কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

চিরশ্রী দেবনাথ

 

সমকালীন ছোটগল্প



মায়ারাণী

 

(১)

আজ মায়ারাণীর বিবাহ। আষাঢ় মাস। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বাংলাদেশ।  আকাশে থরে থরে মেঘ বিবাহবাসর সাজিয়েছে। বিদ্যুৎ চমক, মেঘের গর্জন সবকিছু মিলেমিশে তুমুল নহবৎ। ভোলা মহকুমা, দৌলত খাঁ গ্রাম।

মেঘনার মোহনা খুব বেশি দূরে নয়। কাঠের দোতলা বাড়ি। বড় বড় গাছ। আম, কাঁঠাল, নাড়কেল, সুপুরি। ফুল লতা পাতা ঔষধি। শুদ্ধ গৃহাঙ্গন। পাঁচ ছটা  হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। ত্রিপলের ছাউনি বাঁশের খুঁটি দিয়ে শক্ত করে টানানো সারা উঠোন জুড়ে। উপরে বাঁশের ছাপরা।

বরপক্ষ, কন্যাপক্ষের চরম ব্যস্ততা। মাঝে মাঝেই উলুধ্বনি।

উঠোনের একপাশে যজ্ঞি বাড়ির রান্নার আয়োজন গত পাঁচদিন ধরে, কানাইলাল এখন বাজারকর্তা বনেছেন, মুহূর্তমাত্র সময় নেই তার হাতে।

কিঞ্চিৎ  প্রাক্কথন।

গোপীবল্লভ শর্মার জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতি মায়ারাণী শর্মা। গায়ের রঙখানি বেশ। গৌরবর্ণা বলা তো যায়ই। চোখ উজ্জ্বল। পুরু ঠোঁট। কালো তিল গালে। মাঝারি  উচ্চতা, তন্বী। একবার দেখলে যে কোন তরুণ যুবার সহজে ভুলে যাওয়ার কথা নয়।

মায়ারাণীর পড়াশোনায় বিশেষ মন নেই। বুদ্ধি এবং রাগ দুটোই সমান সমান। বড় মেয়ে, বাবার অতি আদরের দুলালি, তাকে কিছু বলে এমন সাধ্য কার!  গোপীবল্লভ শর্মা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন, বাধ্য হয়ে। দুটো শিশুপুত্র রেখে প্রথমা স্ত্রী মারা যান হঠাৎ সামান্য রোগভোগে। বিশাল বাড়ি, বাগান, পুকুর এবং দুজন শিশুপুত্র।

গোপীবল্লভ দুচোখে মেঘনার রুপোলি জল ছাড়া কিছুই দেখতে পারছিলেন না। সাদা পাল উড়িয়ে দলে দলে মাঝির দল বাড়ির পেছনের বড় খাল দিয়ে অকূল দরিয়ায় মাছ ধরতে বেরিয়েছে। কাঠের দোতলার  জানলা থেকে এই দৃশ্য দেখে, সদ্য স্ত্রীহারা যুবকটি তৎক্ষণাৎ ভাবলেন, তাকে বিবাহ করতে হবে।

শালপ্রাংশু যুবক, সেইসময়ে গাইনি ও সার্জারি দুটো বিষয়েই গোল্ড মেডেল। L.M.F ডাক্তার। সরকারি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন।

এই গ্রাম সহ দূরবর্তী আরো বহু গ্রামের একমাত্র চিকিৎসক তিনি। কালো চামড়ার ব্যাগে প্রয়োজনীয় ঔষধ, স্টেথোস্কোপ তৈরিই থাকে সবসময়। বাড়িতে একটি ডিসপেনসারি। তাতে অন্তত দিনে একবার ঢুঁ দিয়ে যান সাবিনা বেগম। ধবধবে ফর্সা, লালচে চুল, নীল চোখ, আপাদমস্তক ফুলহাতা সালোয়ার কামিজ অথবা গলাবন্ধ সেমিজ দিয়ে শাড়ি পরেন গুছিয়ে।

দু হাতে মোটা মোটা সোনার বালা। খুব পরিপাটি। সবসময় শরীর থেকে পাউডারের ফুলেল গন্ধ, ঢাকা থেকে আনান নিয়মিত। শৌখিন, পরিচ্ছন্ন।

পাশের সমৃদ্ধ মুসলমান বাড়ির কন্যা। স্বামী পুত্র নিয়ে পিতৃগৃহেই থাকেন, ঘরজামাই। বড়ো ভুসিমালের ব্যবসা, দেখার লোক চাই, তাই এরূপ ব্যবস্থা, তবে গ্রামের লোক বলে সাবিনার বাবা ওনার দুইছেলে অপেক্ষা কন্যার ওপরই বেশি নির্ভর করেন, ব্যবসায় সাবিনার পরামর্শ তার চাই।

সাবিনা ভীষণ অসুস্থ হয়েছিলেন, একমাস ধরে জ্বর। গোপী ডাক্তারই চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলেছেন। সেই থেকে সাবিনা গোপী ডাক্তারকে দাদা ডাকে। গোপীবল্লভ ডাকেন বোন।

সাবিনা না থাকলে এই মুহূর্তে ছোট বাচ্চা দুটো না খেয়ে থাকতো। সাবিনা বেগম সবসময় থাকছেন কদিন ধরে। উপায় নেই, সংসার ছন্নছাড়া। গরু বাছুর না হয় কাজের লোক দেখবে, কিন্তু তার ডাক্তার ভাইটির যে অবস্থা খারাপ। তাকে কে বুঝবে?

রান্না বসিয়েছেন, বাচ্চাদের দুধ বার্লি, গলা ভাত। নাদুস নুদুস ফর্সা দুখানা শিশু।

গতকাল বিকেলে  সাবিনা বেগমই আলাপ এনেছেন। পাশের গ্রামে বাড়ি। কন্যাটি কর্মঠ, বয়স উনিশ। গ্রাম গঞ্জের তুলনায় একটু বেশিই বলতে হবে। ভালোই হয়েছে, বুঝব্যবস্থা আছে।

বেঁটেখাঁটো,  রঙ ফর্সার দিকে। নাম লক্ষ্মী... লক্ষ্মীরাণী। এখন যদি গোপীবল্লভ রাজি থাকে।

গোপীবল্লভ রাজি, না হলে উপায় নাই, সংসার এবং তিনি দুইই টালমাটাল। এছাড়া গাঁ গঞ্জের লোক নিন্দে ছড়াতেও ওস্তাদ। তার একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয় চাই।

অতঃপর সাদামাটা বিবাহ আয়োজন। মালা বদল, জোকার। অতি সাধারণ লক্ষ্মীরাণী প্রবেশ করলেন গোপীবল্লভের সংসারে। তখন কি আর কেউ জানত, কত বিশাল বিস্তৃতি লাভ করবে এই শর্মা পরিবারের ডালপালা! শক্ত হাতে সমস্ত  ঝড় সামলাতে সামলাতে সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এই সাধারণী!

আপাতত সেই সময়ের তুলনায় একজন বেশি বয়সের সলাজ কনে পালঙ্কে বসে আছেন। সাবিনা ঘরে ঢুকলেন। বলিষ্ঠ শরীরের রমণী। দুই কাঁখে দুইটি শিশু। ধপ করে লক্ষ্মীর কোলে ফেলে দিলেন। নাও, তুমি প্রথম থেকেই মা হলে। লক্ষ্মী অবাক হলেন না, এ তো জানাই ছিল তার। পাত্র দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। প্রথম বউ মৃত এবং দুটি সন্তান আছে আগের ঘরের। গ্রামে গঞ্জে এসব হয়েই থাকে। গোপীবল্লভ বেশ দেখতে। লম্বা, সুন্দর স্বাস্থ্য। কথা বললে গম গম করে চারপাশ। প্রশস্ত বুক। ভালোই হবে মনে হয়। তবে কর্তার মেজাজ আছে, বোঝা যায়। সাবিনা ছাড়া সবাই ভয়ে কাতর যেন তার উপস্থিতিতে।

গোপীবল্লভ  ভোজন রসিক। রোজগারপাতি ভালো। গ্রামের মানুষের চিকিৎসায় নিবেদিত প্রাণ। ভিজিট নামমাত্র। তাও অনেকে দিতে পারেন না। তাই বলে কি ডাক্তারকে কিছু দেবো না? মেঘনার টাটকা মাছ, ফলমূল, সব্জি, আসতেই থাকে। আদরের দান, না গ্রহণ করলে চক্ষে জল।

ভোলা অঞ্চলটি প্রত্যন্ত। প্রচুর ঝড়বৃষ্টি কবলিত। হিমালয় থেকে নেমে আসা তিন নদী পদ্মা, যমুনা আর ব্রহ্মপুত্র সাগর মোহনায় মিলিত হতে এসে পূর্বদিকে মেঘনা এবং পশ্চিমদিকে তেঁতুলিয়া নদীর সঙ্গে মিশে যায়। ফলে তাদের গতিবেগ  অনেকটাই যায় কমে, জমতে থাকে পলি, নদীবাহিত বর্জ্য পদার্থ। আনুমানিক ১২৩৫ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ এই দ্বীপটির সৃষ্টি হয় এবং ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এখানে চাষবাস শুরু হয়। উর্বর পলি ভূমি চাষের খুবই উপযুক্ত, তাই আশপাশের জায়গা থেকে স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষ আসতে শুরু করে। তবে আরাকান থেকে আগত জলদস্যুরা দীর্ঘদিন এই দ্বীপটিকে দখল করে রেখেছিল, সে প্রায় ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কথা। কালক্রমে নদী মোহনায় প্রাপ্ত প্রচুর ইলিশমাছের জন্য ভোলা বিখ্যাত হয়ে যায়। ভোলার প্রথম নাম ছিল শাহবাজপুর।

সেখানে যে বড় খালটি দেখা যায় যার নাম বেতুয়ার খাল, অতীতে নাকি এটিই ছিল বেতুয়া নদী এবং ভোলা গাজি পাটনি নামে এক মাঝি নৌকা পারাপার করতো সেখানে , তার নাম থেকেই ভোলা নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।

সাগর মোহনার নোনাজলের জন্য ভোলা একসময় লবণ উৎপাদনে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এখান থেকে শুরু হয় লবণ রপ্তানির ব্যবসা। কোন একসময় নানা  প্রতিকূলতার সৃষ্টি হলে ভোলাতে লবণ আন্দোলনও হয়। ভোলা সংলগ্ন আরেকটি  দ্বীপ আছে তার নাম মনপুরা। ভোলাকে কেন্দ্র করে এরকম ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে মহিষের খামার তৈরি হয়েছে। প্রচুর দুধ থেকে তৈরি হয় ভোলার বিখ্যাত দই।

বাড়ির পেছন দিয়ে প্রবাহিত যে খালটি সরাসরি মেঘনার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে, এটাই সেই বেতুয়া খাল, তবে সবাই বড়ো খাল বলে এখন।

মেঘনায় জোয়ার এলে খালেও ধেয়ে আসে জোয়ারের জল। উঠোন ছাপিয়ে উঠতেও দ্বিধা করে না। তাই বাড়িঘরগুলো কাঠের খুঁটির ওপর উঁচু করে তৈরী  করা। জোয়ারের জল, বন্যার জল খুব সহজে ক্ষতি করতে পারে না। খুব শক্তপোক্ত কাঠের দোতলা।

বাড়ির পাশেই মদনমোহনের আখড়া। প্রচুর ফলের গাছ। ছায়া ঘেরা ভগবানের মন্দির। নিয়মিত পুজো অর্চ্চনা হয়, ভোগ আরতি। নিষ্ঠাবান এবং কড়া  বৈষ্ণব বৈষ্ণবী, নামগান আর প্রসাদের ব্যবস্থা করা ছাড়াও গাছপালার ফলমূল  লকলকে বাঁশের মতো বেড়ে ওঠা গ্রামের ছেলেপুলেদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লাঠি হাতে সারাক্ষণ তৎপর, গোপালঠাকুরের প্রতিও তাদের এইরকম মনোযোগ নেই।

একটি টগর গাছ, দুখানা কাঠগোলাপ, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, তুলসীর ক্ষেত, কাঞ্চনফুল, দুধেল গরু এই নিয়েই মদনমোহনের মুখরিত ঘরসংসার। একদিন, সেদিন অর্ধচাঁদ। পূর্ণিমা চলে গেছে প্রায় সাত দিন আগে। গ্রামের রাত। নিস্তব্ধতা গড়িয়ে গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর। আখড়া থেকে রাতের পুজোর ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

ম়ৃদু মৃদু ল্যাম্পের আলো আবছা অন্ধকারকে আরো উসকে দেয়, দূর গ্রামে রোগী দেখে ফিরছেন গোপীডাক্তার। ভোলার থেকে অনেক দূরে, মেঘনার একদম পার্শ্ববর্তী গ্রাম। রোগী দেখা শেষে, মেঘনার তীর দিয়ে আসছিলেন, একাই। গম্ভীর গর্জনে রাতের জলধারা তীর স্পর্শ করে করে চলে যাচ্ছে। ঢেউয়ের মাথায় রুপোর মুকুট। মনে হয় কত নীচ থেকে নদী বলে বলে যাচ্ছে নিজের কথা! কেউ কি শোনে সেই ডাক, একাকীত্বের খবর!

গোপীবল্লভ কাঠখোট্টা মানুষ। বাস্তব বোঝেন। টাকা বোঝেন। আবার মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্যও বোঝেন। বোঝেন পুরুষমানুষের বাঁচতে হলে একজন নারী লাগে সঙ্গে, কর্মঠ, দায়িত্ববান, নাহলে আয় উন্নতি কিছু হয় না। তিনি আপাতত তৃপ্ত। প্রথমা পত্নী একটু এলেবেলে ছিল। লক্ষ্মীরাণী সেরকম নয়। খাপে খাপে মিলে গেছে যেন।

তবুও  নতুন বউ বলে কথা। আর একজন মহিলা আছেন বাড়ির অন্যান্য কাজকর্ম করার জন্য, সে আবার বিকেলে চলে যায়। এজন্যই পাশের গ্রাম থেকে কানাইলালকে জোগাড় করেছেন। বলশালী, পাগলা গোছের হলেও ভীষণ বিশ্বাসী। ভয়ের কিছু নেই তাই রাত হলেও।

আর লক্ষ্মীর রান্নার হাতটি খুব ভালো, তিনি বড়ো খুশি। টাকা কামাই করে যদি ভালো করে খেতে এবং খাওয়াতে না পারেন তা হলে আর কী লাভ এই বেঁচে থেকে! এই যেমন আসার সময় গঞ্জের হাঁট থেকে কচি পাঁঠার মাংস, খাসার  চাল, আর কাতলার পেটি নিয়েছেন, এখন গিয়ে কী বলবেন? নিশ্চয়ই রাতের রান্নাবান্না শেষ করে বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে দিয়েছে নতুন বউ। গোপীবল্লভ জেদী মানুষ। মনটা অনেক ভেতরে নরম হলেও, খুব রাগ ওঠে যখন তখন। অন্যরা বুঝে চলেন। নতুন বউটি শান্ত। রাগ আছে কিনা বোঝা যায় না, তাকে কি ভয় পায়? কেমন নরম, দৃঢ় ভাবে থাকে, নতমুখে, ঘোমটার তলায় বিশেষ কিছু বোঝা যায় না।

কাঠের গেটে মৃদু শব্দ হলো, বকুলফুলের গন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খোলার আওয়াজ, ঝকঝকে হ্যারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখলেন লাল ডুরে শাড়ি পরা বউটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচের দিকে হ্যারিকেনটি ঝুলিয়ে দিয়েছেন। নীচের উঠোনে গোয়ালঘর, ডিসপেনসারি আর কানাইলালের ঘর। গোপীবল্লভের কাজের চাপ বেড়েছে, এখন সবসময়ের জন্য কানাইকে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন।  কাঠের সিঁড়ির ওপর আলো পড়েছে, গোপীবল্লভ উঠছেন ওপরে।

ব্যাগ রেখে চেয়ারে বসতেই লেবুর সরবত এলো। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,  বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে? লক্ষ্মীরাণী বললেন, হ্যাঁ।

রান্না নিশ্চয় শেষ?

আজ্ঞে।

তুমি খেয়েছো?

আপনের খাওয়া হোক।

এত রাত না খেয়ে থাকবে না কখনো, বোঝই তো আমার সময়ের ঠিক নাই। এইখানে কচি পাঁঠার মাংস আর খাসার চাল, মাছের পেটি আছে। মাছ কাল রান্না করবে। এখন একটু পোলাও মাংস করো। পারবে তো?

ক্ষণিকের নীরবতা। তারপর লক্ষ্মীরাণী মাথা নাড়লেন।

নীচে পাকঘরে যেতে হলো। মাংস বলে কথা। কানাই হ্যারিকেন ধরল। মাংস বাছা ধোয়া হলো। হাঁড়িতে খাসার চাল। এতো রাতে পাটার ঘটাং ঘটাং শব্দ, লক্ষ্মীরাণী মনে মনে ভাবছেন, পুকুর আর গাছপালা ডিঙিয়ে যদি এই শব্দ  পাশের বাড়ি পৌঁছায়, তাহলে কে কী ভাববে!

সাবিনাদিদি ভাববে, নতুন বউ আগে রাঁধেনি কেন? সাবিনাদিদির আম্মা আনোয়ারা বেগম ভাববে, বেআক্কলে মিনসে! সাবিনাদির আব্বা ভাববে, মরদ বটে!

আদা, কাঁচামরিচ, জিরে, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন কোনোটা মিহি, কোনটা আধভাঙা করে বাঁটলেন লক্ষ্মী। বুঝে গেছে্ন, এইটা চলবে। তাকেও তৈরি থাকতে হবে যখন তখন। তেলে ঝোলের মানুষ, আহারে মিলনে ঠিক থাকে। সুতরাং সেরা  রান্নাই  রাঁধতে হইব। ত্রুটি দিয়া লাভ নাই। এমনেই আঁচলে থাকব।

মাংস এক উনুনে, অন্য উনুনে পোলাও। ফুটন্ত জলে খাসার চালের ছোট্ট ছোট্ট কোষগুলো ফুটছে। তাই দেখে হঠাৎ লক্ষ্মীরাণীর মনে হলো, যেন গরম জলে  জুঁইের পাপড়ি মেলে দিয়েছে আস্ত শরীর। কী সুগন্ধই না ছড়াচ্ছে! এখন কত রাত? সাড়ে বারোটা বা একটা? ঝিঁ ঝিঁ পোকা একটানা ডেকে চলেছে। এবার মাংস তার গন্ধ ছড়াতে শুরু করল।

লক্ষ্মীরাণী পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। খুব আগ্রহ ছিল বই পড়ায়। রামায়ণ,  মহাভারত এসব খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে নিয়েছেন এর মধ্যেই। তার জীবন গ্রাম্য হলেও মনের মধ্যে আছে একটি আধুনিকতা। দেশ বিদেশ সম্পর্কে জানার স্পৃহা। আর খুব তাড়াতাড়ি তিনি নির্লিপ্ত আর শান্ত হয়ে যেতে পারে্ন। গোপীবল্লভের  একটু আগের এই চাওয়াটা তার খুব অন্যায় মনে হয়েছিল, কিন্তু তিনি চুপ করে গেলেন, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে ফেললেন। দুদিকে দুটো উনুন মাতাল হয়েছে। একটায় বিশুদ্ধ গন্ধ, অন্যটায় ব্যাধ গন্ধ। একটু পরে দুটো খেয়ে ফেলবে একজন মানুষ, একসঙ্গে। এইভাবে মানুষও পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায়, তার হৃদয় আলাদা হলেও। এমনকি পরস্পরকে খুব ভালোও বেসে ফেলে।

পোলাও মাংস রান্না হলো। ঝকঝকে কাঁসার থালায় যত্ন করে পোলাও বাড়লেন লক্ষ্মী। কাঁসার বাটিতে মাংস।

একটা থালায় কানাই-এর জন্য। বেচারা এখনো বসে বসে ঢুলছে আর পাহারা  দিচ্ছে নতুন বউঠানকে। ও খাক পেট ভরে।  রান্নাঘর গুছিয়ে, খাবার নিয়ে লক্ষ্মীরাণী ওপরে উঠে এলেন। আলো ধরে, জিনিসগুলো নিয়ে দোতলায় উঠতে সাহায্য করল কানাই।

গোপীবল্লভ তখনো  ঘুমোননি। ডাক্তারি বই পড়ছিলেন মন দিয়ে। আসন পেতে খাবার দিলেন লক্ষ্মী। পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। খাবার মুখে দেওয়ার আগে বললেন, তোমার জন্য আনোনি? সে কী? নাও থালায়।

লক্ষ্মীরাণী বললেন, এতো রাতে আমি আর খাবো না। আপনে খান।

না তা তো হবে না। তুমি খাবে না আর আমি খাবো!

কিন্তু নতুন বউয়ের জেদও কম না। খাবেই না। অবশেষে কিঞ্চিৎ রফা হলো। দু গ্রাস বউয়ের মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দিলেন।

রাত কি শেষ হয়ে এলো? মুরগি ডাকছে যে! বড়ো তৃপ্তি করে খেলেন ডাক্তারবাবু। সব শেষ হতে হতে, আজানের সুর।

মদনমোহনের আখড়ায় বড় গোঁসাই হাঁক দিলেন 'জয় গৌরনিতাই ', মানে ভোর হওয়ার আর বেশি বাকি নেই, উঠতে হবে, ভোরের কীর্তন, বাল্যভোগের জোগাড় শুরু করতে হবে।

লক্ষ্মী বিছানায় শুতে গেলেন একটু। কিছু পরেই আবার উঠে যেতে হবে,  বাচ্চারা দুধ খাবে।

বছর ঘুরে এলো। লক্ষ্মীরাণীর কোল আলো করে এলো গোপীবল্লভের দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম সন্তান 'মায়ারাণী'।

দুই পুত্রের পর কন্যা। গোপীবল্লভের বড়ো খুশি হলো। কী যে মায়াময় মুখখানি!  লক্ষ্মীরাণী কাজলের টিপ আর চোখে দুটি কাজলের টান দিয়ে রাখলে মনে হয়, সমস্ত মেঘনা মথিত হয়ে এই চাঁদভাঙা জল উঠে এসেছে তার গৃহে।

লক্ষ্মীরাণী আবার মা হয়েছেন। নাহ্ এটা আর কোন নতুন ঘটনা নয়। বলতে গেলে প্রায় প্রতি বছরই গোপীবল্লভের ঘরে নতুন শিশু এসেছে, পাল্লা দিয়ে বাড়িয়েছেন আয়। জমিজমা, বাগান। ডাক্তারির পসার হয়েছে বহুগুণে। দুধেল গাই দু’তিনটি। খাওয়া দাওয়ার তো অভাব নেই।

তাছাড়াও মহিষের খামার থেকে ঘন দুধ আর চাকবাঁধা দই প্রায় প্রতিদিনই আসত বাড়িতে। লক্ষ্মীরাণীর স্বাস্থ্য ভীষণ ভালো, বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা আর রান্নাবান্না, চাকরবাকর, গ্রামের বাড়ির সম্পূর্ণ দায়িত্ব দক্ষহাতে সামলান। ঈশ্বর যেন তাকে দু’হাতে তৈরি করে দিচ্ছেন, যেন সামনে যে সময় আসছে তা তোমাকে একাই সামলাতে হবে লক্ষ্মী!

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন