকালীন ছোটগল্প


স্ত্রী’র পত্র – মৃণালকে

 

শ্রীচরণেষু দিদি,

বেশ কিছুদিন থেকেই চিঠিটা লেখার কথা ভাবছি। আর তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা এই চিঠি লেখা যায়! তবে আসল কথায় আসার আগে ভূমিকাটুকু সেরে নিই। ভেবে চিন্তে শ্রীচরণকমলেষুটা বাদ দিলাম। আসলে খুব ভাবতে হয়নি যদিও, ওটা সহজেই এসে গিয়েছিল। ভাবতে হয়েছিল তার পরেরটা নিয়ে। তুমি না আপনি কী লিখি? অনেক ভেবে প্রথমটাই নিলাম। তার একটা কারণ হল দিদিকে আপনি  বললে অনেকটা দূরের মনে হয়, আর তুমি তো আমার অনেক কাছের মানুষ। দ্বিতীয় কারণটা আরো দরকারী। সম্বোধনটা তো ঠিক হয় চেনা জানা দিয়ে। তোমাকে চিনিনা, কেননা কখনও দেখা হয়নি আমাদের, কিন্তু কিছুটা হলেও জানি  মনে হয়। কবে থেকে জানি জানতে চাইছো? তারিখটা মনে নেই, তবে দিনটা ছিল  স্কুলের প্রাইজ দেবার দিন। ক্লাস নাইনে ফার্স্ট হয়ে টেনে উঠে প্রাইজ হিসেবে পেয়েছিলাম রবীন্দ্র রচনাবলীর একখণ্ড। গল্পের বইয়ের পোকা আমি বরাবরই, তাই বাড়ি ফিরেই শেষ না করে থামিনি। ওর মধ্যে অবশ্য অনেকগুলো আগেই পড়া ছিলো। অনেকগুলোই তেমনভাবে বুঝতে পারিনি, হয়তো সেটা বয়সের জন্য। কিন্তু একটা গল্প ছিলো অন্যরকম। ভালোলাগার চেয়েও বেশি লেগেছিলো ধাক্কা। মনে হয়েছিলো এমন মেয়েও হয়! মা, মাসি, দিদি, বৌদি, স্কুলের টিচার চারপাশে অনেক মেয়েই তো সবসময় দেখছি, কিন্তু এমন কাউকে তো দেখিনি! মনে  হয়েছিলো আমার যদি এমন একটা দিদি থাকতো! সেই থেকেই তো তুমি আমার দিদি। কতদিন আর কতরাত যে তোমার সাথে গল্প করে পার করে দিয়েছি! তোমাকেও যে কত রাতে ঘুম থেকে উঠিয়েছি, তা তুমি তো জানোই। এক এক  সময় মনে হয়েছে, দিদি বোধহয় এখন ঘুমোচ্ছে বা অন্য জরুরী কাজে ব্যস্ত আছে,  কেননা অন্য সবার মতো তীর্থ করতে তো তুমি যাওনি। বিরক্ত করা বোধহয় ঠিক হবেনা, কিন্তু অপেক্ষা করার তো আমার উপায় নেই!

পারুলের জন্য কিছু একটা তো করতে হবে তাড়াতাড়ি। পারুলকে মনে আছে তো? সেই যে আমাদের পাশের বাড়ির নিবারণ কাকা যাকে মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে বাড়ির কাজের জন্য নিয়ে এসেছিলেন মাত্র দশ দিন আগে। সুধাকাকিমা তাকে রাখতে রাজী হলেননা, কেননা পারুল বড় বেশি ভাত খায়। একমাস হয়নি তাই  মাইনে দেওয়ার প্রশ্ন নেই, শুধু ফিরে যাওয়ার ভাড়া দিলেই চলবে। গ্রামের অশিক্ষিত  মেয়ে শহর থেকে কী করে একা ফিরে যাবে, সেটা তাকেই ভাবতে হবে। তবে  দয়াপরবশ হয়ে পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছিলেন একটা শর্তে – কাকা তাঁর সুবিধামত  পৌঁছে দিয়ে আসবেন, ততদিন কাজ করতে হবে আর পারুল যেহেতু বেশি ভাত খায়, তাই তাকে কোন মাইনে দেওয়া হবেনা। নিবারণকাকা অবশ্য তাড়াতাড়ি  সময় পেয়ে গেছিলেন, যদিও তার পিছনে পাড়ার দাদাদের চাপ কাজ করেছিল,  সেটা সবাই জানতো। যেটা বাবা ছাড়া আর কেউ জানেনা তা হলো, পারুলকে দাদাদের কাছে যাওয়ার বদবুদ্ধি কে দিয়েছিলো!  

তার পরের ঘটনাটা ভারি মজার।

সুভাষকাকু বাড়ির সবাইকে নিয়ে পূজোর ছুটিতে দিল্লীতে ভাইয়ের বাড়ি যাবার পরের দিনই বন্ধ বাড়ির ভেতর থেকে অনেকগুলো কুকুরের কান্নার আওয়াজ  আসতে লাগলো। পাড়ার সবাই বলাবলি করছিলো, রাস্তার ঘিয়েভাজা কুকুরটা বাচ্চা  দেবার জন্য কখনও বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। সুভাষকাকুরা বুঝতে না পেরে ঘর বন্ধ করে চলে গেছেন। দশদিন ঘর বন্ধ থাকলে বাচ্চাগুলো সহ মা কুকুরটা নিশ্চয়ই মরে যাবে। তোমার সাথে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কেন যেন তোমাকে পেলামনা। হঠাৎ মনে পড়লো বাবার ডায়েরিতে সুভাষকাকুর দিল্লীর বাড়ির ফোন নম্বর লেখা আছে। গতবছর বাবা অফিসের কাজে দিল্লী গিয়েছিলেন, যদি কোনো দরকার হয়। বাবাও ভুলে গিয়েছিলেন। ফোন নম্বরটা হাতে এসে যেতেই আর কি?

তিনদিনের মধ্যেই সুভাষকাকুরা দলবলশুদ্ধ ফিরে এলেন ।স্থানীয় থানা থেকে খবর গিয়েছিল যে বাড়ির দরজা ভেঙ্গে চুরি হয়ে গেছে আর সেই সঙ্গে ছিলো থানাতে খবর না দিয়ে বাড়ি বন্ধ করে যাওয়ার জন্য মৃদু ধমক। বাড়ি ভেঙ্গে চুরি হওয়া, নাকি থানায় খবর না দেওয়া্র জন্য বেশি ভয় পেয়েছিলেন, নাকি ফিরে এসে যখন দেখলেন বাড়ি অক্ষতই আছে আর থানা থেকে কোন ফোন যায়নি, বেশি অবাক হয়েছিলেন তখন, তা অবশ্য জানা যায়নি। যাইহোক কুকুরগুলো তো রক্ষা পেল,  আমি তথৈবচ।

এরপরে যেদিন তোমার সাথে দেখা হলো সেদিন রাগ রাগ মুখ করে বলেছিলে,  বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিস কিন্তু। তুমি নিজের মুখটা দেখতে পাচ্ছিলেনা, আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছিলাম রাগের চেয়ে বেশি ছিল হাসি।

এবারের সমস্যাটা একেবারে অন্যরকম। এবারে আমিই সমস্যা।

তোমার মত আমাকে রূপ দেখে আনা হয়নি। আমাদের দুই পরিবারের পরিচয় অনেক দিনের। আসলে তখনও কলকাতায় পাড়া ব্যাপারটা ছিল। দেখা হলে কথা বলা বা মাঝে মাঝে বাড়িতে যাওয়া আসার রেওয়াজ ছিল। সেই সূত্রেই বিমলদের সাথে আমাদের আলাপ। আমাদের মানে বাড়ির সবা্রই। তখন অবশ্য বিমলদা বলতাম, যদিও বিমলের চেয়ে বিমলের দাদা কমলদার সাথে বেশি দেখা হত। বিমল যেবারে ডাক্তারি পাস করলো আমি সে বছর বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আর কমলদা ততদিনে ইঞ্জিনীয়র হয়ে একবছর চাকরী করে ছেড়ে দিয়েছে নিজে ব্যবসা করবে বলে। কিন্তু ব্যবসায় মন দেবার বদলে অন্য কাজেই ব্যস্ত থাকে। হাওড়ায় যেখানে তার কারখানা, সেখানকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ক্লাব তৈরী করে নাটক করা, বস্তি উন্নয়ন সমিতি তৈরী করে বস্তির বাচ্চাদের পড়ানো, স্বাস্থ্য সচেতন  করা, এতেই তার বেশি সময় চলে যায়।

আমিও কয়েকবার গিয়ে নাটক করে এসেছি। আমাদের পাড়াতেও কমলদার একদল চ্যালা আছে। গতবছর দুর্গা পুজোর আগে উত্তরবঙ্গে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল,  তখন দলবল সমেত কমলদা প্রায় পনেরোদিন ওখানে গিয়ে কাজ করেছিল। আমারও যাবার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু একা একটি মেয়েকে অচেনা পরিবেশ ও  পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে কমলদা রাজী হয়নি। ফিরে আসার পর ওদের অভিজ্ঞতার কথা শোনার পর মনে হয়েছিল কমলদা ঠিকই বলেছিল। কমলদার তুলনায় বিমলদা ছিল অনেক বেশি বাস্তববাদী। পাড়াতে ওর বিশেষ বন্ধু ছিলোনা, কলেজের বন্ধুদের সাথেই বেশি সময় কাটাতো। গান, নাটক, সাহিত্য ইত্যাদিতে বিশেষ আগ্রহ ছিলনা। পাশ করার আগে থেকেই বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছিল। ইন্টার্নশিপ শেষ করে হাউসসার্জনশিপ করতে করতে ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন কলেজ আর হাসপাতালে যোগাযোগ করতে লাগলো। তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম বিমলদা ইংল্যাণ্ড চলে গেছে। বিদেশী ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক পরীক্ষাটা পাশ করে একটা চাকরিও পেয়ে গেছে।

কমলদার সাথে যোগাযোগটা ইতিমধ্যে একসঙ্গে নানারকম কাজ করার সূত্রে আরো বেড়েছে। কমলদার ব্যবসাও নাকি ভালই চলছে, যদিও কমলদা নিজে বেশি সময়  দেয়না। হাওড়ায় কমলদার বস্তির স্কুলে আমারও একটা চাকরি হলো। সেটা হলো  সপ্তাহে একদিন গিয়ে বাচ্চাদের গল্প শোনানো, চাকরিটা অবশ্যই অবৈতনিক। ইতিমধ্যে আমি এম এ-তে ভর্তি হয়েছি। বিমলদার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। মাঝে মধ্যে মাসীমার সাথে দেখা হলে বিমলদার খবর পেতাম।

এইভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল। আমি এম এ পাশ করে গেছি। কোনো স্কুলে চাকরি নেওয়ার কথা ভাবছি। বাংলায় পড়শোনা করলে তখনও চাকরি পাওয়া যেত।

এমন সময়ে একদিন মাসীমা মেসোমশাই আমাদের বাড়িতে এলেন। আমার সেদিন বাচ্চাদের গল্প শোনাতে যাওয়ার দিন, আর এই কাজটা আমার বেশ ভালো লাগছিল, তাই বেশিক্ষণ ওনাদের সাথে বসা হয়নি। কয়েক মিনিট কথা বলেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। রাত্রে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে ওনাদের আসার কারণ শুনলাম।

প্রায় ভুলতে বসা বিমলদা সামনের মাসে এক্স মাসের জন্য ইংল্যান্ড থেকে আসছে।  এখন লন্ডন থেকে দূরে একটা হাসপাতালে চাকরি করছে আর এফ আর সি এস  পরীক্ষা পাশ করে ফেলেছে। বাড়ি আসার উদ্দেশ্য বিয়ে করা আর বউ হিসেবে আমিই নাকি প্রথম পছন্দ।

মা বাবা যথারীতি খুব খুশী। বিয়ের পর মেয়ে ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মত দেশে থাকবে, কোন´মা বাবাই না চায়! বিশেষ করে পরিচিত পরিবারের ডাক্তার ছেলে  যদি জামাই হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কেন জানিনা আমার প্রথমেই কমলদার কথা মনে পড়লো। বিশেষ কোন কারণে মনে এলো তা নয়। প্রথমে শুধু চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসে উঠলো, তারপরে মনে হলো কমলদা তো বড়, ওর বিয়ের কথা না ভেবে মাসীমা মেসোমশাই ছোটর বিয়ের কথা আগে ভাবলেন কেন? পরে বুঝতে পেরেছিলাম কমলদা তো কোনদিনই জোর করে কিছু করার কথা ভাবেনা আর বিমলদা তো তার উল্টো। যা দরকার সেটা চাই-ই, অন্যের কথা ভাবার দরকার নেই। আরো একটা কারণ হয়তো মাসিমা মেসোমশাই-এর মাথায় ছিলো। বিদেশে থাকা ছেলে ওদেশের কাউকে বিয়ে করার বদলে বাড়ির জানাশোনা  মেয়েকে বিয়ে করতে ছেয়েছে, এই সুযোগ ওঁরা হাতছাড়া করতে চাইছিলেননা। তোমাকে সত্যি কথা বলছি দিদি, শোনার পরে প্রথমে আমার কোনরকম অনুভূতিই হয়নি। আবছাভাবে কমলদার কথাই মনে আসছিলো। আমি বিয়ের ব্যাপারে হ্যাঁ বা না কিছুই না বলায় দুবাড়িতেই বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। বিয়ের পর আমাকেও ইংল্যান্ড চলে যেতে হবে। দেড়মাস পরে বিয়ের দিন ঠিক হলো আর দুমাস পরেই আমাকেও যেতে হবে। আমি নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। স্কুলে কমলদার সাথে কয়েকবারই দেখা হয়েছে কিন্তু কেন যেন কমলদার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলামনা। কমলদার চোখে মুখে অন্যরকম কিছু দেখেছিলাম কিনা আজ আর মনে করতে পারছিনা। একদিন শুধু আমার ক্লাস শেষ হওয়ার পরে কমলদার সাথে কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল। বিয়ের ব্যাপারে সোজাসুজি কোন কথা হয়নি তবে ইংল্যান্ড যাওয়া নিয়ে কিছু কথা হলো। আমার কাজটা করার জন্য আমার পরিচিত কাউকে পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলো। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতির কথা বলছিল আর সেই সঙ্গে ইউনিভার্সিটি, বন্ধুবান্ধব এমনকি এই স্কুলটা সব কিছুই বার বার মনে পড়বে এই নিয়েও অনেক কথা হলো সেদিন। কমলদার সাথে কথা হওয়ার পরে বাড়ি ফিরে কেন যেন আমার  মনে হচ্ছিল, বিয়েতে রাজী হয়ে আমি বোধহয় ঠিক করলাম না। পরিচিত পরিবেশ  ছেড়ে আমার বোধহয় ভালো লাগবেনা। বিমলদা তখন প্রায় অচেনা মানুষ, এতদিনের যোগাযোগ না থাকায়। অবাক লেগেছিল, বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও বিমলদা আমাকে একবারও ফোন করেনি।

বিয়ের দশদিন আগে বিমলদা কলকাতা পৌঁছলো। দু বাড়িই বিয়ের শেষসময়ের প্রস্তুতি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমি বিশেষ কিছুই করছিলাম না, যা করার মা বাবাই করছিলো। সত্যি কথা বলছি, আমার আনন্দ তো হচ্ছিলই না বরং একটু ভয় ভয় করছিলো। যদিও জানতাম আর মত পালটানো সম্ভব নয়, তবুও মনের দিক থেকে সায় পাচ্ছিলামনা। ফেরার দুদিন পরে বিমলদা আমাকে ফোন করলো আর বাইরে কোথাও দেখা করতে চাইলো। পরের দিন মেট্রোর সামনে আমাদের দেখা হলো। পার্ক স্ট্রীটের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। আগেও দেখতে সুন্দর ছিল, মনে হল আরও একটু ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে। কেমন আছি, কী করছি গোছের একটা দুটো সাধারণ কথাবার্তার পরে বিমলদা কাজের কথায় এলো। কাজের কথা বলতে আমার ইংল্যান্ড যাওয়ার কথা। যেহেতু পাসপোর্ট করাতে এমনিতে অনেক সময় লাগে তাই বিয়ের সার্টিফিকেট আর ওর ওদেশের থাকার প্রমাণপত্র জমা করলে একমাসের মধ্যেই পাসপোর্ট হয়ে যাবে। আমার দিক থেকে কী কী কাগজপত্র জমা দিতে হবে  সেগুলো তৈরী রাখতে বললো আর ওদেশ সংক্রান্ত কয়েকটা বই আর ট্যুরিস্ট গাইড ধরনের প্রচাররপত্রও দিয়ে দিল। তাতে আমার নাকি যাওয়ার আগেই ওদেশ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়ে থাকবে। এছাড়া যেটা নিয়ে বেশি কথা বললো তা হচ্ছে ওর হাসপাতাল, চাকরির সময় সহ নানারকম নিয়মকানুন আর থাকার ব্যবস্থা।  বিয়ে করে ফিরবে বলে হাসপাতাল থেকে বড় কোয়ার্টার পেয়েছে। দৈনন্দিন কাজের জন্য যা যা দরকার সব কিছুই ব্যবস্থা করে রেখে এসেছে। বাকিটা আমি যাওয়ার  আগেই সেরে ফেলবে। থাকার কথা বলার সময় প্রথমবার আমাদের থাকার ব্যবস্থার কথা বলেছিল। আমি পুরোটাই প্রায় নীরব শ্রোতা, আর অন্যের মতামত নিয়ে ও বিশেষ মাথা ঘামায়না, আগেও জানতাম।

বেশিরভাগ বিয়ের মতই আমার বিয়েটাও নির্বিঘ্নেই হয়ে গেল। দুটো জানাশোনা পরিবারের মধ্যে বিয়ে হলে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা আরোই কমে যায়। বৌভাতের দুদিন পরে আমরা সাতদিনের জন্য দার্জিলিং কালিম্পং ঘুরে এলাম। সব মধুচন্দ্রিমার থেকে এটা বিশেষ আলাদা কিছু ছিলোনা।

ফিরে আসার পর আমার পাসপোর্ট করানো নিয়ে বিমল ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমাকেও দুবার সঙ্গে যেতে হয়ে ছিল। গুছিয়ে কাজ করা ওর বরাবরের স্বভাব। বিদেশে গিয়ে সেটা আরো বেড়েছে দেখলাম। কিছু না করে বসে থাকা, অকারণ গল্প করে সময় নষ্ট করা তার একেবারেই পছন্দ নয়। প্রায় একমাস একসঙ্গে থাকার ফলে মানুষটাকে একটু কাছ থেকে দেখলাম আর খানিকটা চিনলাম। একটু  আত্মকেন্দ্রিক নিশ্চয় কিন্তু স্বার্থপর নয়। যেটা আমার ভালো লাগলোনা সেটা হল মাত্র কয়েক বছরেই দেশের প্রতি টান একেবারেই কমে গেছে। ওর মা বাবা আর আমি ছাড়া কারো সাথেই বিশেষ কথাবার্তা বলতোনা, এমনকি নিজের দাদার সাথেও না। শেষের ক’দিন তো ফিরে যাবার জন্য খুবই ব্যস্ত হচ্ছিল। যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমার পাসপোর্ট না আসায় বেশ চিন্তিত ছিল।তার পর নির্দিষ্ট দিনে বিমল ফিরে গেল।নিজেই অবাক হলাম দেখে যে আমার খুব কষ্ট হয়নি, অবশ্য কয়েকদিন পরেই ওকে মিস করতে শুরু করলাম। পাসপোর্ট না আসায় প্রথম দিকে ভালই লাগছিলো যাতে আরো কিছুদিন এখানে থাকতে পারি। পরে নিজেই পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ধরাধরি করে পাসপোর্ট পাওয়া গেল। তারপর যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হলো। এত বছরের পরিচিত পরিবেশ বিশেষ করে মা বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু নতুন দেশে যাওয়ার ব্যাপারে রোমাঞ্চও ছিল আর ততদিনে বিমলের প্রতি টানটা শুরু হয়েছে বুঝতে পারছিলাম।তারপর একদিন আরো অনেকের মত আমিও দেশ ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।

দু’বছরের বেশি হলো এদেশে এসেছি। অনেক কিছু দেখলাম, কিছুটা জানলাম আর সামান্য হলেও কিছু শিখলাম। বিমলের নতুন চাকরি, বিশেষ কিছু জমাতে পারেনি তাই প্রথম দুবছরে বিশেষ ঘোরা হয়নি। শনি রবিবার আর অন্য ছুটির দিনগুলোয় স্কটল্যাণ্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলশ ছাড়া ইংল্যান্ডের মধ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম।বড় ছুটিগুলোতে বিমল অন্য হাসপাতালে কাজ করতে যেত। এই লো-কামের দৌলতে একটা গাড়িও কেনা হয়ে গেছে। মোটামুটি এই জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম আর বুঝতে পারছিলাম বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে আর বাংলায় এম, এ পাস করে এদেশে সেরকম কোন চাকরি পাওয়া সহজ কথা নয়।এদেশের ভাষায় যাকে বলে গ্লোরিফায়েড হাউস মেড সেভাবেই বোধহয় আমাকে থাকতে হবে নয়তো এদেশে চাকরি পাওয়ার মত কিছু পড়াশোনা করতে হবে। এদিকে বিমলের ইচ্ছে নয় যে আমি চাকরি করি। এভাবেই চলে যাচ্ছিল। গোলমালটা শুরু হলো কলকাতায় আসার পর। চারমাস আগে বিমলের মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা ওভারিয়ান ক্যান্সার সন্দেহ করছিলেন। বিমল কোনরকমে দুসপ্তাহের ছুটি যোগাড় করায় প্রায় আড়াই বছর পরে কলকাতায় ফিরলাম। আরো কিছু পরীক্ষার পর জানা গেল ক্যান্সার নয় তবে টিউমার আছে, অপারেশন করাতে হবে। মাত্র কয়েকদিনের জন্য ছেলে বৌ এসেছে বলে উনি এই সময়ে অপারেশন করাতে রাজি হলেননা। সুতরাং এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিলো না। মায়ের চেয়ে বাবাই বেশি ভয় পেয়েছেন বুঝতে পারছিলাম। আমাদের বাড়িতে  বিশেষ কিছু পাল্টেছে বলে মনে হলোনা। যেটা চোখে পড়ার মত হয়েছে সেটা হলো ওদের একাকীত্ব বোধ। ওদেশে বসে যখন মা বাবার কথা মনে পড়তো তখন ভাবতাম বাড়িতে যদি একটাই মেয়ে থাকে তাহলে তার বিয়ে হয়ে গেলে মা বাবাকে তো একাই থাকতে হয়। এই প্রথমবার বুঝতে পারলাম দেশের মধ্যে বিয়ে হওয়া আর বিয়ের পর বিদেশে চলে যাওয়া্র মধ্যে কত তফাৎ। এবারে আসি কমলদার কথায়। প্রথমদিনে কমলদার সাথে দেখা হয়নি কেননা রাত্রে আমি এবাড়িতে চলে এসেছিলাম। কমলদা একই রকম আছে যদিও কাজের পরিধি তার অনেক বেড়েছে। বলাই বাহুল্য, সেটা ব্যবসা সংক্রান্ত নয়। ব্যবসা যদিও আগের চেয়ে বেড়েছে তবে  সেটা বন্ধুদের কল্যাণে। বাকি দুজন বন্ধু কাম পার্টনার ব্যবসা সামলায় আর কমলদা মনের আনন্দে নিজের কাজ করে বেড়ায়। প্রথমদিনেই স্কুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল যদিও আমার যাওয়া হয়নি। পরে অবশ্য দুদিন গিয়েছিলাম। বাচ্চাদের স্কুল, একটু বড়দের নিয়ে কিশোর সঙ্ঘ, বস্তির হেলথ ক্লিনিক সবই রমরমিয়ে চলছে। শুনলাম মেদিনীপুরের গড়বেতার একটা গ্রামেও নাকি এইরকম স্কুল আর ক্লিনিক চালু হয়েছে। ওখানে নাকি মেয়েদের হাতের কাজ শেখানোরও ব্যবস্থা হচ্ছে যাতে তারা স্বনির্ভর হতে পারে। দেখে শুনে খুব ভালো লাগলো। মনে হলো আমিও তো এরমধ্যে থাকতে পারতাম। এভাবেই দুসপ্তাহ কেটে গেল। ফেরার সময় দুবাড়ির মা বাবাকেই বিষণ্ণ লাগছিলো, যেটা প্রথমবারে ছিলো না।

তিনমাস হলো ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছি। কলকাতায় কাটানো দুসপ্তাহ নিয়ে অনেক ভাবলাম। মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যেটা নিয়ে একমাত্র তোমার সাথেই কথা বলা যায়। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি, আমি কি সারাজীবন মিসেস চক্রবর্তী হয়েই থাকবো? আমার নিজের কৃতিত্বে, সেটা যত ছোটই হোক না কেন, আমার কোন পরিচয় থাকবে না? জেদ ধরলে বিমল হয়তো কাজ করতে দেবে, কিন্তু এমন কিছু করা যাবেনা যাতে ওর কাজের অসুবিধা হয়। দ্বিতীয়ত মা বাবারা আমাদের কাছে মুখ ফুটে কিছু না চাইলেও ওঁদের কি কিছু প্রত্যাশা থাকেনা? দু বাড়িতেই যা অবস্থা দেখলাম তাতে এমন কাউকে  দরকার যে মাইনের বদলে কাজের চেয়ে একটু বেশি দিতে পারে। আমি ছাড়া কাছাকাছি আর কেউ আছে বলে ভাবতে পারছিনা।

বিমলের সাথে এই নিয়ে কথা বললাম। ও ফিরে যেতে রাজি নয়। আজ অনেক পরিবারেই এই রকম অবস্থা। সেক্ষেত্রে সবার পক্ষে কি এরকম করা সম্ভব, না  বাস্তব? ওর কথায় যুক্তি আছে আমি জানি কিন্তু আমার মন সে কথা মানতে রাজি নয়। আর একটা কথা বারবার মনে আসছে, সেটা হলো কমলদার কথা। কমলদাকে  আমার আগেও ভাল লাগতো ওর চালচলন ব্যবহারের জন্য। বিয়ের আগে কাজের সূত্রে ওর কাছাকাছি এসেছিলাম তবে সেটাও ভাল লাগা পর্যন্তই। এবারে দেশে গিয়ে ওদের কাজ দেখে, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা দেখে অজান্তেই বিমলের সাথে তুলনা করতে শুরু করেছি। জানি সব মানুষই একরকম হয়না, কিন্তু তাতেও তো তুলনা করা বন্ধ হয়ে যায়না। এখন বুঝতে পারছি কমলদার কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার ইচ্ছেও দেশে ফিরে আসতে চাওয়ার একটা বড় কারণ।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পরে বিমলকে দুটো সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। প্রথম হলো কলকাতা ফেরার কথা আর দ্বিতীয় ডিভোর্সের কথা। বিমল কিন্তু খুব একটা অবাক হয়েছে বলে মনে হলোনা। ও বরাবরই বাস্তববাদী। আমি যদি বরাবরের মত দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবে থাকি তাহলে বিয়ের বাঁধনটা টিকিয়ে রাখার কোন মানে নেই।

বুঝতেই পারছো যত সহজে কথাগুলো লিখলাম সিদ্ধান্ত নেওয়া তত সহজ ছিলো না। দু’পক্ষের মা বাবার কথা বারবার ভেবেছি। কেউই এটা মেনে নেবেন না। কিন্তু অনেক ভেবেও আমি এর মধ্যে ভুল কিছু দেখছিনা। চারজন খুব কাছের মানুষকে একটু ভালভাবে রাখার জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দেওয়া এমন কী বিরাট ব্যাপার?  বিশেষ করে যে সুখ আমি ভোগ করতে পারছিলামনা। গ্লোরিফায়েডত হাউস মেডের ভূমিকায় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এদেশের সমস্ত রকম সুখ আর ভোগের সুযোগের মধ্যে থেকেও নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে একটু নিজের মত করে বাঁচার সুযোগও তো পাবো!

এবারে শেষের কথায় আসি। ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বিমলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ,  কেননা ও নিজের মত করে আমাকে বোঝাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, কিন্তু  কখনোই আটকানোর চেষ্টা করেনি। মা বাবাদের মত কী হবে সেটা তো জানাই আছে, শুধু বুঝতে পারছিনা কমলদার মনোভাব কী হবে! কমলদার সাংসারিক চরিত্রটা আমার বোঝা হয়নি। কমলদা বরাবরই অন্যদের থেকে আলাদা।

আমার এদেশে থাকার পালা শেষ। কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে যাচ্ছি। ভয় পাচ্ছিনা বলবোনা। কাউকে এখনও কিছু জানাইনি। গিয়েই সব জানাবো। ব্যাপারটা মোটেই সহজ হবেনা জানি। কিন্তু সোজা রাস্তায় হাঁটাটা সহজ হলোনা বলেই নতুন পথের খোঁজে বেরোতে হলো, আর সেটা যে সহজ নয় তা তোমার চেয়ে ভাল আর কে জানে! তাই তুমি যে আমার সাথে থাকবে, তা আমি জানি। সেই ভরসাতেই তোমাকে আর একটা কথা জানাই। ভালোলাগাটা যে কবে ভালোবাসা হয়ে গেছে,  আমি বুঝতে পারিনি। সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে, আর তার জন্য “আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি”। নেওয়া না নেওয়া তো অন্যপক্ষের ইচ্ছে। তোমার আশীর্বাদ আমি পাবোই, জানি।

ইতি

তোমার ছোটবোন অদিতি

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন