ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৯)
এই ঘটনার পরই সমিধার সঙ্গে আগ্নেয়র ঘনিষ্ঠতা আগের চেয়ে অনেক
বেড়ে গেল। হৃদয় চায়নি সমিধা মনে কোনো আঘাত পাক। সেই ব্যবস্থা আগ্নেয় ভালোমতোই করেছে।
সমিধা ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছে। কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করেনি। কোনো ব্যাকুলতা দেখায়
নি। জোর খাটায় নি বা করুণা চায় নি। নিজের আত্মমর্যাদা নিয়ে সে সরে গেছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া
দেখিয়ে কোনো নাটকীয়তা সৃষ্টি করে নি। আবেগের বাড়াবাড়ি দেখায় নি। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ
ও সংযম শান্তভাবে বজায় রেখেছে। ওদের বন্ধুত্বও ঠিক আগের মতোই বজায় থাকে, কোথাও কোনো
চিড় ধরেছে বলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ভেতরে সে যে একটা প্রবল ধাক্কা খেয়েছে,
সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারে হৃদয়।
একদিন সমিধা জানতে চায়, বেদপর্ণাকে ভালোবাসতিস তুই?
হৃদয় বুঝতে পারে বেদপর্ণার কথাও সমিধাকে জানিয়েছে আগ্নেয়। কিন্তু
কী বলবে সে? বেদপর্ণার মাথা খুব পরিষ্কার ছিল? দেখতে খুব সুন্দর ছিল সে? তার ঠোঁট দেখলে
চুমু খেতে ইচ্ছা হতো?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সমিধাই বলে ওঠে, শুনেছি মেয়েটির কোনো
মেধা বা গভীরতা ছিল না।
-কিস্যু না! ওকে কারো ভালো লাগতে পারে?
ঘৃণায় সমিধার মুখ বেঁকে গেল। হৃদয় কোনো উত্তর দিল না। সে বুঝতে
পারল, বেদপর্ণার কথা শুনে সমিধার মনে ঈর্ষা হয়েছে। আগ্নেয়ই ওর মনে ঈর্ষা জাগিয়েছে।
আসলে হৃদয়কে ওর চোখে ছোটো করতেই এ কাজ সে করেছে। মেয়েদের ব্যাপারে হৃদয়ের পছন্দ অপছন্দ
আসলে যে কতটা ঠুনকো আর অগভীর, সেটাই যেন দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু সমিধা যেমন বর্ণনা দিল,
বেদপর্ণা তো ঠিক তেমন মেয়েই ছিল না! কিন্তু ঈর্ষাণ্বিত মানুষ কখনই স্বচ্ছ চিন্তা ও
সঠিক বিচার করতে পারে না। তাকে কিছু বোঝাতে যাওয়াও অর্থহীন। তাছাড়া আগ্নেয় হঠাৎ বেদপর্ণাকে
নিয়ে অমন একটা ধারণা দিতে গেলই বা কেন? সে তো বেদপর্ণাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিতই ছিল একদিন!
সমিধার সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক কিন্তু আর স্বাভাবিক হল না। বরং দিনে দিনে দূরত্ব আরো বাড়তে লাগল।
আগ্নেয়র দ্বীপে সে এখন প্রায়ই যায়। ক্যারাটে শেখে সেখানে। আর
সেখানেই নাকি ওদের বেশির ভাগ আড্ডা হয়। সেই আড্ডায় সমিধা আর আগ্নেয় ছাড়াও থাকে বিহান।
কখনো কখনো অতলান্ত আর অনির্বেদ। ওরা কখনো সেখানে হৃদয়কে যেতে বলে না। বিশ্রুতকেও নয়।
এই নিয়ে হৃদয়ের মনে খুব কৌতূহল। কী এত কথা হয় ওদের?
একদিন সমিধার কাছে জানতে চায়, কী নিয়ে কথা বলিস তোরা?
-সে অনেক কথা। সমিধা রহস্য করে বলে।
-কারা আসে সেখানে?
-অনেকেই। সবাইকে তুই চিনবি না। বিহান থাকে। মেহুলী থাকে। নির্মাল্য
বিদেশ চলে যাওয়ার পর থেকে এখন আগ্নেয়র সঙ্গেই
বেশী দেখা যায় ওকে। লঞ্চে উঠলেই আগ্নেয় এখন মেহুলীর টিকিট কাটে। আমি পাশে থাকলেও কোনোদিন
আমারটা কাটে না!
কথাটা মজা করে বললেও হৃদয় বুঝতে পারে সমিধার অভিমান হয়েছে। কিন্তু আগ্নেয়র মধ্যে এই সঙ্কীর্ণতা কেন? সমিধার আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য বন্ধু হিসাবে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকে আগ্নেয়। যদি সেটা নাও নিত, তবু মনের এই সামান্য উদারতা কি তার থেকে আশা করা যায় না? হৃদয় বিষণ্ণ বোধ করে। এক সুন্দর ও উদার জীবনের স্বপ্ন দেখে সে। আর কী তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপারেই না তার বন্ধুদের মনের সঙ্কীর্ণতা প্রকাশ পায়! কিন্তু এখনো কিছুটা কৌতূহল তার রয়ে গেছে। সে জানতে চায়, ফুলের বাগান নিয়ে কথা হয়?
-ওই যে বললাম, অনেক কিছু নিয়েই হয়। তার মধ্যে ফুলের বাগানও আছে।
সমিধা যেন খুব সন্তর্পণে কিছু একটা গোপন করে যায়। সেরকমই মনে হয় হৃদয়ের। ঠিক যেন মন খুলে কথা বলতে চায় না, বরং আড়াল করতেই চায়। আগ্নেয়র প্রতি ওর একটা কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে। যথাসময়ে প্রকৃত বন্ধুর মতোই আগ্নেয় ওকে সতর্ক করে দিয়েছিল। নইলে মনে মনে ও তো ভেসেই যাচ্ছিল। তাই আগ্নেয়র কাছ থেকে ছোটোখাটো আঘাত পেলেও সেগুলো ও গ্রাহ্য করে না। আগ্নেয়র বন্ধুত্ব ও সাহচর্য ওর কাছে খুব দামি। কিন্তু হৃদয় যে ওকে আঘাত দিয়েছে, তার যেন কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। মাঝেমাঝেই ওর ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। আগ্নেয়র উপস্থিতিতে সেই রক্তপাত যেন আরো বেড়ে যায়।
অনেকটা রক্ত, দূষিত রক্তই হবে, বার করে দিতে পারে আগ্নেয়। রক্তে
ভেসে যেতে যেতে ক্রমেই হাল্কা হতে থাকে সমিধা। আগ্নেয় ওকে রক্ষা করেছিল। ও আগ্নেয়কে
রক্ষা করবে। হৃদয়ের মনে তিলমাত্র সন্দেহ জাগতে দেওয়া চলবে না।
আগ্নেয়কে বলেছিল সমিধা, ওকে আমি ছাড়ব না। সুযোগ পেলেই শাস্তির
পর শাস্তি দিয়ে যাব।
অনেকদিন পরে সাঁঝ হৃদয়কে বলেছিল, তুই বোধহয় কিছুই বুঝতে পারিস নি...
-কী করে বুঝব? সরলভাবে বলে উঠেছিল হৃদয়, ওরা সবাই যে আমার বন্ধু...
-চমৎকার বন্ধু সব! ঈর্ষায় জ্বলতে থাকা পোড়াকাঠ। তোর আর তোর ফুলের
বাগানের শ্রাদ্ধ করত বসে বসে...
-আর আমি ভাবতাম আমার স্বপ্নকে দশজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে ওরা,
সুনাম বাড়ছে আমাদের, আমি তো কখনো ওদের কোনো
ক্ষতি করিনি, তাই ভাবতেও পারিনা ওরাও কখনো আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে। আমি নিজে যেমন
করে বন্ধুদের ব্যাপারে ভাবি, ওদের ব্যাপারেও
ঠিক সেভাবেই ভেবেছিলাম। ওরা আমাকে, আমাদের ফুলের বাগানকে দশজনের চোখে ছোটো করে দেবে, এ যে আমার কাছে ছিল কল্পনারও
বাইরে...
-কিছুই বুঝিস নি তুই! অথচ তুইই ছিলি ওদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য।
ওরা বলত, ফুলের বাগানটা তুই করেছিস সম্পূর্ণ
নিজের স্বার্থে। নিজের আত্মপ্রচারের জন্য। তাই সবাইকে দাবিয়ে রাখতিস। নিজের মতকে জাহির
করতিস। নিজে ওপরে ওঠার জন্য তুই বাকি সবাইকে
ব্যবহার করেছিস। ওরা তোকে একঘরে করে দিতে চেয়েছিল। এমনকী সমর্থন বাড়ানোর জন্য অতলান্তকেও
ডাকত মাঝে মাঝে। আর অতলান্তের সমর্থনও পেয়েছিল। অতলান্ত অবশ্য সমর্থন করতই। গিরগিটির
মতো রঙ পাল্টানোই ওর স্বভাব। অতলান্তের সমর্থন পেলে, অনির্বেদেরও সমর্থন পাবে, সেকথাও
ওরা জানত। ওরা অবশ্য আরো জানত, বিশ্রুত আর শ্রমণ কখনো তোকে ছেড়ে যাবে না। তাই ওদের
দুজনকে স্তাবক, তোষামোদকারী, মেরুদণ্ডহীন ইত্যাদি
নানা শিরোপা দেওয়া হয়েছিল। ওরা যে কাফেতে বসে আড্ডা দিত, সেখানেই শ্রমণকে একজন বলে,
তোদের হৃদয়কে বলে দিস, এত অন্যায় করলে কখনো তার পরিণতি ভালো হয় না! ও যা করেছে, এবার
অন্তত ওর বোঝা উচিত, শিক্ষা নেওয়া উচিত! শ্রমণ আকাশ থেকে পড়েছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে
নিয়েছিল পুরোটাই। ওঃ, কী বদনামটাই করেছিল ওরা তোর আর ফুলের বাগানের... -সমিধা এর প্রতিবাদ
করত না?
-প্রথমদিকে খুবই করত। অন্তত শ্রমণের ব্যাপারে। পরে বিহান আর
আগ্নেয়র কথায় অনেকটা প্রভাবিত হয়। শ্রমণের
ব্যাপারে কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছিল। তবে তোর ব্যাপারে ওই ছিল সবচেয়ে বিরোধী। বিশ্রুতর
ব্যাপারে কখনো ওদের সমর্থন করত, কখনো করত না। শ্রমণের ব্যাপারে প্রায় কখনোই না। কিন্তু
আগ্নেয়, অতলান্ত আর বিহানের বিরোধিতা ছিল একপেশে আর বিরতিহীন।
-আশ্চর্য!
-এইভাবেই হৃদয় ওর প্রাপ্য পেয়েছিল। কিন্তু তখনো যে ওর অনেক দেওয়া
বাকি!
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন